গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকার আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এবং সে বিষয়ে ভারতের অবস্থান খোলসা করার জন্য সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যথারীতি সেই বৈঠকে হাজির থাকার সময় পাননি। তবে বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর উপস্থিত ছিলেন। তিনিই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ২৬ জন প্রতিনিধির কাছে কার্যত স্বীকার করে নেন মোদি সরকার এখন আফগানিস্তানের ব্যাপারে ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতি নিয়ে চলছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতি কী ভেবেচিন্তে অনুসরণ করা হচ্ছে না কি আর কোনও উপায় নেই বলে এই নীতি নিতে হয়েছে? ২০২১-এর অগাস্টে রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সভাপতির পদ অলংকৃত করার সুযোগ পেয়েছিল ভারত। রোস্টার অনুসারে এরকম একটা সুযোগ রুটিন মাফিক এসেছিল ভারতের কাছে, পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো। ভারত কাজে লাগাতে পারেনি। পারেনি, কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চেয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিল আমাদের সরকার। মোদি্র আমলে আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে, এ ধরনের প্রচার করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের রুটিনমাফিক সভাপতিত্বের বিষয়টিকে তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু ভারতের বিদেশ নীতি যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, কূটনৈতিক অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে ভারতকে যেভাবে আপস করতে হচ্ছে, তাতে আর যাই হোক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মোদি সরকারের বড়াই করা শোভা পায় না। ২ অগাস্ট রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তালিবানদের সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করেছিল। সেই নিরাপত্তা পরিষদই ১৬ অগাস্ট একই ইস্যুতে ঢোক গেলে, আর তার সাম্প্রতিকতম বৈঠকে তো এ নিয়ে তারা মুখে কুলুপ এঁটেছে। ভারতও তালিবানদের মৌলবাদী চিন্তা ধারা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে। তাদের হিংসার পথের সঙ্গে আপস করেছে। তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে ভারতের কোনও অনীহা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
রাষ্ট্র সংঘ বহুদিন ধরে তালিবানদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে আসছে। কদিন আগেও তারা কাতারের দোহায় তালিবানদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল। সেখানে পাকিস্তান, চিন, এমনকি রাশিয়ার প্রতিনিধিরাও হাজির ছিলেন। কিন্তু ভারত সেখানে ডাক পায়নি। আফগানিস্তানের সংঘর্ষ সংঘাতের সঙ্গে ভারতের কোনও সম্পর্ক নেই, শুধু ওই দেশগুলোরই আছে, তা কিন্তু নয়। তালিবান কাবুলে ফিরেছে মানে ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা বেশ বড়সড় চ্যলেঞ্জের মুখে। অথচ, আমাদের বিদেশনীতি এতটাই কার্যকরী, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক দৌত্য এতটাই জোরদার যে দোহার বৈঠকে আমাদের একাটা আসনও জুটল না।
আরও পড়ুন: ত্রিপুরা বিধানসভার স্পিকার পদ থেকে ইস্তফা বিজেপি নেতার
উল্টোদিকে রাশিয়া আর চিন কিন্তু তালিবান শাসিত আফগানিস্তানে তাদের নিজেদের স্বার্থ যাতে রক্ষিত হয়, সে ব্যবস্থা করে ফেলল। আর তালিবানদের পাশে পেয়ে পাকিস্তানের খুশি তো আর ধরছে না। এটা ঠিক কথা যে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের কারণে বাইডেন সমালোচিত হচ্ছেন। কিন্তু এটাও সমান সত্যি যে আচমকা রাতারাতি এই সেনা প্রত্যহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ট্রাম্প এব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত ঢের আগে নিয়ে ফেলেছিলেন। এখন বাইডেন সরকার যেটা করছে সেটা গৃহীত সিদ্ধান্তের রূপায়ণ ছাড়া আর কিছু নয়। এটা আমেরিকার সম্মানহানি হয়ত হল, কিন্তু তাদের স্বার্থ যে কোনওভাবে আহত হল তা কিন্তু নয়।
একইভাবে চিনও তালিবানদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে যে তালিবানরা পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক আন্দোলনে কোনওভাবে মদত দেবে না। বিচ্ছিন্নতাবাদী এই আন্দোলন চিনের নিরাপত্তার প্রশ্নে একটা বড় রকমের বিপদ। তা ছাড়া, আফগানিস্তানে চিনের বিনিয়োগের পরিমাণও বড় কম নয়। আফগানিস্তানের মাটিতে চিনের যাবতীয় পরিকাঠামো ও বিনিয়োগ যে বিপন্ন হবে না, সে ব্যাপারে চিন আগেভাগেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে রেখেছে।
বিগত দুই দশকে ভারতও আফগানিস্তানের বুকে পরিকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে। পাকিস্তানের ঘাঁটি গাড়া জঙ্গিরা তলিবানদের মদত পেয়ে কাশ্মীরে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। অর্থ্যাৎ, চিন রাশিয়ার চেয়ে আফগানিস্তান নিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষার গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়।
ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে, বিবিধের মাঝে মহান মিলনের সুর চিনে নেওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে তালিবানের মতো একটা চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান আদৌ স্বস্তিদায়ক বিষয় নয়। তালিবদের এই উত্থান গত দুদশকে আফগান সমাজে গড়ে ওঠা মূল্যবোধগুলিকে চুরমার করে দেবে। প্রগতির পথে তার অগ্রগমন রুখে দেবে। যে দেশে শাসন কর্তৃপক্ষ নারী শিক্ষাকে সরকারের পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করে, সে দেশে যে নারীর ক্ষমতায়ন দূরগত স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরকম একটা অবস্থায় আমরা আমাদের বিদেশ নীতি ও কূটনৈতিক অবস্থানে যে দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতা আশা করেছিলাম, তা একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। আফগানিস্তানের মাটি ছাড়তে আমরা এমন ব্যস্ত ছিলাম যে আমরাই হলাম সেই দেশ কাবুলে যাদের দুতাবাস প্রথম বন্ধ হয়। দেশের লোকজনকে ফেলে আসার পাশাপাশি যে সমস্ত আফগানবাসী তালিবান নন বলে আমাদের কাছ থেকে সাহায্য প্রত্যাশা করেছিলাম, তাদেরও আমরা বের করে আনতে পারিনি। ভাগ্য ভাল যে তালিবানদের স্বেচ্ছায় সহায়তা প্রদান আর আমেরিকার তৎপরতার সুবাদে আমারা অনেক ভারতীয়কে দেশে ফেরাতে পেরেছি। আর এসবের মধ্যেই এস জয়শঙ্কর সাফাই গাইছেন, ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ করা ছাড়া আমাদের আর কিস্যুটি করার নেই।
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই ‘সরকার’!