পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলা ও ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়া : সংসদের বিশেষ অধিবেশনের জরুরি প্রয়োজন— জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁও সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি গভীর আঘাত হেনেছে। এই হামলা, যা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত হয়েছে, নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে উন্মোচিত করেছে। এই
প্রেক্ষাপটে, বিরোধী দলগুলো লোকসভার একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের দাবি তুলেছে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, ‘পহেলগাঁও হামলা এবং এর পরবর্তী সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে সংসদে আলোচনা অপরিহার্য।’ এই দাবি কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং জাতীয় স্বার্থে একটি জরুরি পদক্ষেপ।
আরও পড়ুন-আমার জীবনের পথপ্রদর্শক, শ্রদ্ধাঞ্জলি অভিষেকের
জাতীয় ঐক্য ও সংসদীয় আলোচনার গুরুত্ব— পহেলগাঁও হামলা ভারতের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেসের একটি ট্যুইটে বলা হয়েছে, ‘পহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসী হামলা প্রতিটি ভারতীয়কে স্তম্ভিত করেছে। এই সময়ে আমাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে।” সংসদের বিশেষ অধিবেশন এই ঐক্য প্রকাশের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। সংসদে আলোচনা কেবল সরকারের সামরিক প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা বা সমর্থনের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি সমন্বিত নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নের জন্যও অপরিহার্য।
অ্যাকাডেমিক গবেষণাও এই আলোচনার গুরুত্বের উপর জোর দেয়। ২০১৬ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সন্ত্রাসী হামলার পর সংসদীয় আলোচনা সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করে এবং জনগণের আস্থা বাড়ায়।” এই ধরনের আলোচনা সরকারকে কেবল সামরিক পদক্ষেপের উপর নির্ভর না করে কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা কৌশল শক্তিশালী করতে বাধ্য করে।
বিশ্বের সংসদীয় নজির— বিশ্বের অনেক দেশ সন্ত্রাসী হামলার পর বিশেষ সংসদীয় অধিবেশন আহ্বান করেছে। মার্কিন কংগ্রেস ২০০১ সালে ৯/১১ হামলার পর একটি জরুরি অধিবেশন আহ্বান করে। এই অধিবেশনে ‘প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট’ প্রণয়নের পথ প্রশস্ত হয়, যা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছিল। মার্কিন সিনেটের তৎকালীন নেতা টম ড্যাশল বলেছিলেন, “এই অধিবেশন জাতির ঐক্য ও সংকল্প প্রকাশ করেছে।”
যুক্তরাজ্যের সংসদও এমন নজির স্থাপন করেছে। ২০০৫ সালে লন্ডনের ৭/৭ বোমা হামলার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একটি বিশেষ অধিবেশন বসায়। এই অধিবেশনে সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন এবং গোয়েন্দা ব্যবস্থার উন্নতির বিষয়ে আলোচনা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, “সংসদের এই আলোচনা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছে।”
ফরাসি সংসদ ২০১৫ সালে প্যারিসের বাতাক্লাঁ হামলার পর একটি জরুরি অধিবেশন আহ্বান করে। এই অধিবেশনে জরুরি অবস্থা জারি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেছিলেন, “সংসদের এই পদক্ষেপ জাতিকে একত্রিত করেছে এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের সংকল্প প্রকাশ করেছে।”
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (UNGA) ও সন্ত্রাসবিরোধী আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০১ সালে ৯/১১ হামলার পর UNGA-র একটি বিশেষ অধিবেশন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার রূপরেখা তৈরি করে। ২০০৬ সালে UNGA-র গ্লোবাল কাউন্টার-টেররিজম স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ এই ধরনের আলোচনার ফল। এই নজিরগুলো প্রমাণ করে যে সংকটকালে সংসদীয় আলোচনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নীতি প্রণয়নে সহায়তা করে।
ভারতের নিজস্ব নজির— ভারতের সংসদেও এমন নজির রয়েছে। ২০০১ সালে সংসদ ভবনে হামলার পর লোকসভার একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হয়। এই অধিবেশনে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি এবং ‘প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট’ (পোটা) প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা হয়। একইভাবে, ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার পর সংসদে আলোচনা জাতীয় তদন্ত সংস্থা (NIA) গঠনের পথ প্রশস্ত করে। এই নজিরগুলো দেখায় যে সংসদীয় আলোচনা জাতীয় সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়া ও স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তা— পহেলগাঁও হামলার পর ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়া, যেমন ‘অপারেশন সিন্দুর’, জনমনে প্রশ্ন তুলেছে। বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, “পাহালগাম হামলা, অপারেশন সিন্দুর এবং সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা নিয়ে সংসদে স্বচ্ছ আলোচনা প্রয়োজন।” একটি গণমাধ্যম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সামরিক পদক্ষেপের পাশাপাশি গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা নিয়েও পর্যালোচনা প্রয়োজন।” সংসদের অধিবেশন এই ব্যর্থতাগুলো চিহ্নিত করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করবে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর সংসদে আলোচনা সরকারকে গোয়েন্দা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে এবং সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে বাধ্য করেছিল। একইভাবে, পহেলগাঁও হামলার পরও সংসদীয় আলোচনা সরকারকে আরও কার্যকর কৌশল গ্রহণে প্ররোচিত করতে পারে।
জনগণের আস্থা ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা— সংসদের বিশেষ অধিবেশন জনগণের আস্থা বাড়াতে এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ। কপিল সিব্বল বলেছেন, “একটি বিশেষ অধিবেশন সকলের পরামর্শ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন। জাতি সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে।” একাডেমিক গবেষকরা যুক্তি দেন যে, সন্ত্রাসী হামলার পর সরকারের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। সংসদীয় আলোচনা এই ফাঁক পূরণ করে এবং জনগণকে সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে।
UNGA-র প্রেক্ষাপটে, ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপে জনগণের সমর্থন অর্জনের জন্য স্বচ্ছ আলোচনা অপরিহার্য।” ভারতের সংসদও এই নীতি অনুসরণ করে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে।
পাহালগাম হামলা ও ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে লোকসভার বিশেষ অধিবেশন আহ্বান জাতীয় নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা এবং জনগণের আস্থা বাড়ানোর জন্য অপরিহার্য। মার্কিন কংগ্রেস, যুক্তরাজ্যের সংসদ, ফরাসি সংসদ এবং UNGA-র নজির প্রমাণ করে যে সংকটকালে সংসদীয় আলোচনা নীতি প্রণয়ন ও জাতীয় ঐক্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারতের নিজস্ব ইতিহাসও এই পথ দেখায়। এই অধিবেশন সরকারের সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে, গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা চিহ্নিত করবে এবং ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর কৌশল প্রণয়নে সহায়তা করবে। এখন সময় এসেছে ভারতের সংসদ তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করুক এবং জাতিকে একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাক।