পাঞ্জাব ছাড়া উত্তরপ্রদেশ-সহ আরও তিনটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি (BJP) তথা সঙ্ঘ পরিবার জয়লাভ করেছে। বিজেপির এই বিজয় অভিযানকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। চলছে নানা পর্যালোচনা। প্রকৃত প্রস্তাবে বিজেপির এই জয় হল ফ্যাসিস্ট রাজনীতির জয়।
ফ্যাসিবাদ নিয়ে বিশ্বজুড়ে বহু আলাপ-আলোচনা, লেখালেখি, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে এবং এখনও নানা পর্যালোচনা চলছে। তুলনামূলক আলোচনা চলছে ৩০-এর দশকের ফ্যাসিবাদ ও একবিংশ শতাব্দীর ফ্যাসিবাদের চরিত্র ও তার কর্মপ্রণালী নিয়ে।
আমাদের দেশে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে যে শাসন চলছে তা কতটা ফ্যাসিবাদী, সে বিষয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। ফ্যাসিবাদ নিয়ে এব্রকম কোনও তাত্ত্বিক বিতর্ক করার পরিসর এটা নয়। আমাদের আলোচনার বিষয় তাই সেই ফ্যাসিস্ট রাজনীতি, যে রাজনীতির কৌশলগত ব্যবস্থাপনায় সঙ্ঘ পরিবার দক্ষতার সঙ্গে কেন্দ্রে ও রাজ্যে-রাজ্যে ক্ষমতা দখল করছে।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও বাস্তব সংগ্রামে যাঁর নাম বারবার আসে, টিনি হলে জি. দিমিত্রভ। তাঁর কথায়, ‘‘ফ্যাসিবাদ হল সবথেকে বেশি প্রতিক্রিয়াশীল, সবথেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং লগ্নি পুঁজির মধ্যেকার সবথেকে বেশি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির ধারকদের খোলাখুলি একনায়কত্ব।’’
ভারতে এর কতখানি অক্ষরে অক্ষরে মিলবে, সে আলোচনা তোলা থাক আরও বিদগ্ধজনের জন্য। আমরা এই লেখায় বরং সাহায্য নেব জ্যাশন স্ট্যানলি-র লেখা How Fascism Works সেই বই থেকে।
সাম্প্রতিক কালে চরম দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদের উপর ভর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, পোলান্ড, ভারত, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক শক্তির উত্থান প্রকটভাবে দেখা গিয়েছে। একথা বলা আবশ্যক, ফ্যাসিস্ট রাজনীতি সবসময় যে পুরোপুরি একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তুলবে, এমন নয়। কিন্তু শেষবিচারে এই রাজনীতি ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক।
ফ্যাসিস্ট রাজনীতি বিভিন্ন পৃথক বৈশিষ্টসম্পন্ন কৌশল ও রণনীতি গ্রহণ করে। এর মধ্যে পড়ে, মিথোজীবীতা (অতীতের কল্পকাহিনীর নির্মাণ), প্রচার, মেধাজীবীদের (intellectualism) বিরোধিতা, অবাস্তবতা, উচ্চ-নীচের বর্গ কাঠামো (hierarchy), আইন-শৃঙ্খলা, যৌন উদ্বেগ, দেশমাতৃকার নামে আবেদন এবং জনকল্যাণ ও গণ ঐক্যে ফাটল করানো।
চোখ কান খোলা রেখে দেখলে বা শুনলে উপরের সবকটি বৈশিষ্টই মোদি (Narendra Modi) জমানায় দেখা যাবে। দেখা যাবে স্পষ্টভাবেই। ভারতের অতীত গর্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি, প্রচারের ঢক্কানিনাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাধান্য, বুদ্ধিজীবী-মুক্তমনা শিক্ষিত মানুষের প্রতি ঘৃণাবর্ষণ, নানা অবাস্তব পরিকল্পনা (নোটবন্দি ইত্যাদি) আইন-শৃঙ্খলা নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া, নারী নির্যাতন, নারীর অসম্মান এবং ‘ভারত মাতা কী জয়’-উচ্চারণ করে যুদ্ধ ঘোষণা, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’- ধ্বনি (অপরকে অপমান ও ভীতি প্রদর্শনের জন্য), মানুষে মানুষে বিভাজন ও জনকল্যাণে কাঁটছাট । এ সবই মোদি জমানার অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বড় লক্ষ্য হল, মানুষের একাংশকে অমানবিক স্তরে ঠেলে দেওয়া। তাঁদের ‘অপর’ বানিয়ে দেশ থেকে বিতাড়নের লাগাতার প্রচেষ্টা চালানো। তারই সঙ্গে চলে গণহত্যা, নাগরিকত্ব হরণ ও সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী রাজনীতির বিস্তার এবং ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা।
