শীতের শহরে সাহিত্যের উষ্ণ ছোঁয়া

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত ‘সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা’। আজ শেষ দিন। মনন চিন্তন কল্পনার এই উৎসব প্রাণসঞ্চার ঘটিয়েছে লেখক-পাঠকদের মনে। উৎসব-প্রাঙ্গণ ঘুরে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

শিলিগুড়ির কবিকে জড়িয়ে ধরলেন পুরুলিয়ার সম্পাদক। প্রায় এক বছর পর দেখা। মুখে হাসি। কথার পিঠে কথা। জুটে গেলেন আরও কয়েকজন। অন্যান্য জেলার লেখক-সম্পাদক। জমে উঠল আড্ডা। উঠল চায়ের তুফান। এইভাবেই কেউ পরিচিত হচ্ছেন প্রথমবার। কেউ ঝালিয়ে নিচ্ছেন পুরনো সম্পর্ক। সেইসঙ্গে হচ্ছে বই-পত্রিকার হাতবদল। জন্ম নিচ্ছে টুকরো টুকরো আড্ডার আন্তরিক মুহূর্ত।
উপলক্ষ ‘সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা ২০২৩’। যা নিয়ে এই মুহূর্তে সরগরম কলকাতার রবীন্দ্রসদন-নন্দন প্রাঙ্গণ। এটাই বাংলা ভাষার বৃহত্তম সাহিত্যপার্বণ। আয়োজনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।
১১ জানুয়ারি একতারা মুক্তমঞ্চে পাঁচ দিনের উৎসবের উদ্বোধন করেন কবি দেবদাস আচার্য এবং কথাকার অমর মিত্র। দুজনেই উৎসবের সাফল্য কামনা করেছেন।

আরও পড়ুন-ফাইনালে ভাঙচুর, মেসিদের বিরুদ্ধে তদন্ত

সূচনা-মুহূর্তে মঞ্চে ছিলেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, সুবোধ সরকার, অভীক মজুমদার, অর্পিতা ঘোষ, প্রচেত গুপ্ত, ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুধাংশুশেখর দে, শ্রীজাত, প্রসূন ভৌমিক, সংস্কৃতি অধিকর্তা কৌশিক বসাক, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সচিব বাসুদেব ঘোষ প্রমুখ। সভামুখ্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তিনি বলেন, এক অবারিত উৎসব আমাদের সরকারের আয়োজনে। যেখানে আমরা কোনও সংকীর্ণ প্রবণতা, কুক্ষিগত করে রাখার মানসিকতাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিইনি। গতবারের থেকে স্টলের সংখ্যা বেড়েছে। আমার মনে হয় এই পার্বণ সকলের সহযোগিতায়, উদ্দীপনায়, সক্রিয় অংশগ্রহণে বিশেষ তাৎপর্য সঞ্চারী এবং সাহিত্য ও শিল্পের নিরিখে সুদূর প্রভাবী হবে।

আরও পড়ুন-সাগরসঙ্গমে বিকেলেই ৩৯ লক্ষ পুণ্যার্থীর সমাগম, উদ্দীপনার ঢেউয়ে শুরু হল মকরস্নান

তাঁর কথায় এ-ও জানা গেল, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির উদ্যোগে কলকাতার পাশাপাশি উত্তরবঙ্গেও আয়োজিত হবে লিটল ম্যাগাজিন মেলা। অংশ নেবেন উত্তরবঙ্গের লেখক, সম্পাদকরা।
উৎসবে আকাদেমি প্রবর্তিত স্মারকসম্মান প্রদান করা হয় নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়, শিবাশিস মুখোপাধ্যায়, প্রকাশ দাস, শৌভিক দে সরকার, সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, বিপুল দাস, রতন বিশ্বাস, সমীরণ দাস, জহর সেন মজুমদার, সিজার বাগচী, বারিদবরণ ঘোষকে। লিটল ম্যাগাজিন সম্মান পেল বিজ্ঞাপনপর্ব এবং রক্তমাংস পত্রিকা।

আরও পড়ুন-ভারতের সামনে আজ ইংল্যান্ড, বিশ্বকাপ হকি

পাঁচ দিনের এই মেলায় অংশ নিয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার প্রায় ৩৫০ লিটল ম্যাগাজিন। পাশাপাশি আছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল। যেমন, সাহিত্য অকাদেমি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগ, কলকাতা পৌরসংস্থা, পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য আকাদেমি, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, শিশু কিশোর আকাদেমি, লোক সংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, রাজ্য চারুকলা পর্ষদ, বসুমতী কর্পোরেশন লিমিটেড, নন্দন, তথ্য অধিকার, বঙ্কিম ভবন, উদ্বোধন, শিক্ষা দর্পণ এবং পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ড প্রমুখ। প্রতিটি স্টলে চোখে পড়ছে বইপ্রেমীদের ভিড়। বিক্রেতাদের মুখে হাসি।
সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ছে লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি। চলছে কেনাকাটা। ক্রেতাদের মধ্যে কেউ খুঁজছেন সিরিয়াস প্রবন্ধের বই, কেউ খুঁজছেন গল্প-কবিতা-ছড়া-উপন্যাস-চলচ্চিত্র-নাটকের বই, পত্রিকা।

