ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই সিপিএম নানাভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চাপে ফেলার চেষ্টা করেছে। তার জন্য নীতি বিসর্জন দিয়ে কখনও কংগ্রেসের, কখনও আইএসএফের হাত ধরতে কুণ্ঠা করেনি। তবে, তাতে কোনও লাভ হয়নি। এবার অতিবাম সিপিআই(এমএল)-এর হাত ধরেছে। তাতেই স্পষ্ট, গদিতে বসার ছটফটানি বিন্দুমাত্র কমেনি, উল্টে আরও তীব্র হয়েছে।
আরও পড়ুন-ভুয়ো বোমার হুমকি নিয়ে কেন্দ্রের সতর্কতা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিকে
২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ শমীক লাহিড়ী দলীয় মুখপত্রে লিখেছিলেন, ‘দম ধরে রাখতে হবে, খেলা ঘুরছে।’ খেলা ঘোরানোর একটাই ফর্মুলা ছিল, রামে যাওয়া ভোট বামে ফেরানো। তার জন্য দরকার ছিল বিজেপি- বিরোধী আক্রমণ তীব্র করা। কিন্তু সিপিএম সে রাস্তায় না হেঁটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লাগাতার আক্রমণ করে বিজেপিরই সুবিধে করে দিয়েছে। ফলে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের পর দেখা গেল, শূন্য আছে শূন্যেই। অবস্থান্তর হয়নি। বরং জোট সঙ্গীর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
ইতিহাস বলছে, সিপিএম যখনই কোণঠাসা হয়েছে, তখনই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যাকে প্রয়োজন মনে করেছে, তার সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে। নীতিনৈতিকতার ধার ধারেনি। ১৯৯৮ সালে ‘গণরোষে’র জেরে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকার দাপুটে সিপিএম নেতারা গ্রামছাড়া হয়েছিলেন। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও গ্রামের দখল ফিরিয়ে দিতে পারেনি। শেষপর্যন্ত ২০০০ সালে মাওবাদী ও পুলিসের যৌথ প্রচেষ্টায় গ্রামের দখল নিয়েছিল সিপিএম। শর্ত ছিল, গড়বেতার সন্ধিপুর অঞ্চলে নকশালদের সংগঠন করতে দেবে সিপিএম। যদিও সেই শর্ত পরে সিপিএম মানেনি। তার জন্য উভয়ের সম্পর্কের চরম অবনতি হয় এবং লোকে বলে এটাই জঙ্গলমহল অশান্ত হওয়ার কারণ।
আরও পড়ুন-ঘরের মাঠে শুরু হল পাওয়ার-প্লে, মহারাষ্ট্রের ভোটে সম্মানরক্ষার লড়াই
সত্যি কথা বলতে কী, এইবারে ছ’টি বিধানসভার আসনে উপনির্বাচনে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি হল কি না, তা যাচাইয়ের একটা সুযোগ বামেদের সামনে এসেছিল। কিন্তু সিপিএম চ্যালেঞ্জটা নিল না। উল্টে সিপিআই (এমএল)-এর সঙ্গে জোট করে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলল।
এবার সিপিএম ফের কংগ্রেসের হাত ধরে ২০২৬-এ শূন্যের গেরো কাটাতে চাইলে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার অবশিষ্টটুকুও থাকবে না। অর্থাৎ, বাস্তব অবস্থা না বুঝে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টাইট দিতে গিয়ে সিপিএম নিজেদের সর্বনাশের রাস্তাটা নিজেরাই তৈরি করে দিল।
বাকি রইল বিজেপি। বঙ্গ রাজনীতিতে একটি অপ্রাসঙ্গিক দল। ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ তারা নেওয়ার পাত্র নয়। তাই চারদিক থেকে ছক কষে মাঝে মাঝেই সুকৌশলে প্রসঙ্গটি উসকে দেওয়া হয়। সেই ছকেই আবারও দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে জলঘোলা শুরু হয়েছে। এবং আবারও সুপ্রিম কোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ। আসলে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি মুছে ফেলতে সংবিধানেরই একটি সংশোধনীকে হাতিয়ার করেছে বিজেপি ও তার ছায়াসঙ্গীরা। কী সেই সংশোধনী? ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্র শব্দ দুটি ঢোকানো হয়। সংশোধনী নিয়েই বিজেপির বিদ্বেষ প্রচার প্রায় প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গৃহীত সংবিধানের প্রস্তাবনায় শব্দ দুটি ছিল না, তাই তা বাতিল করার দাবি জানিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে। হিন্দুরাষ্ট্রের ভাবনার তাঁবেদারদের যুক্তি হল, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্র সংবিধান প্রণেতাদের ভাবনার পরিপন্থী। শুনানিতে এক আইনজীবী দাবি করেন, বাবাসাহেব আম্বেদকর মনে করতেন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে সমাজতন্ত্র। আদালতে বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী আবেদন করেন, প্রস্তাবনায় এই সংশোধন করা যায় না। তাই তিনি চান, এটা বাতিল ঘোষণা করুক শীর্ষ আদালত। তাঁর বিকল্প প্রস্তাব হল, বাতিল না করলেও প্রস্তাবনায় দুটো অংশ থাকা উচিত। একটি তারিখ ছাড়া, আর একটা তারিখ-সহ।
আরও পড়ুন-ট্রাম্পের বিরোধিতা করে চিঠি ৮২ নোবেলজয়ীর
পরপর আদালতে ধাক্কা খেয়েও সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে মেনে নিতে পারছে না মোদিবাহিনী। হিন্দুরাষ্ট্রের প্রচার এখন আড়ালে আবডালে নয়, সোচ্চারে ঘোষিত হচ্ছে। ঘটনা হল, কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠেয় লোকসভা ভোটে কোনওরকমে গদি বাঁচানোর পর ফের এই হিন্দুত্বকেই আঁকড়ে ধরে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বিজেপি ও তাদের মেন্টর আরএসএস। তাদের নেতৃত্বের ধারণা হয়েছে, লোকসভা নির্বাচনে সব হিন্দুদের ভোট না মেলায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি। অতএব পুরনো লাইন মেনে হিন্দুদের এককাট্টা করাই নাকি এক ও একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। মোদি-অমিত শাহদের এই টোটকাই দিয়েছেন নাগপুরের কর্তারা। ঠিক হয়েছে, আসন্ন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় উপনির্বাচন এবং মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ড বিধানসভার ভোট প্রচারে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকেই সামনে আনা হবে। বিচারপতিরা তাঁদের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ এবং অপরিবর্তনীয়। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে যে অধিকারগুলির কথা বলা আছে তাতেই পরিষ্কার যে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য হিসাবেই দেখা হয়েছে। আর সমাজতন্ত্র শব্দটির অর্থ হিসেবে সুযোগ ও সম্পদের সাম্যও বোঝানো হয়। অতীতে সুপ্রিম কোর্ট এমন বহু আইন ও বিধি বাতিল করে দিয়েছে যা ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী। মামলাকারীদের উদ্দেশে একজন বিচারপতির সরাসরি প্রশ্ন ছিল, আপনারা কি চান না ভারত ধর্মনিরপেক্ষ থাক? আসলে ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে কোনও ধোঁয়াশা থাকার কারণই নেই। কারণ মূল সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ নম্বর ধারাতেই নাগরিকদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের ধর্ম থেকে দূরত্ব মেনে চলার কথা স্পষ্ট করে বলা আছে। ১৯৭৬ সালের সংশোধনীতে এ-কথাই আরও স্পষ্ট উচ্চারণে বলা হয়েছে। আসলে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা হল, এদেশে সকলের নিজের ধর্ম গ্রহণ ও প্রচারের সমান অধিকার রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনও ধর্ম থাকবে না। শুধু এই মামলাই নয়, কয়েক বছর আগে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তার যুগান্তকারী রায়ে বলেছিল, সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তনের অধিকার নেই সংসদের। পরে একাধিক মামলায় একই কথা শোনা গিয়েছে আদালতের মুখে। এর থেকে কী বোঝা গেল? সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, সুপ্রিম কোর্টের রায়— এসব তাঁদের কাছে গৌণ, আসল সত্য ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রকে অস্বীকার করে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। যদিও শত চেষ্টা করেও এতদিন তা সফল হয়নি। তাই আগামী দিনে ফের স্বপ্নপূরণের চেষ্টা হবে। এই উপনির্বাচনেও হবে। পশ্চিমবঙ্গে। এবং সেই প্রচারও যে মুখ থুবড়ে পড়বে, সেই আন্দাজ এখনই করা যাচ্ছে।