ধর্মীয় বিভাজন বাড়াতে এবার হাতিয়ার ওয়াকফ

ওয়াকফ আইন নিয়ে এত তাড়াহুড়ো কেন? আমাদের আপত্তির কারণটাই বা কী? এই আইনের সংশোধনী আটকাতে তৃণমূল কংগ্রেস কেন রাজপথে? পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন ড. মইনুল হাসান

Must read

লোকসভায় ৮ অগাস্ট ২টি বিল পেশ করা হয়। একটি ওয়াকফ (সংশোধন) বিল ২০২৪, অন্যটি মুসলমান ওয়াকফ (প্রত্যাহার) বিল ২০২৪, সংশোধনী বিলটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিরোধী দলগুলি খুবই সন্দিহান ছিলেন। তাঁরা প্রথমে বলেন কেন এই সংশোধনী বিল আনা হচ্ছে? তারপর সরকারকে বাধ্য করেন বিলটিকে যুগ্ম সংসদীয় কমিটিতে পাঠাতে। যেখানে প্রায় সব দলের সদস্য আছেন। এই কমিটির সভাতেও উত্তপ্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আমাদের দলের সাংসদরা এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করেন। বিজেপি একা এই বিলকে আইনে পরিণত করতে চায়। কেন? একটু গোড়ার কথা বলা যাক।
ওয়াকফ (Waqf) সম্পর্কে সকলের ধারণা কম। খুব স্বাভাবিক। কোনও ব্যক্তি তার বৈধ সম্পত্তি ধর্মীয় কাজের ব্যবহারে ও অন্যান্য শুভ সামাজিক কাজে আল্লার নামে উৎসর্গ করলে সেটা ‘ওয়াকফ’। এই সম্পত্তির গ্রহীতা আল্লাহ। সুতরাং ফেরত নেবার কোনও সুযোগ নেই। একবার ওয়াকফ মানে চিরদিন ওয়াকফ। ওয়াকফের ২/৩ রকমের ভাগ বা রকমফের আছে। কোনটা পুরো ধর্মীয় কাজে ব্যয় হবে। কোনটা ধর্মীয় ও কিছুটা পরিবার এমন ধারা। এই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করবেন একজন মোতয়ালি। তাকে ঠিক করবেন ওয়াকফ বোর্ড।
ওয়াকফ (Waqf) ব্যাপারটা বহু পুরাতন। পবিত্র কোরানে ওয়াকফ নিয়ে কোনও কথা নেই। কিন্তু অন্তত ২০ জায়গায় দান করার কথা বলা হয়েছে। একবার হজরত আবু বকর কিছু সম্পত্তি উর্পাজন করেন। তিনি সেটা হজরত মহম্মদ (সা.)-কে দিতে চান। তিনি তো আবুবকরের জামাইত। হজরত মহম্মদ (সা.) বলেন তাঁর এটা দরকার নেই। তিনি যেন সবার কাজে লাগে এমনভাবে এটা উৎসর্গ করেন আল্লাহর নামে। এটাই ওয়াকফ। আমাদের দেশে দিল্লির সুলতানি শাসনের সময় থেকে এটা চালু আছে। সুলতান মইজুদ্দিন সুলতানের জামা মসজিদ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ২টি গ্রাম ওয়াকফ করেন মসজিদের নামে। সুলতানী আমলে ভারতে ওয়াকফ সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে মামলা হয়। তা প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গড়ায়। ৪ জন সাহেব জজ মামলা শোনেন এবং ওয়াকফ বাতিল ঘোষণা করেন। ভারত সেটা গ্রহণ করেনি। ১৯১৩ সালে মুসলমান ওয়াকফ আইন তৈরি হয়। ওয়াকফ সম্পত্তি যাতে ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়। মুসলমানদের সার্বিক উন্নয়নে ব্যবহার করা হয় তার জন্য মাঝে মাঝে ওয়াকফ আইন পাল্টানো হয়েছে। ১৯৫৪, ১৯৯৫, ২০১৩ এবং ২০২৩ সালে। প্রত্যেকটি পরিবর্তনে মুসলমানরা খুশি হয়েছে। মূলত ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন মান্য হয়। সেটা পরিরর্তন করা হচ্ছে ২০২৪ সালে। মোট ৪৪টা সংশোধনী আনা হয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি সমর্থন যোগ্য। কয়েকটি ইতোমধ্যে পুরোনো আইন আছে। বেশিরভাগ সংশোধনী শুধু মুসলমানদের আঘাত করবে তাই না, দেশের গণতন্ত্র ও বন্ধুত্ববাদের উপর চরম আঘাত আসবে।

