সবাই জানে সুন্দরবন মানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। কেমন একটা ‘মিলন হবে কতদিনে’ টাইপের ভাব নিয়ে পর্যটক লঞ্চ থেকে আকুল চোখে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকে একটা হলুদ-কালো দাগের আশায়। কিন্তু সুন্দরবন মানে শুধুই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার নয়। সুন্দরবন মানে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, সুন্দরবন মানে এক অপরূপ বায়োডাইভারসিটি, কাদামাটি ভেদ করে বেরিয়ে আসা শ্বাসমূলের টিকে থাকার লড়াই, আইলা, যশ, ডানার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে হোমো সাপিয়েনসদের বেঁচে থাকা, সুন্দরবন মানে এক কঠিন জীবনসংগ্রাম।
শীতে সুন্দরবন ভ্রমণ এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। রাতে শীতের প্রকোপ থাকলেও সকালে মিঠে রোদের পরশ মেখে নদীর শাখা-প্রশাখায় জলযানে ঘুরে বেড়ানো বড়ই সুন্দর। নদীর বিস্তার সাগরকে হার মানাবে। সরু নদী বা খাঁড়িগুলোর দু-পাশে সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, হেঁতালের বন। জঙ্গল এক এক জায়গায় এত ঘন যে আলো পৌঁছয় না। ওই অন্ধকারে ওঁৎ পেতে থাকেন বড়মিঞা। পেটের দায়ে জঙ্গলকে যাঁরা ভরসা করেন, মধু, কাঠ, মীন সংগ্রহ— সবেতেই জঙ্গলে তাঁদের ঢুকতেই হয়, ভয় তাঁদেরই আঠেরো আনা। হাজার হাজার সংস্কার আর নিয়ম মেনেও বাঘের আক্রমণে মারা যায় প্রচুর। তবুও জীবন থেমে থাকে না কখনওই। সুন্দরবন মানে টিকে থাকার এক লড়াই।
সুন্দরবন বেড়ানোর কথা হলে, একটু খোঁজ নিলে সামনে আসে কত সংস্থার প্যাকেজ। দু-দিন-তিন রাতের প্যাকেজ সঙ্গে এক এলাহি ভোজের লিস্টি, যেন লঞ্চে খাদ্যমেলায় অংশগ্রহণ! এই বেড়ানো আনন্দদায়ক এবং আরামদায়ক নিশ্চয়ই তবে খুবই নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। হামলে পড়া ভিড় স্বভাবতই সব সংস্থাতেই এবং সব জায়গাতেই। সমুদ্র থেকে ঢুকে আসা জলধারা কিংবা সমুদ্রমুখী বহু বিভক্ত জলধারা, দু-পাশে জঙ্গল আর পলি-কাদামাটির শিকড় বেরোনো বিছানায় আলস্যে কুমিরের আড়মোড়া দেখতে দেখতেই একটা দিন কেটে গিয়ে পরের দিন এসে যায় নিমেষেই।
আরও পড়ুন: বাংলার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পথ দেখাচ্ছে দেশকে
সুন্দরবন ঘোরা মানে লঞ্চে গোসাবা, সজনেখালি, সুধন্যখালি, নেতিধোপানি, হ্যামিল্টনের বাংলো কিংবা বেশি হলে কলসদ্বীপ। নদীর জলে অলস ভেসে থাকা, লঞ্চে খানাপিনার মোচ্ছব, ওয়াচটাওয়ার, হরিণের ঘোরাঘুরি, সরু নদীর দু-ধারে বাঘের আশায় তাকিয়ে থাকা আর সন্ধেবেলা রিসর্টে লোকাল হলেও রীতিমতো পরিশীলিত এবং নিয়মিত অনুশীলন করা শিল্পীদের অনুষ্ঠান। এর বাইরে সুন্দরবন দেখার আছে কিছু?
