আমরা জিতে গিয়েছি, জয়ী আজ উৎসবপ্রাণিত বাংলা

‘ভরা পালে চলে যায়, / কোনো দিকে নাহি চায় / ঢেউগুলি নিরুপায় / ভাঙে দুধারে।’ ওই যে ভরা পালে চলে যায় যে তরী, সেটা হল পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রশাসন। মা-মাটি-মানুষের সরকার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পুলিশ, ইত্যাদি। আর নিরুপায় ঢেউয়ের ভূমিকায় সমালোচনাকারী চিল-শকুন, রাম-বামের দল। লিখছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

‘আমরা জিতে গেছি।

শকুনেরা সব ওঁৎ পেতে ছিল,
আকাশ ভেঙে নামুক বৃষ্টি,
ইন্দ্রদেব মোদের সহায় ছিল
জিতল বাংলার ঐতিহ্য কৃষ্টি।।

সারা বাংলা মাতল উৎসবে
ধর্ম হল না কোনও বাধা,
হিন্দু মুসলিম শিখ খ্রিস্টান
এক সুরে মেলাল সব ধাঁধা।

বাংলার পুলিশ আবারও সেরা,
লক্ষ লক্ষ ভিড় রোজ সামলিয়ে,
প্রমাণিত হল বাংলায় সুশাসন,
শত্রুর মুখে সপাটে চড় কষিয়ে।

অপেক্ষা ছিল ওদের একটা লাশের
অথবা ভাঙা মূর্তির গুজবের।
হতাশ গদি মিডিয়ায় শান্তির বাংলা
তাই হল না শিরোনাম খবরের।

উসকানি ছিল, ছিল প্ররোচনা
ছিল ধর্মের সুড়সুড়ি প্রতিক্ষণ,
সবকিছুকেই হেলায় হারিয়ে
জিতল বাংলার জনগণ।’

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে ত্রাণ বিলি শুরু করলেন বিধায়ক

না! এই ছন্দময় বয়ানটি মল্লিখিত নয়। লিখেছেন কনিষ্ঠ ভগিনীসমা শ্রীপর্ণা রায়। শ্রীপর্ণা উত্তর ব্যারাকপুর পুরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের পৌর প্রতিনিধি।
কিন্তু এটাই আমার, আমাদের বয়ান।
হ্যাঁ, সত্যিই আমরা জিতে গেছি। কলকাতার দুর্গা পুজো অযুত কুৎসা, নিযুত প্ররোচনা সত্ত্বেও শান্তি ও সৌহার্দ্যের উৎসব হিসেবে ফের জয়ী।
কারণ চতুর্বিধ। বহুমাত্রিক।
এক, এবারের পুজোয় বড় কোনও পথ দুর্ঘটনা ঘটেনি। যান শাসনে দক্ষতার পরিচয় পুনঃ পরিস্ফুট। রাস্তায় ভিড় ছিল, মানুষের এবং ট্রাফিকের। তাতে যান চলাচল ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শহরের পথে বিঘ্নিত হয়নি। সৌজন্যে পুলিশ ও প্রশাসন। ট্র্যাফিক আইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। সেইমতো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ৩৯৩ জনের বিরুদ্ধে। যত গাড়ি রাস্তায় নেমেছে, তার প্রেক্ষিতে এটা শতাংশের হিসেবেও আসে না।
দুই, নারী-নির্যাতন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির কোনও ঘটনা শহর কলকাতার উৎসবের ভিড়ে ঘটল না। তাই বলে কি বেলেল্লাপনা একেবারে বন্ধ করা গেছে? না, মোটেই তেমন নয়। বেলেল্লাপনা রোখা যায়নি হয়তো, কমানো গিয়েছে অবশ্যই। এবং সেটা সম্ভব হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের সুতীক্ষ্ণ নজরদারির কারণেই। পার্বণ-শাসিত শহরে পুজোর দিনগুলোতে বেল্লেনাপনার অভিযোগে গ্রেফতারের সংখ্যা মাত্র ৪৯৮। শতাংশের বিচারে প্রায় শূন্য।
তিন, মধ্য কলকাতার একটি পূজার কর্মকর্তাদের নিরন্তর মিথ্যাচার, বিভ্রান্তিকর প্রচার সত্ত্বেও কলকাতার দুর্গা-উৎসবের নিজস্ব গরিমা টোল খায়নি এতটুকু। এমনকী দশমীর পরেও শহর সাক্ষী থেকেছে এক অনাবিল প্রাণোৎসবের। বৃষ্টি পড়েছে, সাথে সাথেই ভিড় জমেছে সুরুচি সংঘে, ত্রিধারায়, চেতলা অগ্রণীতে, রামমোহন সম্মিনীতে। উত্তর থেকে দক্ষিণে। শহর পেরিয়ে শহরতলিতে। তৃতীয়া থেকেই এই ভিড়টা সামাল দিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। দিনে ও রাতে। ভোরে এবং মধ্যরাত্রে।

