পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সুস্বাস্থ্য প্রশ্নাতীত, তবুও!

মোট রাজস্ব আয়ে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার প্রভাব স্পষ্ট। তবে বামফ্রন্টের শেষ বছরে শুধু বেতন, পেনশন আর সুদ বাবদ রাজস্বের ৯৯ শতাংশ খরচ হত। এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৭৭ শতাংশে। এর থেকেই প্রমাণিত এগিয়ে বাংলা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। আজ শেষ পর্বে লিখছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক ড. দেবনারায়ণ সরকার

Must read

(গতকালের পর)
ঘাটতি
রাজ্যের আর্থিক সুস্বাস্থ্যের সপক্ষে প্রথম শর্তটি হল রাজস্ব খাতে কোনও ঘাটতি চলবে না যাকে বলা হয় গোল্ডেন রুল, অর্থাৎ চলতি খাতে ব্যয় (যেমন বেতন, পেনশন, সুদ ইত্যাদি) কোনও ঋণ চলবে না। কিন্তু বামফ্রন্ট আমল থেকে রাজস্ব খাতে ক্রমশ এই ঘাটতি চলে আসছে। তবে বর্তমান আমলে জিএসডিপির অনুপাতে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন অর্থবছর ব্যাতিরেকে রাজ্য ও রিজার্ভ ব্যাংকের উভয়ের তথ্য রাজস্ব (Revenue) ঘাটতি ক্রমশ কমছে। বামফ্রন্টের শেষ অর্থ বছরে এই অনুপাত ছিল ৩.৭৫। উপরোক্ত বছরগুলোতে এই অনুপাত যথাক্রমে ২.৩৯ ১.৮০, ১.৫৬, ২.৩৮ ও ১.৭৪। রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্যে এই অনুপাত যথাক্রমে ২.৩, ১.৮, ১.৭ ও ১.৭। তবে ২০২৫-’২৬ সালের বাজেটে ২০২৩-’২৪ অর্থবছরে যে প্রকৃত হিসাব উপস্থাপিত হয়েছে তাতে রাজস্ব ঘাটতি বেশ কিছুটা হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে সরকার— বাজেট এস্টিমেট অপেক্ষা হ্রাস পেয়েছে ৫২৩৩ কোটি টাকা এবং সংশোধিত হিসাব অপেক্ষা কমেছে ২৫৬১ কোটি টাকা। সাধারণ রাজ্যগুলির সঙ্গে তুলনায় দেখা গেছে ২০২১-’২২ অর্থ বছর থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে রাজস্থান, পাঞ্জাব ও অন্ধপ্রদেশ রাজ্যে জিএসডিপির অনুপাতে রাজস্ব ঘাটতি পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি। তবে তামিলনাড়ু, বিহার, হরিয়ানা রাজ্যে এই অনুপাত পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কম হলেও ওই অনুপাত এই রাজ্যগুলির প্রতিটিতে ১ শতাংশের বেশি।
এবার রাজকোষ (Fiscal) ঘাটতির প্রসঙ্গে আসা যাক। রাজ্যের তথ্যে দেখা গেছে ২০২৪-’২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ব্যতিরেকে ২০২১-’২২ অর্থবছরের পরবর্তী সময়ে রাজ্যের জিএসডিপির অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতি হ্রাস পেয়েছে। উপরোক্ত অর্থবছরগুলোতে এই অনুপাত যথাক্রমে ৩.৭৭, ৩.৩০, ৩.২৭, ৪.০২ ও ৩.৬০। রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্য এই অনুপাতে যথাক্রমে ৩.৭, ৩.৩. ৩.৫ ও ৩.৬। তবে ২০২৩-’২৪-এর অর্থবছরের প্রকৃত হিসাবে বাজেট এস্টিমেট অপেক্ষা রাজকোষ ঘাটতি হ্রাস পেয়েছে ১১,৮৪৫ কোটি টাকা এবং সংশোধিত হিসাব অপেক্ষা কমেছে ৫৩১২ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে সাধারণ রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা জিএসডিপির অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতি বেশি পাঁচটি রাজ্যে অন্ধপ্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব, রাজস্থান ও তামিলনাড়ুতে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মধ্যপ্রদেশের অনুপাতে পশ্চিমবঙ্গের সমান হলেও পরবর্তী সময় পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি।
