নাগরিক হতে চাননি কুমুদরঞ্জন

কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জীবনে পড়েছিল গ্রাম জীবনের তুমুল প্রভাব। ছিলেন সহজ-সরল। মাটির মানুষ। পল্লি-প্রিয়তার সঙ্গে তাঁর কবিতায় যুক্ত হয়েছিল বৈষ্ণবভাবনা। ধর্ম নিয়ে লিখলেও, ছিল না ধর্মীয় সংকীর্ণতা। রবীন্দ্র-স্নেহধন্য কবির আজ প্রয়াণদিবস। স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

রবীন্দ্রনাথ তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। দেশের সীমা ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরছেন সারা পৃথিবীতে। সেইসময় বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকজন কবির আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন বিশুদ্ধ রবীন্দ্র-অনুসারী, পাশাপাশি কেউ কেউ হেঁটেছেন স্বতন্ত্র পথে। রবীন্দ্র-ঔজ্জ্বল্যকে মনেপ্রাণে স্বীকার করেই প্রকাশ করেছিলেন নিজস্ব স্বর। এই দ্বিতীয় ধারার কবি ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক। তিনি ছিলেন নিখাদ পল্লিপ্রেমী। গ্রামবাংলার সহজ-সরল জীবন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল তাঁর কবিতায় প্রধান বিষয়। দূরে সরে নয়, তিনি চিরসবুজ গ্রামবাংলার নদী, মাঠ, গাছপালা নিয়ে কবিতা লিখেছেন গ্রামে বসেই। গ্রামের মানুষের বিচিত্র জীবনের কথা লিখেছেন গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রাকে খুব কাছ থেকে দেখেই, গ্রামবাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করেই। অতিথি নয়, পুরোপুরি তাঁদের একজন হয়ে উঠেছিলেন। গ্রামের উর্বর মাটিতেই প্রোথিত করেছিলেন নিজস্ব শিকড়।

