সংবিধান রক্ষার শপথ নিতেই হবে আমাদের

বাবাসাহেব আম্বেদকর সংবিধান প্রণয়ন করেছেন সেটি আদতে গণতন্ত্র ও সংহতির সংমিশ্রণ। উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ মোচন করে সাম্যের বাতাবরণ তৈরিই হল এই সংবিধানের লক্ষ্য। লিখেছেন অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

আম্বেদকর বলেছিলেন, ‘‘১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি, আমরা এক দ্বন্দ্বপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। রাজনীতিতে আমাদের সমতা থাকবে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে আমাদের বৈষম্য থাকবে।’’ ১৯৪৭-এ ভারত স্বাধীনতা অর্জন করার পর ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বাংলা থেকে নির্বাচিত গণ পরিষদের সদস্য হিসেবে ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী হিসেবে ড. ভীমরাও আম্বেদকরকে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং সংবিধান প্রণয়নের গুরুদায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করেন।
সংবিধান কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৪৮ সালে ড. আম্বেদকর ভারতের জনগণের সামনে খসড়া সংবিধান উপস্থাপন করেন এবং ২৬ নভেম্বর ১৯৪৯ সালে সেই খসড়া গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ সালে ২৬ জানুয়ারি তা কার্যকর হয়, এই কাহিনি আমরা কমবেশি সকলেই জানি, কিন্তু এই সংবিধান প্রণয়নের পিছনে অনেক চিন্তাভাবনার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে যা আমাদের অনেকেরই অজানা। আম্বেদকরের সংবিধানটি পেশ করার পর ১০০ দিন ধরে ধৈর্য সহকারে প্রতিটি ধারার ব্যাখ্যা করেন শুধু নয়, জানা যায় সংবিধানে ৭৫০০টি সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং তার মধ্যে ২৫০০টি গৃহীত হয়েছিল, সেগুলো সমাধান করে সংবিধান রচনা, এ যেন এক অসাধারণ কৃতিত্ব।
তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের মতো একটি দরিদ্র, জনবসতিপূর্ণ ও অসম সুযোগের দেশে সংবিধান রচনা সত্যিই সাফল্যের দাবি রাখে। আনন্দ তেলতুম্বড়ে লেখা ‘আইকনোক্লাস্ট: অ্যা রিফ্লেক্টিভ বায়োগ্রাফি অফ ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর’ গ্রন্থে আম্বেদকরের জীবনের অনেকগুলো ঘটনার উল্লেখ আছে। ১৯৫৬ সালে ২০ মে ভয়েস অফ আমেরিকা নিউজ নেটওয়ার্কের সঙ্গে ‘ভারতে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা’ নামক শীর্ষক একটি আলোচনায় আম্বেদকরের কাছে প্রশ্ন এসেছিল যে, ভারতে কি গণতন্ত্র আছে? তাঁর সপাট উত্তর ছিল, ‘‘গণতন্ত্রকে প্রজাতন্ত্র বা সংসদের সাথে তুলনা করার বিভ্রান্তি দূর না হলে এর কোনও নির্দিষ্ট উত্তর সম্ভব নয়।’’