রাজস্ব আয় ও রাজস্ব ব্যয়
রাজ্যের বিপুল খরচ সংকলনের মূল হাতিয়ার রাজ্যের রাজস্ব আয়। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের পরবর্তী সময়ে রাজ্যের রাজস্ব আয়ে কেন্দ্রের তীব্র আর্থিক ব়ঞ্চনার চিত্র সুস্পষ্ট। এর ফলে ২০২৩-২৪ অর্থববছর থেকে রাজ্যের রাজস্ব আয়ের বৃদ্ধির মাত্রা যথেষ্ট কমেছে। রাজ্যের রাজস্ব আয়ের চারটি খাত রয়েছে— নিজস্ব কর রাজস্ব, নিজস্ব কর নিরপেক্ষ রাজস্ব, কেন্দ্রের নিকট হতে প্রাপ্য রাজ্যের করের অংশ এবং কেন্দ্রীয় অনুদান সাহায্য।
প্রথমে নিজস্ব কর রাজস্ব প্রসঙ্গে আসা যাক। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিজস্ব কর রাজস্ব বাবদ আদায় ৬০২৮৭ কোটি টাকা। ২০২১-২২, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪, ২০২৪-২৫ সংশোধিত ২০২৫-২৬ (বাজেট টেস্টিমেন্ট) অর্থবছরে নিজের কর রাজস্ব বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১৭.৯০, ১৭.৬২, ৭.৬২, ১০.৯৭ ও ১২.৬৯। রাজ্যের জিএসডিপি-র অনুপাতে নিজস্ব কর রাজস্ব যথাক্রমে ৫.৩০, ৫.৫২, ৫.৪৫, ৫.৫০ এবং ৫.৫৪। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যে ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ (সংশোধিত) এবং ২০২৪-২৫ (বাজেট এস্টিমেট) অর্থবছরে এই অনুপাত যথাক্রমে ৫.৫, ৫.২ এবং ৫.৫। বামফ্রন্টের শেষ বছরের এই অনুপাত ছিল ৪.৫। একমাত্র ২০২৩-২৪ অর্থবছর ব্যতিরেকে রাজ্যের কর রাজস্ব আদায় ১০ শতাংশের বেশি। নিঃসন্দেহে রাজোর ক্রমবর্ধমান ব্যয় সংকুলানের জন্য জিএসডিপি-র অনুপাতে নিজস্ব কর রাজস্ব আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বেশ কিছু সাধারণ রাজ্যে এই অনুপাত পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে যথেষ্ট বেশি। তবে গুজরাতের মতো শিল্পোন্নত রাজ্যে ২০২৩-২৪, ২০২৪-২৫ (সংশোধিত) ২০২৫-২৬ (বাজেট এস্টিমেট) অর্থবছরে এই অনুপাত যথাক্রমে ৫.৭, ৫.৪ ও ৫.৫।
এবার কর রাজস্বের চতুর্থ ক্ষেত্র অর্থাৎ কেন্দ্রীয় অনুদান প্রসঙ্গে আসা যাক। ২০২০-২১, ২০২১-২২ ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পশ্চিমবঙ্গে রাজস্ব আয় কেন্দ্রীয় অনুদান যথাক্রমে ৩৮,১৭১ কোটি টাকা, ৩৯,৮৪৬ কোটি টাকা, ৩৮,৩০৩ কোটি টাকা ও ২২,০৭২ কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ্য, বামফ্রন্টের আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সরকারের আমলে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় পরবর্তী বছরগুলোতে এই অর্থ স্বাভাবিকভাবে ক্রমশ বেড়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে একমাত্র ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় কেন্দ্রীয় অনুদান এক ধাক্কায় ২০২৩- ২৪ অর্থবছরে ১৬,২৩১ কোটি টাকা হ্রাস পেল। ২০২২-২৩-এর তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে কেন্দ্রীয় অনুদান ব্যতিরেকে রাজস্বের প্রথম তিনটি খাত একত্রে অতিরিক্ত রাজস্ব বেড়েছে ২০,৯৫৬ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১৩.৪। কার্যত, কেন্দ্রীয় অনুদান এক ধাক্কায় ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি হ্রাস পাওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে মোট রাজস্বের অতিরিক্ত বাড়ল মাত্র ৪৭২৩ কোটি টাকা এবং বৃদ্ধির হার এক ধাক্কায় নেমে দাঁড়াল ২.৩৬। কিন্তু ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থ বছরে মোট রাজস্ব বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২০.০৫ ও ৯.৭৬ এবং টাকার অংকে অতিরিক্ত রাজস্ব বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ২৯,৭৬৬ কোটি টাকা ও ১৭,৩৮৫ কোটি টাকা।
মোট রাজস্ব আয়ে কেন্দ্রীয় আর্থিক বঞ্চনার প্রভাব ২০২৪-২৫ (সংশোধিত) ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও পড়েছে তা বাজেটের তথ্য থেকে স্পষ্ট। ২০২৪-২৫ (সংশোধিত) ও ২০২৫-২৬ (বাজেট এস্টিমেট) অর্থবছরে কেন্দ্রীয় অনুদান সাহায্য যথাক্রমে ২৮,৪৩১ কোটি টাকা ৩৭,১৫৭ কোটি টাকা ধরে নিয়ে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় রাজস্ব বৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে যথাক্রমে ১৩.৬৪ ও ১৬.৯০। কেন্দ্রীয় অনুদান কমলে এই হারও কমবে।
রাজ্যের রাজস্ব আয়ে ক্রমশ কেন্দ্রীয় অনুদান হ্রাসের ঋণাত্মক প্রভাব যে ২০২৪-২৫ ও ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে পড়তে চলেছে তা রাজ্যের মধ্যমেয়াদি আর্থিক দলিলে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের পরিসংখ্যান থেকেই দেখা যাচ্ছে। বাজ্যের রাজস্ব আয়ের অনুপাতে রাজস্ব ব্যয় বামফ্রন্টের শেষ বছরের তুলনায় ক্রমশ কমেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে এই অনুপাত ছিল ১৩৬.৫৫, ২০২০-২১ থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে এই অনুপাত যথাক্রমে ১১৯.৯০, ১১৭.৯৬, ১১৩.৯৬, ১১২.৮৩, ১১৯.০১ ও ১১৩.২৮। এখানে উল্লেখ্য যে, বামফ্রন্টের শেষ বছরে শুধুমাত্র বেতন পেনশন ও সুদ বাবদ ব্যয় ছিল মোট রাজস্বের ৯৯.১২%, যেখানে বর্তমান সরকারের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রকৃত তথ্য এই অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৭৭। তবে এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে ২০২৪-২৫ (সংশোধিত) বাজেটে এই অনুপাত হ্রাসের পরিবর্তে যথেষ্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৯.০১। এমনকী ২০২৫-২৬ (বাজেট) এই অনুপাত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় বেশি ধরা হয়েছে।
সর্বাধিক ভাবে বলা যায় রাজ্যের বর্তমান সরকার সামাজিক প্রকল্পে বিপুল ব্যয় বহন করা সত্ত্বেও জিএসডিপি অনুপাতে পরিকাঠামো উন্নয়নে মূলধনী ব্যয়, রাজস্ব ঘাটতি, রাজকোষ ঘাটতি ও রাজস্ব আয়ের অনুপাতে রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সদর্থক পদক্ষেপ সত্ত্বেও রাজস্ব আয়ে কেন্দ্রের তীব্র আর্থিক ব়়ঞ্চনা রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্যকে বর্তমানে যথেষ্ট বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তাই রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, কেন্দ্রের আর্থিক বঞ্চনার যন্ত্রণা নিয়েই মানুষের জীবনের পথ সুগম করার চেষ্টা রয়েছে বাজেটে। (শেষ)

আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসাপত্রে আপ্লুত রাজদীপ

Latest article