বাণিজ্যের বলয়ে পশ্চিমবঙ্গ নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছে

এগিয়ে বাংলা। সর্বক্ষেত্রে। অগ্রগমনের অগ্রণী চিহ্ন প্রতিটি পর্যায়ে। বিপণন কৌশল বা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি যদি ঠিকঠাক থাকে তবে ব্যবসায় সাফল্য নিশ্চিত হয়। এই পর্যায়েও নজর কাড়ছে বাংলা। বাংলা মানেই তাই আজ ব্যবসা। বেঙ্গল মিনস বিজনেস। লিখছেন জিয়ান কর্মকার

Must read

যে কোনও ব্যবসার সাফল্যের গল্প মূলত বিপণন কৌশলের ওপর নির্ভর করে। একটি কার্যকর বিপণন কৌশল শুধু ব্যবসার ভোক্তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে না, ব্যবসার পরিসর বাড়াতেও সাহায্য করে। বিপণন কৌশল সাধারণত কিছু উপাদানের মিশ্রণ সেগুলো হল প্রচার, বিজ্ঞাপন, সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি। বর্তমান সময়ে উপভোক্তাদের তথ্য প্রদান এবং সচেতন করে তোলা বিপণনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।
১৯০২ সালে মিশিগান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জজ বি ওয়ালড্রন প্রথম বিপণনের ওপর কোর্স শেখান। ১৯৬৭ সালে ফিলিপ কোটলার বিপণনের ওপর একটি প্রভাবশালী বই উপহার দেন যার নাম মার্কেটিং-এর মূলনীতি। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মেসোপোটেমিয়ার সভ্যতার ক্রেতারা যাতে পণ্য চিনতে পারে, তার জন্য পণ্যগুলোর গায়ে বিশেষ চিহ্ন তারা ব্যবহার করত। প্রাচীনকালে রোমান অস্ত্র নির্মাতারাও অস্ত্র চেনানোর জন্য বিশেষ চিহ্নের ব্যবহার করত। যা পরবর্তী সময়ে লোগো নামে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। বিপণন ব্যবস্থায় এই লোগো বা চিহ্নের গুরুত্ব কিন্তু অপরিহার্য। শিল্প বিপ্লবের সময়কালে উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটে। অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে জাতীয় স্তরে উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথম দিকে চাহিদার তুলনায় পণ্যের উৎপাদন সীমিত হওয়ার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলি অধিক মুনাফা অর্জনকেই বেশি প্রাধান্য দিত। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যন্ত্রপাতির আধুনিকতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসাধন এবং বিশ্বায়নের ফলে উৎপাদন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সময়কাল থেকেই বিপণন ব্যবস্থার রমরমা শুরু হয়। দেওয়াল লিখন, বিলবোর্ড, পোস্টার, সংবাদপত্র, টেলিভিশন থেকে শুরু করে আজ মোবাইল— সর্বত্র বিপণনের রমরমা।

আরও পড়ুন-আইএফএ স্টল উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী

বিগত কয়েকবছরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ব্যাপক উন্নতি করেছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে মহিলা উদ্যোক্তাদের রমরমা চোখে পড়ার মতো। মহিলা পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু ঋণ প্রদান ও আর্থিক সহায়তা কোনও সরকারের একমাত্র কাজ হতে পারে না, সরকারের আর্থিক সহায়তায় যারা ব্যবসার কাজে যুক্ত তাদেরকে মার্কেটিংয়ের ব্যবস্থা করাও অন্যতম কাজ। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ইউনিফর্ম তৈরি করে যেমন সরকারের সুবিধা করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করছে, তার বাইরেও কৃষি বহির্ভূত ক্ষেত্রে জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নে স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ জীবিকা মিশন (WBSRLM)-এর অধীনে স্ব-নিযুক্ত গোষ্ঠীগুলির দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রয় ও প্রসারের জন্য ‘সৃষ্টিশ্রী’ বিপণন কেন্দ্র সুচারুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এমন ৩১২টি স্ব-নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে খাদ্য সরবরাহ করার জন্য সংযুক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে যা ‘খাদ্যছায়া’ (SHG Canteen & Cafeteria) নামে পরিচিত। রাজ্যের পুরসভাগুলোতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির বিভিন্ন সামগ্রী বিপণনের জন্য ২৮টি বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় স্ব-নিযুক্ত প্রকল্পের দ্বারা তৈরি হাতের কাজ এবং কৃষকদের সামগ্রী বিপণনের সাহায্য করতে কর্মতীর্থ চালু আছে।
স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং উদ্যোগপতিদের বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য ‘সবলা মেলা’ আয়োজন করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, যেখানে SHG’s, SVSKP (স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর কমসংস্থান প্রকল্প) কর্মোদ্যোগী এবং হস্তশিল্পীরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। ‘সুফল বাংলা’ কথাটি এখন ঘরে ঘরে প্রচলিত। ২০১৪ সালে ‘সুফল বাংলা’ প্রকল্পটি চালু হয়েছিল এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে কৃষকদের উৎপাদনের সঠিক মজুরি প্রদান করা যায় ও ক্রেতাদের সুলভ মূল্যে কৃষিজাত পণ্য পৌঁছানো যায়। এই মুহূর্তে তার পরিসর রাজ্য জুড়ে। ৪৮৪টি আউটলেট ও ৭টি বাল্ক ক্রয় হাব যার মাধ্যমে প্রায় ৩.৫০ লক্ষ ক্রেতা পরিষেবা পাচ্ছে। সুফল বাংলার মাধ্যমে বর্তমানে ৮০০০০ কৃষকের প্রতিদিন প্রায় ১০০ মেট্রিক টন ফসলের সংগ্রহ ও বিক্রয় সুনিশ্চিত করেছে। বর্তমানে সুফল বাংলার বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ১০৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে ৭৭টি নতুন বিপণন কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গ্রামীণ কৃষকদের উন্নত পরিকাঠামো ও সহজ বিপণন ব্যবস্থা প্রদান করার জন্য প্রায় ১৮৬টি ‘কৃষক বাজার’ এবং উপ-বিপণি কেন্দ্র চালু হয়েছে। ‘Ease of Doing Business’-এর সাহায্যে কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদন দ্রুত লেনদেনের জন্য অনলাইনে ‘Integrated Electronic Single Platform Permit’ (e-Permit) এবং ‘Unified Licence Systen’ (ULS) চালু হয়েছে। উপরিউক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১০৪৭৬৩৯টি e-Permit এবং ৩৫৮৮২টি লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ১৫টি জেলায় ১৮টি শস্যবাজার e-NAM (Electronic National Agriculture Market) পোর্টালর অন্তর্ভুক্ত। যার মাধ্যমে ৭৯১৮৮ জন সহযোগী (Stakeholder) তাঁদের শস্যসামগ্রী লেনদেন করে। যার মূল্য আনুমানিক ১০১.০৪ কোটি টাকা। ডেয়ারি শিল্পে শুধু উন্নতিসাধন নয়, বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাও করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বর্তমানে বাংলায় ৫৭৬টি ডেয়ারি খুচরো বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১.৪০ লক্ষ লিটার দুধ বিক্রয় হয় এবং সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত দ্রব্য যেমন পনির, ইয়োগার্ট, মিষ্টি দই, টক দই, ঘি, পেঁড়া এবং আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে। হরিণঘাটা খুচরো মাংস বিক্রয়কেন্দ্র বৃদ্ধি পেয়ে ৯৬টি হয়েছে। বাংলার ঐতিহ্যশালী শাড়ি-সহ সমস্তরকমের হাতে বোনা শাড়ি এক ছাতার তলায় প্রদর্শনের জন্য তন্তুজর আওতায় ‘বাংলার শাড়ি’ ব্র্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হল বাংলার শাড়িকে সকল নারীদের কাছে সুলভমূল্যে পৌঁছে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তাকে তুলে ধরা। এখন পর্যন্ত সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে চারটি প্রদর্শনী বিপণি কেন্দ্র আছে। দুটি কলকাতায় (দক্ষিণাপন এবং ধনধান্য) একটি পূর্ব মেদিনীপুরের নিউ দীঘায়, অপরটি নিউ দিল্লির বঙ্গভবনে। উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়া ও নদীয়ার শান্তিপুরে টেক্সটাইল হাট-এর নির্মাণ হয়েছে।

আরও পড়ুন-৯ বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি মামলা

২০২৩-এর ডিসেম্বর অবধি তন্তুজা, মঞ্জুষা, পশ্চিমবঙ্গ রেশম শিল্পী, বিশ্ববাংলা মার্কেটিং কর্পোরেশন এবং বঙ্গশ্রীর সম্মিলিত ব্যবসার পরিমাণ ৩৫০ কোটি টাকা। রাজ্য জুড়ে ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে ৩১টি মেলা সংগঠিত করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ বিভাগকে মোট ২৭৭.৭৭ কোটি টাকা ব্যবসায়িক লেনদেনের সাফল্য এনে দিয়েছে। রাজ্যে উন্নতমানের ‘ট্রেডিং হাব’ গড়ে তোলার জন্য বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ধারাবাহিক উন্নতির জন্য ৪টি সাধারণ সহায়তা কেন্দ্র বর্তমানে চালু আছে এবং খাদি উৎপাদন কেন্দ্র ও স্টল-সহ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প প্রকল্পের জন্য ক্লাস্টার উন্নয়ন পদ্ধতিতে ১১টি CFC/CPC স্থাপিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্থানীয় শিল্প অথাৎ টেরাকোটার শিল্প, কৃষ্ণনগরের মাটির শিল্প, খাদি ও গ্রামীণ শিল্প, ডোকরা কারুশিল্প, জঙ্গলমহলের শাল পাতার শিল্প ইত্যাদিকে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন মেলার আয়োজন করে থাকে স্থানীয় ভাবে যেমন, টুসু মেলা, আছিপুরের চিনা মেলা, কেঁদুলির বাউল মেলা, ফুলিয়ার কৃত্তিবাস মেলা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন-বইমেলা বাংলার গর্ব, বইপ্রেমীর সংখ্যা কোটিতে পৌঁছবে : উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী

পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরবর্তী সময়ে স্থানীয় শিল্পগুলোকে নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবে। নবতম সংযোজন শৈলেন মান্না সরণি, যেখানে নতুন কর্মতীর্থ হবে। আসলে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে শিল্পকে শুধু নামে নয়, কাজেও প্রকাশ করা উচিত। রাজ্যের এই মুহূর্তে পাখির চোখ শিল্প। শিল্পের বিকাশের প্রধান হাতিয়ার বিপণন। বিপণন কৌশল যদি ঠিকঠাক থাকে তবে শিল্পের সাফল্য অবধারিত। তাই পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে বিপণনও সমান ভাবে সাফল্যের দাবি রাখে।

Latest article