‘রাত দখল’ হইল। ‘উৎসবে ফিরছি না’ ‘ট্রেন্ড’ হইল। ‘দ্রোহের কার্নিভাল’ হইল। কয়েকদিন আগেই ফের ‘দ্রোহের আলো’ ইত্যাদি হইল। এতকিছু হওয়ার পরে, হাতে রইল পেন্সিল? নাকি খাতা খুলবে? লক্ষণীয় বিষয় হল, কখন যেন রাজ্যে একটি অকাল নির্বাচন এসে হাজির হয়েছে, সেদিকে বিরোধীরা নজরই দেয়নি। এবং এখন অবধি যা পরিস্থিতি তাতে আসন্ন ৬টি উপনির্বাচনের ৬টি-তেই তৃণমূলের জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা।
গত অগাস্টে কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ঘটে যাওয়া একটি নারকীয় ঘটনা এবং তার প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে যে প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল তা ছিল জনতার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে পথে নেমেছিলেন। এরপর গঙ্গা থেকে ভোলগা অনেক জল গড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক গতিপথে বাঁক নিয়েছে আন্দোলন। খবরের কাগজ মিডিয়ার শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে দুয়েকটি নাম। তিলোত্তমার বিচারের চেয়ে ব্যক্তিপ্রচার বহু ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। এর মধ্যেই অকাল-নির্বাচন। ৬টি কেন্দ্রের নির্বাচনের ফলাফল দেখে নিশ্চয়ই গোটা রাজ্যের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝা যায় না। আবার ১-২টি নয় ছ-ছটি কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল খানিকটা তো আভাস দেয় বইকি! রাজনীতির ছাত্র হিসেবে এই হিসেবগুলো মেলানো জরুরি। অন্তত মানুষ কী ভাবছে, তাঁর একটা ধারণা তৈরি হয়। ছটি কেন্দ্র রাজ্যের সম্পূর্ণ ভিন্ন তিনটি অংশের। সেখানে জাতিগত, ভাষাগত এবং নাগরিকদের পছন্দ-অপছন্দও ভিন্ন। উত্তরের সিতাই, মাদারিহাট। জঙ্গলমহলের জেলা বাঁকুড়ার তালডাংরা, মেদিনীপুর। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া। এবং উত্তর ২৪ পরগনারই কলকাতা সংলগ্ন নৈহাটি।
কোচবিহারের সিতাই আসনটি বরাবারই তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি। নজর থাকবে মাদারিহাট আসনটির ওপর। স্থানীয় বিভিন্ন উপজাতি বিশেষত, টোটো উপজাতিদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যা যা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করেছেন তাতে এই উপজাতি জনগোষ্ঠীর ভোট এবার তৃণমূলের পক্ষে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এছাড়াও স্থানীয় স্তরে বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্ব, চা-বাগান শ্রমিকদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণে স্থানীয় ভোটাররা বিজেপির ওপর বিরক্ত! এছাড়া বাঁকুড়ার তালডাংরা ও মেদিনীপুর আসনদুটিতেও বিরোধীরা প্রায় নেই। একটা সময় অবধি রাজনৈতিক মহলে খবর ছিল, এক প্রাক্তন রাজ্য বিজেপি সভাপতি নাকি মেদিনীপুরে দাঁড়াবেন। কিন্তু রাজ্য বিজেপির অন্দরে কান পাতলেই শোনা যায়, বিজেপির বর্তমান রাজ্য নেতৃত্ব সেই ‘প্রাক্তনে’র কেরিয়ার শেষ করার জন্য এতটাই মরিয়া যে উপনির্বাচনের প্রার্থীটুকুও হতে পারেননি সেই বেচারা।
এ ছাড়া উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া এবং নৈহাটি। হাড়োয়া আসনের ফলাফল অনেকগুলি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই আসনটি সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত একটি আসন। বসিরহাট লোকসভার অন্তর্গত। সেই বসিরহাট লোকসভা যার মধ্যে সন্দেশখালি অন্তর্ভুক্ত। (উল্লেখ করা দরকার, এই বসিরহাট লোকসভাতেও খুব সম্প্রতি ফের উপনির্বাচন হবে, এই কেন্দ্রের সাংসদ হাজি নুরুল ইসলামের অকালপ্রয়াণের ফলে।) সন্দেশখালিতে গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে তৃণমূল কংগ্রেস সামান্য ব্যবধানে পিছিয়ে ছিল। যদিও হাড়োয়াতে বিপুল লিড পেয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী অধুনা প্রয়াত হাজি সাহেব। গত অগাস্ট থেকে বাম অতি-বাম এবং বিজেপির অশুভ আঁতাত রাজ্য জুড়ে যে অরাজকতা তৈরির চেষ্টা করেছে। বারবার করে সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যে রটনা রটিয়েছে এই গোটা প্রক্রিয়াটা চলেছে কলকাতা এবং সংলগ্ন শহরাঞ্চলে। বাংলার বৃহত্তর গ্রামীণ এলাকার মানুষজনের মধ্যে এই আন্দোলনের খুব একটা প্রভাব দেখা যায়নি। এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হল, এই গোটা ঘটনাক্রমে বাংলার সংখ্যালঘু সমাজ ছিল সম্পূর্ণ নীরব। হাড়োয়ার মতো একটি গ্রামীণ বিধানসভার ফলাফল আরও স্পষ্ট করবে, যে অগাস্ট থেকে কলকাতার শহুরে ভদ্র বাবু-বিবিরা যে ‘দাবি এক দফা এক’-এর স্লোগান দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুন্ডুপাত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালালেন, তাতে গ্রাম-বাংলা কতটা কর্ণপাত করল? আপাতদৃষ্টিতে এটুকু বলা যায় এই নাগরিক আন্দোলনের নামে প্রহসন গ্রাম তো দূরের কথা শহরেরই প্রান্তিক শ্রেণির মানুষকে ছুঁতে পারেনি। এ আন্দোলন রয়ে গেছে কলকাতার এলিট শ্রেণির ‘উইকএন্ড ইভেন্ট’ হয়ে!