আরও পড়ুন-শনিবারও বিসর্জন, তৎপর পুরসভা

ফলত, পুজোর ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখা সেরে মেয়েরা, তাদের মায়েরা, তাদের বোনেরা, তাদের বান্ধবী-সহপাঠিনীরাও ঘরে ফিরল নিরাপদে। রোল-ফুচকা-বিরিয়ানি-চাইনিজের আনন্দ-যাপন সেরে। কেউ কেউ আবার ফিরল মধ্যরাতে। তখনও মোবাইল ফোনে চলছিল পরদিন পূজা পরিক্রমার পরিকল্পনা।
চার, এর অনিবার্য পরিণামে উপর্যুপরি চারবার নিরাপদতম শহরের গৌরব অর্জন শহর কলকাতার। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)-এর সর্বশেষ ২০২৩ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, দেশের ২০ লাখের বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট ১৯টি শহরের মধ্যে কলকাতায় অপরাধের হার সবচেয়ে কম, প্রতি এক লক্ষ জনে মাত্র ৮৩.৯টি দণ্ডনীয় অপরাধ। এ নিয়ে পরপর চার বছর ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ শহর হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখল তিলোত্তমা। অপরাধ পরিসংখ্যান বলছে, অপরাধ পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে যেখানে এই হার ছিল ১৫৯.৬, সেখানে ২০২১ সালে কলকাতায় এই হার ছিল ১০৩.৫, ২০২২ সালে ৮৬.৫ এবং সেখানে ধীরে ধীরে অপরাধের গ্রাফ নেমেছে শহরে। ২০২৩-এ হয়েছে ৮৩.৯টি। ২০২৩-এ শহরে মোট দণ্ডনীয় অপরাধের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১,৮৪৩, যা ২০২২ সালের তুলনায়ও কম (১২,২১৩)। ২০২৩ সালে কলকাতায় মোট ১,৭৪৬টি নারী-নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় কম। নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার প্রতি এক লক্ষ জনে ২৫.৭, যা দেশের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন চেন্নাই (১৭.৩) ও কোয়েম্বাটুর (২২.৭)-এর পরেই কলকাতা। শহরে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ২০২৩ সালে মাত্র ১০।
একদা যাঁরা একথা বলতে এবং প্রচার করতে চাইছিলেন, এই শহর এত অপরাধপ্রবণ, এতটাই নিরাপত্তাহীন এখানে মহিলারা যে এই শহরে সন্তানের জন্মও দেওয়া যায় না, যাঁরা চেষ্টা করছিলেন রাত দখলের নামে শহরে চিরায়ত রাত নামিয়ে আনার, তাঁদের গালে এই তথ্য, উপাত্ত, পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে একটা বড় থাপ্পড়।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সত্য যেখানেই সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব।
অপপ্রচারের মেঘ ঠেলে সত্য সূর্যের গরিমা প্রকাশ পেয়েছে আমাদের প্রাণের উৎসবে, শ্রেষ্ঠ উৎসবে। আসুন, সেই আনন্দ, সেই উৎসবপ্রাণতা বয়ে নিয়ে চলি আজকের কার্নিভালে।

Latest article