উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর অল, নো পলিটিক্স প্লিজ

আর কতদিন? নাকি ভুয়ো আন্দোলনকে অক্সিজেন দিতে তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করছে সিবিআই? সেই সঙ্গে আন্দোলন আর প্রতিবাদের চেহারা, চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠবেই। লিখছেন তানিয়া রায়

Must read

চোদ্দো দিন ধরে আরজি কর-কাণ্ডের তদন্ত করছে সিবিআই। সেই তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন নির্যাতিতার পরিবারও। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথার প্রতিধ্বনি তাঁদেরও গলায়। কেন আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে এখনও সিবিআই গ্রেফতার করছে না?
একই ইস্যুতে দু-দুটো বনধ। একটি ডেকেছিলেন বামপন্থীরা আর একটি একটি উগ্র দক্ষিণ পন্থী দল। দুটো বন্‌ধকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন মানুষ। বারাসত থেকে বনগাঁ কিংবা বসিরহাট, বিজেপির ডাকা বন্‌ধের কোনও প্রভাবই পড়ল না কলকাতা ও শহরতলিতে। স্বাভাবিক ছিল জনজীবন। সাধারণ মানুষ থেকে নিত্যযাত্রীরা কার্যত প্রত্যাখ্যান করেছেন বন্‌ধকে। দুটি বন্‌ধকেই। মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব ও প্রশাসনে ভরসা আছে তাঁদের।

কি না করেছে বিজেপি আন্দোলন সফল করার জন্য? স্টেশনে স্টেশনে রেল অবরোধ। যাত্রীদের গাড়ি থামিয়ে নামিয়ে দেওয়া। গাড়িতে ভাঙচুর। টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ। পার্টি অফিসে অগ্নিসংযোগ, বেশ কয়েকটি বাইক ভাঙচুর, কোচবিহারের মাথাভাঙায় সরকারি বাস ভাঙচুর এবং শিলিগুড়ি শহরে স্কুল পড়ুয়াদের বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। নবান্ন অভিযানের নামে চলেছে সীমাহীন তাণ্ডব। এসবের জেরে শুধুমাত্র সরকারি সম্পত্তি নষ্টই হয়নি, একাধিক পুলিস কর্মী জখমও হয়েছেন। আন্দোলন করার অধিকার রয়েছে সকলের। তাই বলে তাণ্ডব চালানোকে কোনও মতেই সমর্থন করা যায় না। মানুষ সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আসলে ‘লাশ’ খুঁজতে আসা ‘ভেকধারী ছাত্রদের’ নবান্ন অভিযান ব্যর্থ হতেই ১২ ঘণ্টার ‘কর্মনাশা’ বাংলা বন্‌ধের ডাক দিয়েছিল বিজেপি। রাস্তায় নেমে সেই বন্‌ধ প্রত্যাখ্যান করেছেন সাধারণ মানুষ। ব্যবসায়ী, খেটে খাওয়া লোকজন, চাকুরিজীবী আর পড়ুয়ারা কেউই ধর্মঘটে শামিল হননি। তবে দিনটিকে কর্মনাশা করতে চেষ্টার কসুর করেনি পদ্মপার্টি। কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ, কোথাও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ আবার কোথাও তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধে ভেস্তে যায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সেই চেষ্টা। উলুবেড়িয়া শুড়িখালি লেবুতলার কাছে বিজেপির অবরোধ চলার সময় সার্ভিস রোড দিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কমীদের নিয়ে একটি বাস কলকাতার দিকে যাচ্ছিল। বাসটি ঘাটাল থেকে এসেছিল। সেই সময় বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা সেই বাসে হামলা চালায়। মারধরও করা হয় কয়েকজন টিএমসিপি সমর্থককে। ঘটনায় দোষীদের গ্রেফতারের দাবিতে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মী-সমর্থকরা বেলতলার কাছে জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন। নামানো হয় র‍্যাফ। পুলিস দোষীদের গ্রেফতারের আশ্বাস দিলে অবরোধ উঠে যায়।

আরও পড়ুন- মেঘালয়ের বিরোধী দলনেতা মুকুল সাংমাকে অভিনন্দন অভিষেকের

গদ্দার কুলের পোদ্দার অধিকারী হালে পানি পাচ্ছে না বুঝে বন্‌ধ সফল করতে পদ্মপার্টি সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী হয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরে। বুধবার সবচেয়ে বড় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে সেখানেই। জেলার দীঘাগামী সড়কের নাজিরবাগানে দু’টি সরকারি বাস আটকানো হয়। তারপর যাত্রীদের নামিয়ে একটিতে ভাঙচুর ও অপরটিতে আগুন লাগায় বিজেপি কর্মীরা। আক্রমণ করা হয় পুলিসকে।