আরও পড়ুন- স্ট্যাটিস ডার্মাটাইটিস

ওয়াকফ (Waqf) মুখে ঘোষণা করেও করা হয় আবার দলিল তৈরি করেও। যিনি ওয়াকফ করবেন তিনি ওয়াকিফ। বৈধ সম্পত্তি হতে হবে। নতুন সংশোধনীতে সেটা উল্লেখ করা হয়েছে। কোন প্রয়োজন ছিল। ওয়াকফ ৪টি মাত্র শব্দ। কেন এই সংশোধনী বিল আনা হচ্ছে তার জন্য ৫০টি শব্দ ব্যয় করা হয়েছে। নতুন কথা হচ্ছে যোগ্যতা বাড়ানো। কিন্তু শুধু নাম পাল্টে তা সম্ভব নয়।
মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনের সঙ্গে ওয়াকফ যুক্ত আছে। আবার ধর্মের স্বাধীনতা ও ধর্মস্থান রক্ষণাবেক্ষণ ও ধর্ম প্রচার ধর্মস্থান রক্ষা যে কোনও সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার। যেভাবে ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪ আনা হয়েছে এবং আইনে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে তাতে সংবিধানের একাধিক ধারাকে উপেক্ষা করা হবে। সেই অর্থে একটি অসাংবিধানিক বিল আনা হয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে যে-সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম মসজিদ, দরগা, ইদগাহ, কবরস্থান, খানতা, ইমামবাড়া, মকবরা, আঞ্জুমান ইত্যাদি। তাছাড়া ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। শিক্ষা উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। শিক্ষা প্রসারে উৎসাহ দানে স্টাইপেন্ড বা স্কলারশিপ দেওয়া হয়। রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলি এমন পরিকল্পনা নেন। প্রত্যেকটা রাজ্যেই ওয়াকফ বোর্ড পরিচালনার আইন ও কার্যাবলি আছে। যা কেন্দ্রীয় ওয়াকফ আইন ১৯৯৫-র সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৯৩৬ সালে বাংলায় প্রথম ওয়াকফ আইন তৈরি হয়। তার প্রভাব কোনও কেন্দ্রীয় ওয়াকফ আইনের উপর আছে। সারা দেশে মোট ৩২টি ওয়াকফ বোর্ড আছে।

একটি অসত্য প্রচার সরকারের পক্ষ থেকে নির্বিচারে করা হচ্ছে যে দেশে প্রতিরক্ষা ও রেলের পরে সব চাইতে বেশি সম্পত্তির মালিক ওয়াকফ বোর্ডগুলি। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী ভারতে ৮.৭ লক্ষ স্থাবর ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। ভারত সারা বিশ্বের মধ্যে সব চাইতে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তির দেশ। ২০২৬ সালে সাচার কমিটির হিসাব মতে এই সম্পত্তির মূল্য ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। সম্পত্তি কিন্তু ওয়াকফ বোর্ডের নয়। সম্পত্তি আল্লাহর। ওয়াকফ বোর্ড দেখাশোনা করার দায়িত্বে। ২০০৫ সালে সম্পত্তিগুলি ডিজিটাইজ করার ব্যবস্থা হয়। ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত মাত্র ৪২ শতাংশ হয়েছে। সাড়ে তিন লক্ষের কিছু বেশি। দেখা গেছে ৫৮৮৭৮টি সম্পত্তি বেদখল আছে। নতুন বিলের ৩(বি)(১)-এ ৬ মাসের মধ্যে পুরো ডিজিটাইজ করার কথা বলা হয়েছে। হলে ভাল। তিনটি রাজ্যের হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির পরিমাণ বলছি। তামিলনাড়ু ৪৭,৮০০ একর। অন্ধ্রপ্রদেশ ৪,৬৫,০০০ একর। তেলেঙ্গানা ৮৭,২১৫ একর। মাত্র ৩টে রাজ্যেই এই অবস্থা। বাকি দেশের খবর নিলে কত হবে? প্রকৃত অর্থে ওয়াকফ সম্পর্কে মানুষের ভুল ও খারাপ ধারণা করার জন্য এটা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওয়াকফ সম্পত্তির কোনও গ্রহণযোগ্য দলিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। যা বলা হচ্ছে তা সাচার কমিটির রির্পোট থেকে অথবা প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর তথ্য থেকে।
আর একটি অসত্য কথা প্রচার করা হচ্ছে মানুষের মধ্যে বুল বোঝাবুঝি বাড়িয়ে দেবার জন্য। যা বিজেপি’র বরাবরের কৌশল। ওয়াকফ বোর্ড যে কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে সহজেই ঘোষণা করে দিতে পারে। এটা একেবারেই সত্য নয়। সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি বৈধ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি। যা আল্লাহর নামে মানুষের সেবার জন্য দান করা হয়েছে। এই বিলের ৩এ ধারায় কারও বৈধ সম্পত্তিই ওয়াকফ করা যাবে বলা হয়েছে। অধিকন্তু ন দশায়! ইসলামের এটাই নির্দেশ। এই বিলে অযথা বাড়তি কথা বলা হয়েছে। ৩ (আর)(৪)-এ বলা হচ্ছে বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা ও এতিমদের সাহ্য করতে হবে ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে। ইতোমধ্যেই পুরোনো ১৯৯৫-র আইনে বলা আছে মুসলমান আইন অনুযায়ী এই সব অংশের জন্য ইতিবাচক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(এরপর আগামীকাল)

Latest article