দেখার আছে, যদি দেখার চোখ থাকে আর থাকে ইচ্ছা। বালিদ্বীপ এমন একটা জায়গা, যেখানে এখনও সুন্দরবন খুব সুন্দর তার নিজস্বতা নিয়ে। স্থানীয় মানুষের ঘরে থাকা, তাদের সঙ্গে বসে খাবার খাওয়া আর নদীর ধারে পূর্ণিমার বানভাসি আলোয় অবাক চোখে চেয়ে থাকা। এখানে কোনও প্যাকেজ নেই, রিসর্ট নেই, সেইভাবে থাকার হোটেল নেই। আছে অনাবিল প্রকৃতি, কান-এঁটো করে হেসে প্রাণখুলে গল্প করার মানুষ আর প্রাইমারি স্কুলের এক বিস্ময় মাস্টারমশাই— সুজনবাবু। এলাকার দেবতা-প্রায়। এখানে এলে মনে হবে অনেকদিন পর দেশের বাড়িতে ফেরা হল।
গঁদখালি ফেরিঘাটে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিজয়নগর ফেরি চলে সন্ধে পর্যন্ত। মাতলার দিগন্ত-ছোঁয়া বিস্তার খোলা নৌকার বুকে বসে ভয়মিশ্রিত বিস্ময় জাগায়। ওপারে পৌঁছে ভাড়া করতে হবে ভারতের জাতীয় বাহন টোটো। আধঘণ্টা লাগবে এই বিরাজনগর গ্রাম, বিদ্যা ১০ নম্বর, বালি দ্বীপে পৌঁছতে। বালি গ্রামটিতে প্রান্তিক, খেটে-খাওয়া মানুষের বাস কিন্তু শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে ভালই, ফুলগাছ দিয়ে সাজানো বাড়িগুলির পরিচ্ছন্নতা চোখ টানে। এখানে থাকার জায়গা গড়ে উঠেছে কয়েকটা। একদিকে মাতলা আর একদিকে বিদ্যাধরী ঘেরা এই দ্বীপগ্রামে ভিড়ভাট্টা নেই অথচ আছে এক নির্জন সুন্দর সুন্দরবনের স্বাদ। যেখানে থাকা হবে তারাই উপযুক্ত উপায়ে জলপথে ঘোরানোর দায়িত্ব নেবে লঞ্চে। সমস্ত পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে অল্পবিস্তর।
রামদা একা মানুষ, থাকেন বিদ্যাধরীর ধারে, ফরেস্ট অফিসের পাশে। উঠোনে টিনের চালের দুটি সেরা ঘর ছেড়ে রেখেছেন অতিথির সেবায়। সঙ্গে পুকুরের জল পাম্পের সাহায্যে তুলে বাথরুমে ব্যবহার, বালতি করে কলের জলের ব্যবহার। খাওয়ার জন্যে উনিশলেরি-বিশলেরি স্টাইলে উল্টানো বোতল হলেও এখানে জল কষাটে নোনতা। আছে যত্নে রান্না করা সুস্বাদু খাবার নিজেদের ঘরে বসে। টাটকা মধু, গড়ান ফলের আচার আর বাগানের ওল। বিদ্যেধরীর অতল জলে চাঁদের চিরাচরিত উপায়ে সুন্দরবন যাওয়ার সুযোগ অনেক থাকলেও এই অচিরাচরিত পথে সুন্দরবন আবিষ্কার কোনও অংশে কম নয়। থাকা-খাওয়া-ঘোরা এবং খাওয়ার টপিংটুকু বাদ দিলে সুন্দরবনের স্বাদ পুরোটাই এখানে আছে। আর সঙ্গে আছে নতুন পথ আবিষ্কারের নেশা। তাই বালিদ্বীপ এই শীতে একটা ‘মাস্ট গো গন্তব্য’ হতেই পারে— সঙ্গে কিন্তু থাকবে একটা পূর্ণিমা।