আরও পড়ুন-জয়ে ফিরতে মরিয়া বিরাটরা

আসলে তাঁর ব্যাখ্যাতেই পরিষ্কার গণতন্ত্র সাধারণত প্রজাতন্ত্র এবং সংসদীয় সরকারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। গণতন্ত্র শুধু সরকারের একটি দায়িত্ব নয়, বরং সংযুক্ত জীবনধারার একটি পদ্ধতিও বটে। বাবাসাহেব রচিত সংবিধানের মূল ভিত্তি হল সাম্য, ন্যায় বিচার ও অধিকার। বিশেষ করে প্রান্তিক ও দুর্বল সম্প্রদায়ের জন্য সংবিধানের রচিত প্রতিটি অক্ষর হল অমৃত।
সংবিধানে অনেকগুলো দিক রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মৌলিক অধিকার, শাসনের অধিকার, সরকারের কাঠামো এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সম্পর্কের সূত্র। সংবিধান যেমন সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকে নিশ্চিত করে তেমনি প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নানান কার্যাবলিকেও নির্দেশ করে। বর্তমান সময়ে ধর্মীয় বিভাজন যেভাবে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের প্রতিটি স্তরে সেইখানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠটি কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দেওয়া আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। বাবাসাহেব একটি শ্রেণির সপক্ষে লড়াই করলেও কখনও কোনও ধর্মকে প্রাধান্য দেননি সংবিধান রচনায়। তাঁর সংবিধানের লক্ষ্য ছিল সমান সুযোগ, অর্থাৎ উচ্চ-নীচ জাতিভেদ সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানুষ যাতে পরিষেবা পায় সেটা নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমান সময়ে সংবিধানের সেই সমান অধিকার জাতিভেদের আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে ভারতবর্ষে কোনও শাসক বা রাজনৈতিক দল বিভেদের রাজনীতি করে বেশিদিন সিংহাসন ধরে রাখতে পারেনি।
সম্রাট অশোক নির্দিষ্ট ধর্মের অধীনে থেকে ও সকল ধর্মকে সম্মান করতেন এবং সকলের প্রতি সহনশীল হতে মানুষজনদের উৎসাহিত করতেন। সম্রাট আকবর নির্দিষ্ট ধর্মের শাসক হয়েও সকল ধর্মকে সমানভাবে বিবেচনা করতেন এবং ধর্মান্তর নিষিদ্ধ করেছিলেন। আসলে এই শাসকরা হয়তো বুঝেছিলেন ভারতবর্ষকে শাসন করা তখনই সম্ভব যখন সকল ধর্মের মানুষের সম-উন্নতি হবে। কারণ ভারতবর্ষ হল ধর্মের মিলনক্ষেত্র। সেই জন্য ইতিহাসে অশোক বা আকবর ভারতবর্ষ শুধু শাসনই করেননি, বরং সফলতার সাথে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম উজ্জ্বল করে গেছেন।

আরও পড়ুন-শচীনের প্রশ্নে নিয়ম বদলাচ্ছে আইসিসি

ব্রিটিশদের শাসন বোধহয় আরও কিছুদিন টিকত যদি তারা বঙ্গভঙ্গের মতো বিভাজনের সলতে না পাকাত। কারণ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আড়ালে স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত মজবুত হয়েছিল। নানান ঘটনা কাহিনি বারে বারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে বিভাজন কখনও কোনও শাসককে ভারতে রাজত্ব করতে দেয়নি। আর পরবর্তী সময়েও তা দেবে না। বাবাসাহেব তাই ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিকে সংবিধানের পাতায় লিখে রাখার জন্য ভিত গড়ে দিয়েছিলেন সমতা শব্দটির আড়ালে। বাবাসাহেব বিশ্বাস করতেন সংবিধানে যতই সমানাধিকার লেখা থাকুক, কিন্তু সঠিক বাস্তবায়ন না হলে তা শুধুই লিপিবদ্ধ থেকে যাবে পৃষ্ঠার আড়ালে এবং সমাজে শ্রেণি বিভাজন বাড়বে। এমনকী সংবিধানের স্রষ্টা একটা সময় সংবিধানের ওপর রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি এটা বলতে প্রস্তুত যে আমিই প্রথম ব্যক্তি যে এটি পুড়িয়ে ফেলব। আমি এটি চাই না। এটি কারও জন্য উপযুক্ত নয়।’
সংবিধানে এমন অনেক ধারা আছে যা হয়তো সমানাধিকারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু বর্তমান সমাজে কিছু শতাংশ অভিজাতদের গুরুত্ব দিতে বাকি সিংহভাগ অংশের মানুষকেই ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি অন্যদিকে ভোট বৈতরণী পার করতে পারে একমাত্র ধর্মীয় বিভাজন সেটাও অনেকাংশে ঠিক। তাই হয়তো যেখানে সংবিধানে শ্রেণি বিভাজন মোছার কথা বলা হয়েছে সেখানে ধর্মীয় উদ্দীপনার জিগির হবে সেটাই স্বাভাবিক।

Latest article