আরও পড়ুন-আগামী সপ্তাহ থেকে প্লাস্টিক মুক্ত শহর হবে জলপাইগুড়ি

কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা। আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ে চমৎকার একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে হাওড়ার ‘গ্রামীণ পুঁথি’। সম্পাদক তপনকুমার সেন জানালেন, আমাদের প্রতিটি সংখ্যাই বিশেষ সংখ্যা। সাম্প্রতিক সংখ্যাটির চাহিদা ভালই। মেলার পরিবেশ এককথায় দারুণ।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে প্রকাশিত হয় নাজিবুল ইসলাম মণ্ডল সম্পাদিত ‘সমকালের জিয়নকাঠি’। বেশকিছু বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে এই পত্রিকা। নেড়েচেড়ে দেখছেন অনেকেই।
বাঁকুড়ার ‘টেরাকোটা’। প্রদীপ কর ও তুলসীদাস মাইতি সম্পাদিত এই পত্রিকা প্রকাশ করেছে বাংলার ব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো বিষয়ে বিশেষ সংখ্যা। আগ্রহীরা সংগ্রহ করছেন।

আরও পড়ুন-৮ হাজার শীতার্তকে শীতবস্ত্র আইএনটিটিইউসির

কবিতা বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে হাওড়ার ‘সপ্তধা’। বিশিষ্ট কবিদের কবিতার পাশাপাশি আছে কবিতা বিষয়ক কয়েকটি মূল্যবান গদ্য।
কোচবিহারের ‘উত্তর প্রসঙ্গ’ পত্রিকা অংশ নিয়েছে মেলায়। সম্পাদক দেবব্রত চাকী জানালেন, ভাল সাড়া পাচ্ছি। বহু মানুষ আসছেন। কিনছেন আমাদের বিশেষ সংখ্যাগুলো।
প্রথমবার মেলায় অংশ নিচ্ছে জলপাইগুড়ির ‘পরিসর’ পত্রিকা। শৌভিক বণিক জানালেন, উত্তরবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমির পক্ষ থেকে আমরা পত্রিকাটি প্রকাশ করি। খুব ভাল লাগছে মহানগরের সাহিত্য উৎসবে এসে। পাচ্ছি পাঠকদের শুভেচ্ছা, প্রশ্রয়।
কলকাতার ‘কবিতা এবং’ মেলায় প্রথমবার। সম্পাদক পূরবীতা মজুমদার জানালেন, নতুন পত্রিকা আমাদের। এখানে এত মানুষের ভালবাসা পাব, ভাবিনি।

আরও পড়ুন-রেকর্ড! ৫১ বছরে উষ্ণতম মকর সংক্রান্তি বাংলায়

ত্রিপুরার ‘মুখাবয়ব’ পত্রিকার টেবিলে রয়েছে পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা এবং ত্রিপুরার লেখকদের বই। অনেকেই সংগ্রহ করছেন।
এর পাশাপাশি পাঠকদের উন্মাদনা চোখে পড়ছে ‘আবার বিজল্প’, ‘রাবণ’, ‘জঙ্গলমহল’, ‘আর্ষ’, ‘এককমাত্রা’, ‘কবিতা এবং’, ‘বনানী’, ‘ইসক্রা’, ‘কলকাতার যিশু’, ‘যুগ সাগ্নিক’, ‘কবিতা ক্যাম্পাস’, ‘নৌকা সাহিত্যপত্র’, ‘বনপলাশি’, ‘খেয়া৯’, ‘প্রোরেনাটা’, ‘পুরবৈয়াঁ’, ‘কাব্যপথিক’, ‘উদার আকাশ’, ‘লুব্ধক’, ‘নান্দীমুখ’, ‘মনছবি’, ‘যুগন্ধর’, ‘পদার্পণ’, ‘আরাত্রিক’, ‘ঝোড়ো হাওয়া’, ‘তিতীর্ষু’, ‘গাধা’, ‘বিচিত্রপত্র’, ‘থিয়েটার দুনিয়া’, ‘এবং মুশায়েরা’, ‘ইচ্ছেনদী’, ‘সাহিত্য রংবেরং’, ‘সম্পর্কের শিকড়’, ‘ক্লেদজ কুসুম’, ‘শুধু বিঘে দুই’, ‘পাখিরা’, ‘রোদরং’, ‘এপার ওপার ইছামতী’, ‘আলো’, ‘বিরক্তিকর পত্রিকা’, ‘মিঠেকড়া’, ‘শব্দশিল্প’, ‘অঞ্জস’, ‘খেয়া’, ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’, ‘সাঁঝবাতি’ প্রভৃতি পত্রিকার টেবিলে। হাতে হাত ধরে বসেছেন বিভিন্ন জেলার সম্পাদকরা। সরাসরি সম্পাদক-প্রকাশকদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করার সুযোগ পাচ্ছেন পাঠকরাও। নতুন লেখকরা ঘুরছেন। একবুক স্বপ্ন নিয়ে।