আরও পড়ুন- ট্যাবের টাকা উধাও, তদন্তের নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর
এবং নৈহাটি। নৈহাটি এবার সব দিক থেকে একটা ব্যতিক্রমী ভূমিকা নিয়েছে। যে সিপিআইএমএল লিবারেশনকে কয়েকবছর আগেও সিপিআইএমের নেতা কর্মীরা ‘লেসার এভিল’ ইত্যাদি বলে খিল্লি করত, সেই লিবারেশনকেই আসনটি ছেড়ে দিয়ে বৃহত্তর বাম ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন বামফ্রন্ট নেতৃত্ব! দীর্ঘ কয়েক দশক বাদে ফের রাজ্যে লিবারেশন এবং বামফ্রন্টের জোট একটা ঐতিহাসিক ঘটনাই বটে! যদিও সিপিএমের এই আত্মত্যাগ কতটা ২০২৬-এর আগে বৃহত্তর বাম ঐক্য দেখানোর জন্য আর কতটা জামানত জব্দ হওয়া বাঁচানোর স্বার্থে তা বিলক্ষণ জানেন রাজনীতির কারবারিরা। নইলে ৬টি উপনির্বাচনের মধ্যে মাত্র ১টিতে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাকি আসনগুলি শরিক দলদের ছেড়ে দিচ্ছে বামফ্রন্টের ‘বড় ভাই’ সিপিএম, এমন ঘটনা রাজ্য-রাজনীতিতে শেষ কবে ঘটেছে রাজনৈতিক পণ্ডিতরাও মনে করতে পারছেন না। আসলে, টিভি পর্দায় বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বড় বড় শব্দচয়ন করে বাজার গরম করা ঠিক যতটা সহজ, ভোট ময়দানে রাজনীতির অঙ্কটা ততটাই কঠিন! তাই কয়েকটি গণমাধ্যমে যাদের ‘অগ্নিকুণ্ড’, ‘অগ্নিশলাকা’ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করুক, জনতার আদালতে বারবার হারতে কাদেরই বা ভাল লাগে? তাই বৃহত্তর বাম ঐক্য বলে অতি-বাম এবং লেসার এভিলদের সাথেও জোট করতে দু-বার ভাবছে না সিপিএম। মাঝখান থেকে এই জোট ছেড়ে বেরিয়ে গেছে কংগ্রেস!
অতএব ৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের আগের নির্বাচনগুলির ফলাফলের দিকে যদি দেখা যায়, মাদারিহাট ছাড়া প্রত্যেকটিতে ২১-এর বিধানসভা নির্বাচন এবং ২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী তৃণমূল এগিয়ে। বামেরা সব ক’টিতেই তৃতীয় স্থানে রয়েছে। একমাত্র হাড়োয়া ছাড়া। এবার দেখা যাক, বাম বা তাদের জোট সঙ্গীরা গত বিধানসভায় এই আসনগুলিতে কত শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।
নৈহাটি : সিপিএম ১০%
তালডাংরা : সিপিএম ১১.৬%
মেদিনীপুর : সিপিআই ৫.৪৩%
মাদারিহাট : আরএসপি ৪.২৪%
সিতাই ও হাড়োয়াকে এই তালিকা থেকে বাদ রাখা হল। বলে রাখা ভাল, একমাত্র হাড়োয়ায় আইএসএফ প্রার্থী ছাড়া একুশের নির্বাচনে প্রত্যেকটি আসনে সিপিএম এবং তাদের জোট সঙ্গী প্রার্থীদের জামানত জব্দ হয়েছে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনেও এই সংশ্লিষ্ট বিধানসভাগুলিতে সিপিএম এবং তাদের জোট সঙ্গীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে! গত কয়েক মাসে আমরা দেখেছি, সামাজিক মাধ্যমে সিপিএম বিপুল তরঙ্গ তুলেছে! এমন একটা ভাব যেন, অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গড়া সময়ের অপেক্ষা! যেন, অগ্নিপক্ষী মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেনই। সিপিএমের একেকজন তরুণ নেতা-নেত্রীদের ‘রিলস’ ছড়িয়েছে। এমতাবস্থায় আসন্ন উপনির্বাচনে আসন জেতা তো দূরের কথা একুশের যে প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ছিল তার থেকে সামান্য কিছু শতাংশও ভোট কি বাড়াতে পারবে সিপিএম বা তাদের জোটসঙ্গীরা? জামানত বাঁচবে অন্তত? এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন! নইলে কিন্তু সেই অশ্বডিম্বই প্রসব হবে! রাজনীতিতে কিন্তু শেষ কথা বলে সংখ্যাই! সে যতই মুখে বলুন ‘উৎসবে ফিরব না’। গণতন্ত্রের উৎসবে বারবার মুখ পুড়লে কিন্তু নিজেদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে!