বিদ্যালয় শিক্ষায় এগিয়ে বাংলা

১৯৯৩ সালে ‘যশ পাল কমিটি’ বিদ্যালয় শিক্ষা বিষয়ে সারা ভারতে সমীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সুপারিশমূলক রিপোর্ট পেশ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে।

Must read

অভীক মজুমদার: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ গঠন করেন। সেই কমিটি ছিল সম্পূর্ণত শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাবিদদের নিয়ে। এমন কোনও সারস্বত উৎকর্ষের কমিটির পরিকল্পনা, এ রাজ্যের তো বটেই, গোটা দেশেই ছিল না। এই অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গিই শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাকে এগিয়ে দিয়েছে।ওই কমিটির ওপর দায়িত্ব ছিল বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি এবং পাঠ্যপুস্তকের পর্যালোচনা, পুনর্বিবেচনা এবং পুনর্বিন্যাসের প্রক্রিয়া পরিচালনা করা। জাতীয় পাঠ্যক্রমের রূপরেখা (NCF 2005) এবং শিক্ষার অধিকার আইনে (RTE 2009) এই নথি দু’টিকে সম্যকভাব অনুধাবন করা এবং প্রয়োজনীয় অংশকে গ্রহণ করার প্রস্তাবও ছিল। মোদ্দা কথা হল, রাজ্যের শিশুরা যাতে আধুনিক, আনন্দময় এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা লাভ করতে পারে, তার অনবদ্য উদ্যোগ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর দূরদৃষ্টিতে নিশ্চিত হয়েছিল।কমিটির নির্মাণের প্রথম পর্বটিতে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু উল্লেখযোগ্য পরিচর্যা করেছিলেন।

আরও পড়ুন-মাওবাদীদের বিস্ফোরক প্রাণ কাড়ল সাংবাদিকের

গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তৈরি হয়েছে নতুন পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি, পাঠ্যপুস্তক, নতুন মূ্ল্যায়ন পদ্ধতি এবং সর্বোপরি শ্রেণিকক্ষে পঠনপাঠনের নতুন দিশা হয়েছে শিক্ষক-প্রশিক্ষণও। মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ছাড়াও হিন্দি, উর্দু, নেপালি, সাঁওতালি এবং ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া চালানো হয় ফলে প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক ওই ভাষাগুলিতে অনূদিত হয়েছে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাজবংশী এবং কামতাপুরী ভাষাতেও অনুবাদ সম্পন্ন হয়েছে। সব ভাষা মিলিয়ে তৈরি হয়েছে প্রায় ৩০০টি পাঠ্যপুস্তক! তার সঙ্গে মূল্যায়ন, শ্রেণিশিক্ষা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য আরও প্রায় ৭৫টি পুস্তিকা। প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক রঙিন, মনোগ্রাহী অলংকরণে ভরিয়ে তুলেছেন বাংলার মান্য শিল্পীরা।

আরও পড়ুন-আমাদের সরস্বতী পুজো

পূর্বতন শিক্ষামন্ত্রী ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ উদ্যোগে, ইউনেসেফের সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে কয়েকটি বুনিয়াদি ক্লাসের ইংরেজি শিক্ষার বিশেষ ওয়ার্কবুক। একেবারে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষায় বিশেষ যত্নবান হবার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল।
পাঠ্যপুস্তকগুলির নির্মাণের সময় শিশুমনস্তত্ববিদ, শিশুসাহিত্য গবেষক, শিশুবিশেষজ্ঞদের পরামর্শ যেমন নেওয়া হয়েছিল, বিদেশ থেকে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক এবং পাঠ্যক্রমও আনা হয়েছিল। এখন যদি কেউ তুলনা করে দেখেন, দেখবেন শিশুশিক্ষায় অগ্রণীদেশ, যেমন ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার পাঠ্যক্রমের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে আমাদের পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, শিশু যা শিখবে তা যেন ‘প্রয়োগ করিতে পারে’। অর্থাৎ মুখস্থবিদ্যা নয়, বিদ্যাকে আত্মস্থ করাই শিক্ষা। সেকথা মাথায় রেখে, বিশেষত বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস এবং গণিতের বইয়ে জোর দেওয়া হয়েছে ‘অ্যাক্টিভিটি বেসড লার্নিং’ বা ‘এবিএল’-এর ওপর। প্রতিটি ধাপে ধারণা বা কনসেপ্টটিকে প্রাঞ্জল করে তোলা হয়েছে শিক্ষার্থীর কাছে। অভিজ্ঞতা, আবিষ্কার আর অনুসন্ধিৎসা পাঠ্যপুস্তকের তিনটি মূুল অভিমুখ। এভাবেই শিক্ষা হয়ে ওঠে আনন্দময়।