আরও পড়ুন-উসকানি দিতে গিয়ে

মেলায় বড়দের পাশাপাশি আছে কয়েকটি ছোটদের পত্রিকাও। পাঠকদের উৎসাহ চোখে পড়ছে ‘সন্দেশ’, ‘ফজলি’, ‘লালপরি নীলপরি’, ‘আনন্দকানন’, ‘কিশোর কল্লোল’, ‘ছোটর দাবি’, ‘কচিকাঁচা সবুজসাথী’, ‘শরৎশশী’, ‘পথের সুজন’ প্রভৃতি পত্রিকার টেবিলে।
প্রতিদিন একতারা মুক্তমঞ্চ, বাংলা আকাদেমি সভাঘর ও জীবনানন্দ সভাঘরে আয়োজিত হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। ৫ শতাধিক কবি-লেখকের সম্মিলন। চলছে কবিতাপাঠ। বিভিন্ন লেখকের গল্পপাঠ করছেন বিশিষ্ট বাচিক শিল্পীরা। গল্পের জন্মকথা শোনাচ্ছেন লেখকরা। এ ছাড়াও আয়োজিত হয়েছে ৭টি আলোচনাসভা এবং দুই কবি মুখোমুখি শীর্ষক কবিদের আলাপচারিতার অনুষ্ঠান। নির্বাচনে মহানগরের পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জেলাকে। প্রবীণদের পাশাপাশি আছেন নবীন লেখকরাও। তালিকায় আছে এমন কিছু নাম, যাঁরা এই উৎসবে আমন্ত্রণ পেলেন প্রথমবার।

আরও পড়ুন-বাংলার প্রতি বঞ্চনা-বৈষম্যের প্রতিবাদে মুখর নবগ্রাম

মেলা উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশ করেছে নবস্পন্দন গ্রন্থমালা। এই বছর বেরিয়েছে সুমন মল্লিক ও সুমন ঘোষের কবিতা এবং দেবপ্রিয়া সরকার ও সায়ন্তনী ভট্টাচার্যর গল্পের বই।
উৎসবের অঙ্গ হিসেবে গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় আয়োজিত হয়েছে একটি বিশেষ প্রদর্শনী। শিরোনাম ‘তিষ্ঠ ক্ষণকাল’। দ্বিশততম জন্মবর্ষের প্রাক্কালে স্মরণ করা হচ্ছে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। প্রদর্শনীতে দর্শক সমাগম হচ্ছে ভালই।
সুরে সুরে শেষ হচ্ছে প্রতিটি সন্ধ্যা। একতারা মুক্তমঞ্চে বসছে গানের আসর। মেলায় ঘোরাঘুরির শেষে অনেকেই চেয়ার টেনে নিচ্ছেন। শ্রোতাদের দলে মিশে যাচ্ছেন বিভিন্ন প্রজন্মের লেখক-সম্পাদকরা।
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি মেলা ঘুরে দেখছেন বিশিষ্ট লেখকরা। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষ, জয়ন্ত দে, মৃদুল দাশগুপ্ত প্রমুখ উৎসবের আয়োজন দেখে খুশি।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

মেলার মাঠে প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রিকার টেবিল ঘিরে আয়োজিত হচ্ছে বই-পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠান। অনেকেই পাঠ করছেন কবিতা, কেউ গলা ছেড়ে গেয়ে উঠছেন গান। উঠছে দেদার ছবি। সেলফি জোনে পোজ দিচ্ছেন বিভিন্ন বয়সিরা। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক মাধ্যমে।
এবারের উৎসবের শীর্ষ পঙ্‌ক্তি পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’। এই পঙ্‌ক্তি অনুসরণ করে নন্দন-চত্বর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন লেখক-সম্পাদকরা। অফুরন্ত উন্মাদনাকে সঙ্গী করে তাঁরা ক্লান্তিহীন পা চালাচ্ছেন। আজ শেষদিন, উন্মাদনা যে হিমালয় ছোঁবে, বলার অপেক্ষা রাখে না।

Latest article