আশিস গুপ্ত: বিজেপি আর ভুয়ো প্রচার কার্যত সমার্থক। ফের তা প্রমাণিত হল। ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে দেশজোড়া ক্ষোভের মুখে বিজেপির লোকসভার দুই সাংসদ সম্বিত পাত্র ও সাংসদ নিশিকান্ত দুবে দাবি করেছিলেন, ইসলামিক দেশগুলিতে, বিশেষ করে তুরস্কে, কোনও ওয়াকফ ব্যবস্থাই নেই। তাঁরা সংসদে ওয়াকফ বিল নিয়ে বিতর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পেশ করেছিলেন।
বিজেপি নেতাদের মিথ্যাচারের বিপরীতে বাস্তবতা কী? তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার ওয়াকফ ওয়ার্কস মিউজিয়াম বা জাদুঘর ও তুরস্ক সরকারের ফাউন্ডেশন বিষয়ক মহাপরিচালক দপ্তর বিজেপির দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ করল। তুর্কি ভাষায় ‘Vakıf’ মানে হল ওয়াকফ, আর তা ইংরেজিতে অনুবাদ করে হয় foundation, কারণ এটি একটি নিবন্ধিত জনহিতকর সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যা ওয়াকফের সম্পদ পরিচালনা করে। ভারতে নতুন ওয়াকফ সংশোধনী বিলকে কেন্দ্র করে যখন রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং বিভ্রান্তি বাড়ছে, ঠিক তখন তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় মেলিকে হাতুন মসজিদের পাশে অবস্থিত ওয়াকফ ওয়ার্কস মিউজিয়াম দেখিয়ে দেয়, তুরস্কে ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানসমূহ শুধুমাত্র টিঁকে আছে তাই নয়, বরং রাষ্ট্রের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবেই তা কাজ করছে। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত তুরস্কের এই জাদুঘর ২০০৯ সালে ইউরোপীয় মিউজিয়াম ফোরামের স্বীকৃতি পেয়েছে। এখানে সংরক্ষিত আছে অটোমান যুগের কার্পেট, প্রাচীন পান্ডুলিপি, ক্যালিগ্রাফি এবং কাবার দুটি ঐতিহাসিক ‘সিতারে’ (আবরণ)। এই নিদর্শনগুলি কেবল ধর্মীয় নয়, বরং ওয়াকফের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ, শিক্ষা ও দানের ধারার এক জীবন্ত ইতিহাস তুলে ধরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অটোমান সাম্রাজ্যের সময়কালীন ওয়াকফের দুটি প্রধান ধরন ছিল ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ওয়াকফ এবং ‘ইরসাদি’ ওয়াকফ, যেগুলি রাষ্ট্রীয় অর্থে সৃষ্ট।
আরও পড়ুন-৩৫টি ফিক্সড ডোজ কম্বিনেশন ওষুধ দেশে নিষিদ্ধ করল কেন্দ্র
বর্তমানে তুরস্কে পাঁচ ধরনের ওয়াকফ কার্যক্রম রয়েছে। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে নিবন্ধিত ৫২,০০০-এর বেশি ‘মাজবুত’ (সরকার পরিচালিত) ওয়াকফ রয়েছে। তুরস্কে এইসব ওয়াকফের আয় আসে সম্পত্তি ভাড়া থেকে। যা দান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাদ্য বিতরণে ব্যবহৃত হয়। অনেক ওয়াকফ এখনও পরিবার দ্বারা পরিচালিত হয়, আবার কিছু সংস্থা ও ব্যাংকও গঠিত হয়েছে ওয়াকফের অর্থে। যেমন ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ভাক্ফ’ বা ‘ওয়াকফ’ ব্যাংক। তাছাড়াও ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের সময় সংগৃহীত অর্থ দিয়েই আংশিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইশ ব্যাংকাসি’, যা দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধনের প্রতীক। তুরস্কে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওয়াকফ যেমন গ্রিক অর্থোডক্স, আর্মেনিয়ান, ইহুদি এবং ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিও রাষ্ট্রীয় রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে স্বীকৃত এবং সক্রিয়।
ভারতের সংসদে পেশ করা ওয়াকফ সংশোধনী বিল এদেশে যখন তীব্র বিতর্ক তৈরি করছে তখন লোকসভায় বিজেপি সাংসদদের মিথ্যা দাবিকে সরকারি প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোও নির্লজ্জভাবে প্রচার করেছে। যদিও পরে রাজ্যসভায় বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তুরস্ক ১৯২৪ সালে ওয়াকফ ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিলেও তা আদৌ বিলুপ্ত হয়নি। কিন্তু এই ঘটনা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টায় বিদেশের নাম করে খোদ আইনসভায় দাঁড়িয়ে মিথ্যা প্রচারেও লজ্জা নেই ভারতীয় জনতা পার্টির।