ফ্যাসিস্ট রাজনীতি, এমনভাবে আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নটি তোলে, যাতে একথাই মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, আমরা (পড়ুন হিন্দুরা) আইন-শৃঙ্খলা মান্যকারী নাগরিক। আর ওরা (পড়ুন মুসলমান) আইন-শৃঙ্খলা মানে না এবং ওদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা অনেক বেশি। লিঙ্গ সমতার প্রশ্ন উঠলেই ফ্যাসিস্ট রাজনীতির লোকেরা ক্ষেপে ওঠে।
যে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নিয়ে আমাদের আলোচনা, সেই রাজনীতি এদেশে বহন করে চলেছে বিজেপি (BJP)-সহ সঙ্ঘ পরিবার। তাদের রাজনীতিকে মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার ভিত্তি রয়েছে এই দেশের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। এদেশের ভিন্ন ইতিহাস ও অতীত সংস্কৃতির চলমানতা-বিজেপি তথা গেরুয়া শিবিরকে বেশ খানিকটা জমি দিয়েছে। মতাদর্শের দিক থেকে সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শ যথেষ্ট পশ্চাদপদ। অতীত গৌরবের মিথ সর্বস্বতা এবং তার অবৈজ্ঞানিক ভয়াবহতা ফ্যাসিস্ট রাজনীতির জমি-সিঞ্চনের ব্যবস্থা করছে। ইতিহাস বিকৃতি তার অপর এক রাজনৈতিক কার্যক্রম।
এদেশের রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের যে অবস্থান ছিল, তা দ্রুতই খসে পড়ছে। বিশ্বাস ও অনুমানের উপর নির্ভর করে আদালত যেভাবে রায় দিচ্ছে, তাতেও তো হিন্দুত্ববাদীদের ভূমিকা স্পষ্ট।
এদেশে তৈরি হয়েছে ধর্ম-ভিত্তিক নাগরিকত্ব আইন। দুর্বলদের অনাগরিক করে দেওয়ার জন্যই এই আইন। সঙ্ঘ পরিবার জাত-পাতে বিশ্বাস করে। নারীর অধিকারে বিশ্বাস রাখে না। দলিত সমাজের সমানাধিকারেও এনাদের বিশ্বাস নেই।
রামমন্দির নির্মাণ, মোদি (Narendra Modi) জমানার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এছাড়া রয়েছে, এনআরসি এবং কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপ। আমরা লক্ষ করছি যে, সর্বস্তরে স্বাধীন বিদ্যাচর্চা ভয়ানকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে বিজ্ঞানচর্চাও। ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভাষা —সবকিছুতেই এক ‘হিন্দুত্ববাদী’ ভাষ্য নির্মাণ করছে এই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির পতাকাধারীরা।
ফ্যাসিবাদী রাজনীতির ভারতীয় লক্ষণগুলি নিয়ে এই ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু কথা উল্লেখ করা হল। বাকি থাকল আরও অনেককিছু।
এই আলোচনার প্রধান উদ্দেশ্য হল, বিধানসভা নির্বাচনগুলির জয় পরাজয় শুধু নির্বাচনী পর্যালোচনায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বিজেপির (BJP) রাজনৈতিক ভিত্তি ও তার জনপ্রিয়তার কারণগুলিকে সমাজের পশ্চাদপদতার মধ্যে খুঁজতে হবে। তাঁদের ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকে পরাজিত করার জন্য মানুষের সমাজ চেতনার বিকাশের জন্য অনেক বেশি জোর দিতে হবে। তথাকথিত ‘জনপ্রিয়তা’-র কাছে, অন্ধ বিশ্বাসের কাছে যদি যুক্তি-বিজ্ঞান-বিশ্লেষণ পিছু হঠতে থাকে, তাহলে বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত হবে কোন উপায়ে? সমাজ-চেতনার পশ্চাদপদতা দূর করার কাজে তাই সবাইকে জোটবদ্ধ হয়ে সবথেকে বেশি জোর দিতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।