মালা রায়: রাজপথ জনপথে পরিণত হওয়ার দিন সামনেই । ২১ জানে ২১-এর সংকল্প। আরও এক ২১-এর সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। সেই জুলাইয়ের ২১-র সম্মুখে। তিন দশক পার, ২১ সেদিনও মলিন নয়, আজ বরং আরও বেশি হুঙ্কারের। ৩১ বছর আগের সেই মর্মান্তিক দিনটিকে মনে করলেই, অনুধাবনে আসে যতই প্রস্তুতি থাক, শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা থাক, সেদিনের ওই আঠারোদের রক্তের ঋণ যেন আজও শোধ করে উঠতে পারিনি। মনের গভীরের যে শোকের পাথর জমে, আসলে সেই পাথর চিরন্তন। শুধু গর্বের ধ্বজা উড়িয়ে বলা যায়, অমর ২১ জাগ্রত সর্বদা, সংকল্পে ভরা। আমাদের কাছে তাই, বারে বারে শপথ নেওয়ার দিন ২১ জুলাই। প্রস্তুতি তুঙ্গে। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, মালদা থেকে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া থেকে বারাসাত… বাংলার প্রতিটি প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রস্তুত হচ্ছেন ২১ জুলাই সমাবেশে। লক্ষ্য ২১-ব্রিগেড।
আরও পড়ুন-অমর ২১ জুলাই, বীর শহিদরা অমর রহে
এই শহরের রাজপথ বিপ্লব দেখেছে। দেখেছে একে একে ঝরে পড়া একঝাঁক তরুণের প্রাণ। মহাসমাবেশের সাক্ষী থাকা এই শহর দেখেছে পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন সোভিয়েন ইউনিয়নের দুই শীর্ষ নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও নিকোলাই বুলগানিনের সমাবেশ। দেখেছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শেষে ’৭২-এ ইন্দিরা-মুজিবের সমাবেশ। সেবারও আয়োজক পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ব্রিগেড যেন সেদিন জনসমাবেশের ক্ষেত্র। তবে, সেই ব্রিগেডে যখন একটা দিনের রক্তাক্ত কয়েক ঘণ্টার সময়কে মনে করে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জমা হন, তখন মনে হয় নেপথ্যে জ্বলজ্বল করছে একজনই— তিনি নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোনও সরকার নয়, কোনও রাজনৈতিক দল নয়, মমতা একা। যিনি পেরেছেন, ২১ জুলাইয়ের দিনটিকে সেই একই মর্যাদা দিয়ে পালন করতে।
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই। আমাদের কাছে না ভোলা, দগ্ধ এক স্মৃতি। যা প্রশস্ত করে চলেছে নবজাগরণের পথ। ভুলিনি, ভুলব না সেই দিন। কেন্দ্রে নরসিমা রাওয়ের সরকার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সরকারের ক্রীড়া যুব-কল্যাণ মন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী, ’৯২-এর অক্টোবরে ডাক দিলেন ব্রিগেড সমাবেশের। তৎকালীন সিপিএম সরকারের মৃত্যুঘণ্টার ডাক দিয়েই লক্ষ লক্ষ মানুষ তখন নয়া যুগের সূচনার পথে, নতুন ইতিহাস লেখার পথে। সিপিএম বিরোধী জন আন্দোলনের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য মুখ হয়ে ওঠা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন আরও বেশি গর্জনে। নব্বইয়ের অশান্ত সময়ে বামফ্রন্ট সরকারের নির্মমতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মমতা সরাসরি মহাকরণে ঢুকে পড়েন। একা নন, সিপিএমের নির্মম লালসার শিকার ধর্ষিতার হাত সেদিন ধরেছিলেন একজন মানুষ। তিনি আমাদের নেত্রী মমতা। জবাব চেয়েছিলেন, ন্যায় বিচার চেয়েছিলেন। ফল, হাতেনাতে। পুলিশের লাঠি, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নির্বিকার চিত্তে সেই পুলিশ নিগ্রহকে চাক্ষুষ করা, বা বলা যেতে পারে নির্দেশ দেওয়া। ন্যায় বিচারের পরিবর্তে যে স্বৈরাচারী শাসকের পরিচয় জ্যোতি বসু দিয়েছিলেন তা জননেত্রীকে পরবর্তী বৈপ্লবিক পদক্ষেপের পথ প্রশস্ত করে। কারণ, এই ঘটনার পরই বাংলার মানুষও গর্জে ওঠেন। পর্দা ফাঁস হয় সিপিএম সরকারের, মমতার একটা পদক্ষেপের কারণে।
আরও পড়ুন-২১ জুলাই, ১৯৯৩…
একদিকে সিপিএম সরকারের অত্যাচার, অন্যদিকে নির্বাচনের রিগিং, সন্ত্রাস সিপিএম সরকারের একমাত্র জিয়নকাঠি। ব্যাপক রিগিং ও ছাপ্পা ভোট প্রতিটি নির্বাচনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডাক দিলেন সচিত্র ভোটার কার্ড চালু করতে হবে। সেই সময় নির্বাচন কমিশনের অফিস ছিল রাইটার্স বিল্ডিং। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডাক দিলেন সচিত্র পরিচয়পত্রে দাবিতে রাইটার্স চলো। তারপরের ঘটনা এক হাড় হিম করা নারকীয় কাহিনি।
মহাকরণকে কেন্দ্র করে পাঁচদিক থেকে মিছিল আসছিল। হাওড়া স্টেশনে জমায়েত হওয়া মিছিলটি এসে গিয়েছিল বিবাদী বাগের টি বোর্ডের কাছে। আমি সেদিন সেখানেই ছিলাম। ছিলেন আমাদের নেতা সৌগত রায়। ছিলেন অজস্র মানুষ, শেষ না হওয়া সেই মিছিল ঘিরে তখন চলছে পুলিশের সঙ্গে কথা কাটাকাটি। অতর্কিতেই কিছু পুলিশ জনতার উপর মারমুখী হয়ে ওঠে, চলে বেপরোয়া লাঠিচার্জ। মিছিলে ছিলাম আমিও। রেয়াত করা হয়নি মহিলাদেরও। নেত্রী মমতার উপরও হামলা চলে। পুলিশের লাঠি তাঁকেও ছেড়ে কথা বলেনি। আমরা প্রাণপণে নেত্রী মমতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। কিন্তু, পেরে উঠিনি পুলিশের নির্মমতার কাছে।
আরও পড়ুন-আন্দোলনের ধাত্রীভূমি, একুশের ধর্মতলা
মেয়ো রোডের কাছে যে মিছিলটি পৌঁছয় তাদের ছত্রভঙ্গ করতে সিপিএমের পুলিশ লাঠি, কাঁদানে গ্যাস দিয়ে হামলা করতেও পিছপা হয়নি। তারপর যা হয়, তা ভয়ানক। চোখের সামনে নিরীহ, নিরস্ত্র জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালায়। দিগ্বিদিক না দেখে স্বৈরতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে গুলি চালে, ক্ষমতা জাহির করার অহঙ্কার ফুটে ওঠে গুলির শব্দে। পরিণাম— একে একে ১৩টি তরতাজা প্রাণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চোখের সামনে দেখলাম ক্ষমতার দামামায় কীভাবে প্রাণ হারালেন তাঁরা। সেই স্মৃতি মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। পিজি হাসপাতালে একের পর এক রক্তাক্ত দেহ রেখে আসছেন আমাদের কর্মীরা। সন্তানহারা মায়েদের কান্নার রোলে সেদিন বাংলার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল।
১৩টি তাজা প্রাণের আত্মবলিদান বিফলে যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব কাজে করে দেখিয়েছে। দেশের মানুষ এই রক্তাক্ত আন্দোলনের পরই সচিত্র ভোটার কার্ড হাতে পান। গণতন্ত্র রক্ষায়, দেশের মানুষের গণণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকের অধিকার বজায় রাখতে সেদিন ১৩ জনের বলিদান আমরা ভুলিনি। তাঁদের স্মৃতি তর্পণ করেই আমাদের এই শ্রদ্ধাঞ্জলি। —
অমর একুশে জুলাই তোমায় আমরা ভুলছি না ভুলব না..
শহিদের রক্ত ব্যর্থ হয়নি…
আমরা ব্যর্থ হতে দেব না।
বারবার মনে করিয়ে দেব, এক একুশ ভাষা আন্দোলনের, আর এক একুশ নাগরিকের অধিকার বুঝে নেওয়ার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে প্রমাণ করেছেন, ইতিহাস ক্রমবর্ধমান। স্বৈরাচারী যুগের অবসান হবেই একদিন না একদিন।