আরও পড়ুন-স্কুলের সরস্বতী পুজোর থিমে নারায়ণ দেবনাথ

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সময়ে প্রথমেই থাকত ‘সংজ্ঞা’। তারপর ব্যাখ্যা। তারপর দৃষ্টান্ত। ‘সংজ্ঞা’-র প্রতিটি দাঁড়িকমা মুখস্থ করে খাতায় লিখতে হত। নতুন পাঠ্যপুস্তক, আধুনিক শিক্ষাপ্রয়োগে ঠিক উল্টোপথ নেওয়া হয়েছে। প্রথমে, ‘দৃষ্টান্ত’। তারপর ব্যাখ্যা। শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করা হয়েছে দৃষ্টান্ত থেকে বৈশিষ্ট্যগুলি বুঝে, নিজেই ‘সংজ্ঞা’ নির্মাণের দিকে এগোতে। যেমন, ভূমিরূপ বােঝাতে ভূগোল বইয়ে প্রথমেই দেওয়া আছে সিঙাড়া, টিফিন কেক আর বিস্কুটের ছবি। পর্বত, মালভূমি আর সমতলকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তারপরে। প্রতিটি বইয়ে পর্যাপ্ত অনুশীলনী এবং প্রাসঙ্গিক নানা আকর্ষণীয় উপাদান রয়েছে যা হাতে-কলমে শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের দুনিয়ায় নিয়ে যাবে। মহামতি কনফুশিয়াস একদা বলেছিলেন, ‘I see and I forget, I hear and I forget, but I do and I remember.’ প্রয়োগের মাধ্যমে যা শেখা যায়, কেউ ভোলে না।

আরও পড়ুন-পুরভোটের পরেই নির্বাচন আইএন টিটিইউসি

১৯৯৩ সালে ‘যশ পাল কমিটি’ বিদ্যালয় শিক্ষা বিষয়ে সারা ভারতে সমীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সুপারিশমূলক রিপোর্ট পেশ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। দেশের শিক্ষা ইতিহাসে এই ‘Learning without Burden’ বা ‘ভারমুক্ত শিখন’ শীর্ষক গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনটি বিখ্যাত। নতুন পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি এবং বিশেষত পাঠ্যপুস্তক নির্মাণে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ এই রিপোর্টের বহু পরামর্শ গ্রহণ করেছেন।
এত সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং প্রয়োগ অন্য কোনও রাজ্যে হয়েছে বলে জানা নেই। এই কাজে বহু মান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা, অধ্যাপক-গবেষক, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ নিষ্ঠায়, স্বপ্নে, শ্রমে অবদান রেখেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ, বিবেক দেবরায়ের নেতৃত্বে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশে বৃহদাকার রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। একে বলা যায়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভূতপূর্ব উদ্যােগের স্বাভাবিক পরিণতি।

আরও পড়ুন-সরস্বতী পুজোয় অভিষেক-পুত্রের হাতেখড়ি  

শিক্ষা সর্বদেশে সর্বকালে এক প্রবহমান চর্চার বিষয়। প্রায় প্রতিদিন সারা বিশ্ব জুড়ে নতুন নতুন গবেষণায় খুলে যাচ্ছে বিদ্যালয়শিক্ষার অভিনব সব সোনার দুয়ার। ফলে, প্রতিমুহূর্তে সেইসব প্রেক্ষিতগুলিকে পরিগ্রহণ করা প্রয়োজন। একটা কথা বলতেই হবে, নতুন পাঠ্যপুস্তকে দেশের সামগ্রিক ইতিহাস তো বটেই, বিশেষত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তার সঙ্গে যুক্ত মনীষীবর্গের জীবনকথা ইতিহাস বই তো বটেই, ভাষা-সাহিত্য বইতেও এত অনুপুঙ্খে এবং বিস্তারে শিক্ষার্থীদের সামনে বারংবার আনা হয়েছে তার জুড়ি মেলা ভার। সারা দেশ জুড়ে যখন ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে প্রতিদিন, তখন এই বইগুলি ভারত ইতিহাসের প্রকৃত তথ্যকে, অনির্বাণ সত্য এবং গরিমাকে প্রতিফলিত করছে। বিশ্বসাহিত্য এবং ভারতীয় সাহিত্যের বহু মণিমাণিক্য পাঠ্যপুস্তকে আজ উজ্জ্বল। বিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম নানা বিষয় সহজ ভাষায় প্রতিফলিত। সব মিলিয়ে এমন শিক্ষাসম্ভার সারা দেশের নিরিখে এককথায় অনন্য।

আরও পড়ুন-আজ সরস্বতীর আরাধনায় ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিক অভিনন্দন

বর্তমানে, বিদ্যালয় শিক্ষার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেছেন ব্রাত্য বসু। বিদ্যালয় শিক্ষার নবদিগন্ত আগামী দিনেও একই প্রভায় জাগরূক থাকবে একথা নিশ্চিত। শিশুশিক্ষার্থীই আমাদের ভবিষ্যৎ। বিদ্যালয় শিক্ষাই তাদের তৃতীয় নয়ন উন্মোচিত করে, তাদের দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করে। সেই চরৈবতি মন্ত্র অম্লান দীপ্তিতে উচ্চারিত হয়ে চলুক।

Latest article