আহা! কী আনন্দ আজ আকাশে বাতাসে। খুশিতে আমাদের বেদম হওয়ার জোগাড় বিকশিত ভারতে।
কারণ, ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে যে সব দেশ এখন অর্থনৈতির বৈষম্যের ক্ষেত্রে চরম অবস্থার মুখে, সেগুলির অন্যতম আমাদের ভারত, মোদিজির ‘বিকশিত ভারত’। বিগত কয়েক বছরে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে। দেশের সবচেয়ে ধনী যারা, তাদের ১০ শতাংশের উপার্জন জাতীয় আয়ের ৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ, দেশের মোট আয়ের বেশির ভাগটাই কোনও ‘ঘুসপেটিয়া’, কােনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় খেয়ে যাচ্ছে না। তা চলে যাচ্ছে ধনকুবেরদের ১০ শতাংশের পকেটে কিংবা সিন্দুকে।
এটা যদি মুদ্রার এক পিঠ হয়, তবে অন্য পিঠেও চমৎকার অবস্থা! দেশের মধ্যে সবচেয়ে গরিব যারা, তাদের অর্ধেকের (অর্থাৎ ৫০ শতাংশ) আয় জাতীয় আয়ের মোটে ১৫ শতাংশ।
এহ বাহ্য! দেশের মোট সম্পদের ৬৫ শতাংশের মালিক ধনকুবেরদের ১০ শতাংশ। তার মধ্যে যারা শীর্ষস্তরে আছে, অর্থাৎ শীর্ষস্থানীয় ধনকুবেরদের, ধনীদের তালিকায় সবচেয়ে ওপরের দিকে থাকা লোকদের ১ শতাংশ দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদের মালিক।
আরও পড়ুন-মেসি-দর্শনে আজ আকুল শহর
এক কথায়, মোদির বিকশিত ভারতে ধনবানরা ধনীতর হচ্ছে, আর গরিব আরও গরিব হচ্ছে। আয় বৈষম্যের মাত্রা বেড়েই চলেছে। সব বিকাশ কেবল বড়লোকের। আর মোদিপক্ষ গেলাতে চাইছে ধর্মের ক্যাপসুল। দিচ্ছে ধর্মের সুড়সুড়ি। হিন্দু ভারতের গাজর ঝুলিয়ে ভোট লুঠের কারবার খুলে বসেছে।
ফলে, একদিকে গীতাপাঠের ব্রিগেডে চিকেন প্যাটিস বিক্রেতা গরিব ফেরিওয়ালাকে হিন্দুত্ববাদীরা বেদম প্রহার করছে, অন্যদিকে গরিবের পেটে আরও জোর লাথি পড়ছে। ২০২৪-এ ভারতের আয়বৈষম্যের সূচক দাঁড়িয়েছে ৩৮.২ এককে। তা নিয়ে মোদি-শাহ-নির্মলার কপালে কোনও ভাঁজ নেই উদ্বেগের কিংবা অনুশোচনার।
বিকশিত ভারতে, মোদীয় মাপকাঠি মোতাবেক, বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় সাড়ে ৬ লক্ষ টাকারও বেশি। অথচ, নিম্নবিত্তদের মধ্যে তলানিতে থাকা ৫০ শতাংশের বার্ষিক আয়ের মাথাপিছু গড় মোটে ৯৯ হাজার ৫৯৬ টাকা। অর্থাৎ পরিসংখ্যানগতভাবে যেখানে প্রত্যেক ভারতীয়র মাসিক আয় ৫৪ হাজার টাকারও বেশি, সেখানে গরিবদের মধ্যে যারা সবচেয়ে গরিব তাদের মাসিক উপার্জন ৮ হাজার টাকার সামান্য বেশি। যেখানে দেশের মাথাপিছু মালিকানাধীন সম্পদের মূল্য ২৯ লক্ষ টাকারও বেশি, সেখানে নিম্নবিত্তের মাথাপিছু গড় মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণ ২ লক্ষ টাকারও কম (১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা)। যা কিনা জাতীয় সম্পদের মাত্র ৬.৪ শতাংশ।
ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট বলছে, ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত, অর্থাৎ মোদি জমানার এক দশকে ভারতীয়দের আয় বৈষম্যের ক্ষেত্রে কোনও ইতিবাচক উন্নতি দেখা যায়নি। উন্নতি হয়নি মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও। বর্তমানে দেশের মাত্র ১৫.৭ শতাংশ মহিলা অর্থ-উপার্জনকারী শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করেন।
অথচ, কর ছাড়-সহ বিবিধ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে দেশে কায়েম হয়েছে বিলিয়োনিয়ার রাজ, ধনকুবেরদের শাসনব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থায় আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য বেলাগাম। আর্থ-সামাজিক কাঠামো চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি। আর পদ্মপক্ষ শোনাচ্ছে বিভেদের বাণী, ছড়াচ্ছে ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ, গড়ছে ভেদাভেদের কাঠামো। আমিষ না নিরামিষ, হিন্দু না মুসলমান, এসব নিয়ে মাতিয়ে রাখতে চাইছে আসমুদ্র হিমাচল।
আরও পড়ুন-বডি শেমিং অপরাধ
অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকেরা বলছেন, এই বিপুল বৈষম্যের জন্য দায়ী শাসকপক্ষের রাজনৈতিক আশ্রয়-নীতি, প্রতিষ্ঠানগত ক্রিয়াকলাপ এবং অবশ্যই কায়েম করা শাসক-কাঠামো। মোদির ‘বিকশিত ভারত’-এর সৌজন্যে আগত নয়া যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ধাঁচের বৈষম্য। গণতন্ত্র ভঙ্গুর, জলবায়ুতে সংকট। সেসবের জন্য সবচেয়ে কম দায়ী যারা, সেইসব গরিবগুর্বো মানুষগুলোকে ওইসব বিরাট বিপন্নতার ভার বইতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি করে। পুনর্বণ্টন ব্যবস্থা যতক্ষণ না শক্তিশালী হচ্ছে, ন্যায্য কর ব্যবস্থা গড়ার উদ্যোগ যতদিন না নেওয়া হচ্ছে, সামাজিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির আয়োজন যতক্ষণ না অগ্রাধিকার পাচ্ছে, ততদিন এই অবস্থার উন্নতি অসম্ভব। অবস্থা বদলানোর জন্য তাঁরাই বলছেন, সবচেয়ে আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
আমরা ভাল আছি, কারণ সবকা সাথ সবকা বিকাশ না হয়ে দেশে কত শত কোটিপতির সংখ্যা বাড়ল, তা দেখিয়ে উন্নয়নের সাফল্য তুলে ধরা হচ্ছে।
আমরা ভাল আছি, কারণ সাধারণ মানুষকে শোষণ-বঞ্চনার গভীরে ঠেলে দিয়ে, তাদের কাজ কিংবা যথেষ্ট মজুরির ব্যবস্থা না-করেই ধনকুবেরদের সম্পদের পাহাড়চূড়ার উচ্চতা বৃদ্ধিকেই জোরদার উন্নয়ন বলে তুলে ধরা হচ্ছে।

আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে
শাখে শাখে ধনকুবের ডাকে, কত শোভা
তাদেরই চারিপাশে
আজকে মোদির বড়ই সুখের দিন,
আজ বিভেদ-বৈষম্যের ফাঁদে পড়ে
মোরা হয়েছি ফের পরাধীন।
আসুন, এই পরাধীনতার নিয়ামক শক্তি বিজেপি-র বিসর্জন নিশ্চিত করি ইভিএম-এর বোতামে। গড়ে তুলি বিজেপি-মুক্ত বাংলা।