আরও পড়ুন-যুবভারতীর বিপুল ক্ষতিতে উঠছে প্রশ্ন, দায় এড়াল ফেডারেশন ও আইএফএ

১৮৮৩ সালের ১ মার্চ কোগ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম কুমুদরঞ্জনের। গ্রামটি বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্গত। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল একই জেলার বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীখণ্ড গ্রামে। বাবা পূর্ণচন্দ্র মল্লিক ছিলেন কাশ্মীর রাজ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মা সুরেশকুমারী দেবী। তাঁদের পূর্বপুরুষ বাংলার নবাবের থেকে মল্লিক উপাধি পান। আসল পদবি সেনশর্মা বা সেনগুপ্ত।
ছাত্র হিসাবে খুবই মেধাবী ছিলেন কুমুদরঞ্জন। ১৯০১ সালে এন্ট্রান্স, ১৯০৩ সালে কলকাতার রিপন কলেজ বা বর্তমানের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে এফএ এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। বঙ্কিমচন্দ্র সুবর্ণপদক পান।
পেশায় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে প্রধান শিক্ষকরূপে অবসর গ্রহণ করেন।
রবীন্দ্র-স্নেহধন্য কুমুদরঞ্জনের কবিত্বশক্তির বিকাশ ঘটেছিল বাল্যকালেই। নদী ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছেন। তাঁর গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে অজয় ও কুনুর। এই গ্রাম আর দুই নদীই ছিল মূল প্রেরণা। তাঁর কবিতায় লেগে থাকত সোঁদা মাটির গন্ধ, ফুটে উঠত ভাঙনধরা নদীর বাঁক বদলের ছবি। সহজেই ছুঁয়ে যেত সববয়সি পাঠকের মন। সৃজনকর্মের মধ্যে দিয়ে পূরণ করেছিলেন ছোটর দাবি। তাঁর কবিতা ছিল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত।
গ্রামজীবনের তুমুল প্রভাব পড়েছিল ব্যক্তি জীবনেও। ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল। নিরহংকারী। মাটির মানুষ। পল্লি-প্রিয়তার সঙ্গে বৈষ্ণবভাবনা যুক্ত হয়েছিল তাঁর কবিতায়। ধর্ম নিয়ে লিখলেও, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না তাঁর মধ্যে। মিশেছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে। তাঁদের জন্য কলম ধরেছেন। উল্লেখ্য, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ছাত্র ছিলেন। যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন কুমুদরঞ্জন, নজরুল ছিলেন সেই বিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রকে বিশেষ স্নেহ করতেন কুমুদরঞ্জন। নজরুলও ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন ছাত্রদরদি শিক্ষককে। নজরুলের কবি হয়ে ওঠার পিছনে কুমুদরঞ্জনের বিশেষ ভূমিকা ছিল। গ্রাম ও দেশ গঠনের বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি নিয়েছিলেন বিশেষ ভূমিকা। বিদ্যা ও জ্ঞানের প্রসারে ছিলেন আগ্রহী।
নিজেকে প্রচারের আলো থেকে দূরে রাখতে পছন্দ করতেন কুমুদরঞ্জন। তা সত্ত্বেও ছড়িয়ে পড়েছিল ফুলের সুবাস। আজীবন নদীতীরবর্তী গ্রামে মাথা উঁচু করে থেকেই জয় করেছিলেন শহরকে। নাগরিক হতে চাননি কোনও দিন। বরং নগরই দুদণ্ড শান্তি লাভের আশায় ছুটে গেছে তাঁর কাছে। তিনি আপন করে নিয়েছেন দুই হাত বাড়িয়ে। নগরজীবন তাঁর কাছে ছিল বনবাস। বহু সম্পাদক-প্রকাশকের সঙ্গেই গড়ে উঠেছিল সুসম্পর্ক। সেই সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা নিয়মিত প্রকাশ পেত।
বেশকিছু কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। তার মধ্যে ‘চুন ও কালি’, ‘বীণা’, ‘বনমল্লিকা’, ‘শতদল’, ‘বনতুলসী’, ‘উজানী’, ‘একতারা’, ‘বীথি’, ‘কাব্যনাট্য দ্বারাবতী’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘নূপুর’, ‘অজয়’, ‘তূণীর’, ‘স্বর্ণসন্ধ্যা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাব্যগ্রন্থগুলোর নাম দেখলেই বোঝা যায় পল্লিপ্রকৃতি, পল্লিজীবন, নদী তাঁর কত প্রিয় ছিল।

আরও পড়ুন-যুবভারতীর বিপুল ক্ষতিতে উঠছে প্রশ্ন, দায় এড়াল ফেডারেশন ও আইএফএ

বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান সাহিত্যতীর্থের ‘তীর্থপতি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন কুমুদরঞ্জন। পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ প্রদান করে। ১৯৭০ সালের ২১ এপ্রিল ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে।
তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ। কবিগুরু বলেছিলেন, ‘কুমুদরঞ্জনের কবিতা পড়লে বাংলার গ্রামের তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলশঙ্খের কথা মনে পড়ে।’
এর থেকে বড় প্রশংসাবাক্য আর কী হতে পারে? রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে এসে কুমুদরঞ্জন লিখেছিলেন, ‘পাদদেশে দাঁড়াইয়া হরিণশিশু যেমন দেবাত্মা হিমালয়কে দেখে আমিও তেমনি রবীন্দ্রনাথকে দেখিতে লাগিলাম। তাহার পর আবার পাদস্পর্শ গ্রহণ করিয়া ফিরছিলাম। রূপলাগি আঁখি ঝুরে গুনে মন ভোর।’ রবীন্দ্রনাথের বিয়োগে তিনি অনুভব করেছেন আত্মবিয়োগের ব্যথা। লিখেছিলেন ‘তর্পণ’।
১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রয়াত হন কুমুদরঞ্জন। কলকাতায়। পুত্রের বাড়িতে। তাঁর বেশকিছু কবিতা আজও বহু পাঠকের মুখে মুখে ফেরে। তবে তাঁকে নিয়ে আরও বেশি চর্চার প্রয়োজন। পল্লিবাংলাকে চেনার জন্য। নিজেদের শিকড়কে জানার জন্য।

Latest article