নবান্ন অভিযানে ‘ছাত্র সমাজে’র ছোঁড়া ইটে সম্ভবত চিরকালের মতো দৃষ্টি হারাতে বসেছেন কলকাতা পুলিসের সার্জেন্ট দেবাশিস চক্রবর্তী। তাঁর বাম চোখের রেটিনা এবং কর্নিয়া দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত। হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুক খুললেই ভেসে আসছে সাদা উর্দিতে রক্তাক্ত অসহায় দেবাশিসের একহাতে চোখ আগলে থাকা ছবিটা। একটাই আর্তি। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ফর দেবাশিস চক্রবর্তী। ডিসির নির্দেশে ১১ নম্বর ফার্লং গেট থেকে বাবুঘাটের দিকে যাচ্ছিলেন দেবাশিস। আচমকাই রেড রোডে পুলিসের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট ছুঁড়তে শুরু করে বিক্ষোভকারীরা। প্রথম ইটটাই গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের কাঁচ ভেঙে তাঁর চোখে এসে লাগে। বাঁ চোখ থেকে অঝোরে রক্ত পড়তে শুরু করে। তারপর আর ওই চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। মঙ্গলবার রাতেই জরুরি ভিত্তিতে চোখে অপারেশন করা হয়েছে। জানেন না আর কোনও দিন ওই চোখে দেখতে পাবেন কি না!

রায়গঞ্জ শহরে এক মহিলা কনস্টেবল বন্‌ধ সমর্থকদের রাস্তা থেকে সরাতে গেলে তাঁর হাতেই কামড় বসিয়ে দেন বিজেপির উত্তর দিনাজপুর জেলা সম্পাদক ফাল্গুনী চক্রবর্তী! এক মহিলা চিকিৎসকের উপর নির্যাতনের সুবিচার চাইতে নেমে আরেক মহিলাকে কীভাবে কেউ আক্রমণ করতে পারেন কেউ! আসলে বিজেপি বিচার চাইতে রাস্তায় নামছে না। তার বদলে চক্রান্ত করে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করাই তাদের উদ্দেশ্য। এটাও মানুষ বুঝে গেছেন। হাতে গোনা বিজেপি নেতা ও কর্মীরা জোর করে যানচলাচল স্তব্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। দোকানদার, গাড়ি চালকদের আঙুল উঁচিয়ে হুমকিও দিচ্ছিলেন কয়েকজন। ব্যাঙ্ক, বেসরকারি অফিসে ঢুকে কাজ বন্ধ করতে বলেন তাঁরা। সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েন টোটো চালকরা। তাঁদের টোটোর চাবিও কেড়ে নেন বন্‌ধ সমর্থকরা। টায়ার জ্বালিয়ে, রাস্তায় বাঁশ রেখে অবরোধের চেষ্টা চালায় বিজেপি। পুলিশ সেসব হটাতে যায়। তাতেই রেগে অগ্নিশর্মা ফাল্গুনী চক্রবর্তী। তাঁকে ঘটনাস্থল থেকে সরাতে গেলে আচমকাই কামড় বসিয়ে দেন এক মহিলা কনস্টেবলের হাতে। বিজেপি এতটা আক্রমণাত্মক হওয়ার পরও জেলার স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, বাজার এদিন স্বাভাবিকই ছিল। মোহনবাটি, দেবীনগর, বন্দর, স্টেশন বাজারে অন্যদিনের মতোই ভিড় দেখা গিয়েছে।

মানুষ জাস্টিস চান, পলিটিক্স নয়। কিন্তু চিকিৎসকদের একাংশ সেটাই চান। তাঁরা কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন।
হাজার হাজার গরিব মানুষ বড় আশা নিয়ে গত কয়েকদিন আসছেন হাসপাতালে। ভিক্ষার ঝুলি ফেলে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসা মেলেনি। বড় ডাক্তারবাবুরা ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কতদিক সামলাবেন? ভোরবেলা এসে যাঁরা টিকিটের জন্য লাইন দিয়ে কাউন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁরাও জানেন সিস্টেমটা… প্রথমে দেখে দেওয়ার কাজটা ছোট ডাক্তারবাবুরাই করেন। তারপর প্রেসক্রিপশন যায় বড় ডাক্তারবাবুদের কাছে। এটা একটা চেইনের মতো। সেই চেইনের নীচের অংশটাই হাপিশ হয়ে গিয়েছে। কারণ, আন্দোলন চলছে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন… পায়ে ধরছি। কাজে ফিরে আসুন। তারপরও ছোট ডাক্তারবাবুরা শুনছেন না। আরজি কর হাসপাতালে যা হয়েছে, তার থেকে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। যে আন্দোলনে ডাক্তারবাবুরা নেমেছেন, তাতে সায় আছে সবারই। সবাই জানেন, একটা হেস্তনেস্ত দরকার। কীভাবে? জানেন না।

ওই যে ওরা বলছে,বিচার চাই। ওটা পেতেই হবে। তাহলে কোনও মেয়ের আর ডাক্তার দিদিমণির মতো অবস্থা হবে না। স্বপ্ন দেখেন সবাই। কিন্তু আর কোনও উপায় কি নেই? ডাক্তারবাবুরা রোগী না দেখলে কি সেই বিচার পাওয়া যাবে? আন্দোলন কি অন্য কোনওভাবে হতে পারে না? এই প্রশ্ন আজ গরিব মানুষের ঘরের কোনায় কোনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। গরিব হওয়াটা আজ তাঁদের কাছে দোষের। বড় সরকারি হাসপাতালের ভরসায় বেঁচে থাকাটা তাঁদের কাছে অপরাধের। আজ না হয় কাল ডাক্তার দিদিমণির খুনির বিচার হবে। কিন্তু এই গরিব মানুষগুলোর বিচার?
জাস্টিস তো চাই সবারই।

Latest article