চিত্র এক : ৯ ডিসেম্বর, ২০১১। বাংলার রাজনীতিতে সবেমাত্র ঘটেছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। এমনই শীতের এক রাতে আকস্মিক শহর কলকাতা বিস্মিত হয়ে গেল শহরের অন্যতম এলিট বেসরকারি হাসপাতাল AMRI তে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে। সেদিন মানুষ সম্ভবত প্রথমবার দেখলেন, ওই ভয়াবহ সময়ে উদ্ধারকাজে কোনও মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং উপস্থিত থাকতে। ইঙ্গিত পাওয়া গেল কেবল রাজনৈতিক রঙের বদলই নয়, প্রকৃতই রাজ্যবাসীকে সুখে-দুঃখে বুকে আগলে রাখার মতো একজন কেউ মুখ্যমন্ত্রী পদে এবার আসীন হয়েছেন।
চিত্র দুই : ৩১ মার্চ, ২০১৬। তৃণমূল সরকার তখন প্রথম ৫ বছর অতিক্রম করে পুনরায় জনতার কাছে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত হচ্ছে। সেই বিধানসভা নির্বাচনী প্রাককালীন আবহেই ব্যস্ত শহরে ভেঙে পড়ল পোস্তা উড়ালপুল। রাজনীতির কারবারিরা যখন সবেমাত্র ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমেছেন, তখনও রাজ্যবাসী দেখলেন রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় নিজে নেমে এসেছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষ যে তাঁকে চিনতে ভুল করেনি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তার ক’মাস পরেই নির্বাচনে বৃহৎ সাফল্য।
চিত্র তিন : মার্চ, ২০২০। করোনা মহামারীর আবহে এক মুহূর্তে যেন ‘সব সঙ্গীত ইঙ্গিতে গেছে থামিয়া’। জীবনকে তুচ্ছ করে সেদিনও মানুষকে রক্ষা করতে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই।
চিত্র চার : ১৬ মে, ২০২০। কোভিড আবহের ভয়াবহতার মধ্যেই রাজ্যের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিল আমফান বিপর্যয়। ঝড়ের ফেনিল দাপটে যেন তছনছ হয়ে গেল গোটা রাজ্য তথা দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত অংশ। মানুষের ক্রন্দন কলরোলে যে অস্ফুট উচ্চারণ সুপ্ত ছিল, তা হল ‘সব শেষ’। কিন্তু বিপর্যয় যদি ভাঙনের ইতিহাস বলে, তাহলে তার নবনিমার্ণের ইতিহাসের রচয়িতার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রের পর্যাপ্ত সহযোগিতা ছাড়া একা এক হাজার কোটির বিপর্যয়কে বুকে নিয়েই শুরু করলেন নতুন করে জীবন-জীবিকা-যাপনের নির্মাণযজ্ঞ।
আরও পড়ুন-অনুপ্রেরণা মুখ্যমন্ত্রী, হেঁটেই জালিয়ানওয়ালাবাগের পথে বৃদ্ধ
এমন খণ্ড খণ্ড অসংখ্য চিত্র আমরা আরও অনেক লিখতে পারি। কিন্তু তার মধ্যে যে সাদৃশ্য লক্ষণীয়, যখনই রাজ্যের কোনও অংশে বিপর্যয় নেমে এসেছে, রাজ্যবাসী বিপর্যস্ত বোধ করেছেন, সবার আগে তাঁদের কাছে, তাঁদের রক্ষাকর্ত্রী রূপে ছুটে গিয়েছেন আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি অফিসে বসে ঠান্ডা ঘরের আরামে সরকার চালাননি, রাজ্য সম্পর্কে তাঁর গবেষণা ‘আর্ম চেয়ার রিসার্চ’ নন, তিনি স্থানে স্থানে ঘুরেছেন, দেখেছেন সেখানকার মানুষজন, তাঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, উদার চিত্তে অনুভব করেছেন তাঁদের চাহিদাকে এবং তাঁদেরই একজন হয়ে তাঁদের সমস্যাকে দূরীকরণের প্রচেষ্টা করেছেন। সম্ভবত এটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তিশালী দিক। যেকারণে এত কুৎসা, এত বিরুদ্ধ প্রচার, এত মিডিয়া ট্রায়াল, এত ইডি, সিবিআই সবাই ব্যর্থ হয়ে যায় তাঁর কাছে এসে। কারণ গত প্রায় দেড় দশক সময়ে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বারেবারে এইরূপে দেখে। মানুষের বিশ্বাস, আস্থা, ভরসার স্থল হয়ে উঠেছেন তিনি। হ্যাঁ, মানুষের অভাব-অভিযোগ যেমন তাঁকে ঘিরেই আবার তাঁর কাছেই প্রত্যাশা মুশকিল আসানের। বিরোধী রাজনীতির কারবারিরা কখনওই এই হৃদয়ের সংযোগটি করে তুলতে পারেনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রীর অসংখ্য জনমুখী প্রকল্প আলো এনে দিয়েছে দুঃসহ অন্ধকারে থাকা প্রান্তিক মানুষের জীবনে, যারা চিরকালের অবহেলিত, শোষিত। ‘কন্যাশ্রী’ তো আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ এনে দিয়েছে বাংলার ঘরে ঘরে মা-বোনেদের আর্থিক স্বাধীনতার অধিকারে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সুযোগ। আজ বাংলায় সম্ভবত এমন কোনও ঘর নেই, যেখানে কোনও না কোনও সরকারি প্রকল্পের সুবিধা বাংলার মানুষ পান না।
বড়দিন এবং নতুন বছরের সূচনার আবহে মনে আসে ছেলেবেলায় যেমন আমাদের সকল আস্থা বিশ্বাস, দাবি-দাওয়া, উপহারের প্রত্যাশা ঘিরে থাকত সান্তাক্লজের কাছে, আর আমাদের সান্তারূপী বাবারা সেই সকল ছোট-বড় চাওয়াকে আন্তরিকভাবে পূরণ করতেন গভীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে। পরে বুঝেছি যে কতটা ক্ষয়, কতটা ত্যাগ আর কতটা যন্ত্রণাকে চাপা দিতে হয় এই সান্তাদের তাঁদের প্রিয় সন্তানের মুখের এই হাসিটুকু দেখার জন্য। আর আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এই সম্পূর্ণ রাজ্যটিই তাঁর পরিবার, রাজ্যের প্রতিটি ধর্ম, বর্ণের মানুষই তাঁর আপনজন। বাম সরকারের নানান অবিমৃশ্যকারিতা, বিপুল ঋণের বোঝা, কেন্দ্রীয় সরকারের অনবরত বঞ্চনা, রাজ্যের প্রাপ্ত অর্থটুকু থেকেও বঞ্চিত করেন রাজ্যবাসীকে; এ পরিস্থিতিতেও রাজ্যের প্রতিটি মানুষকে যথাসম্ভব স্বাচ্ছন্দ্য, তাঁদের নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, প্রাপ্য আর্থিক ও সামাজিক অধিকারগুলি সুনিশ্চিত রূপে ফিরিয়ে দিতে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী।
পূর্বোক্ত চিত্রগুলি একদিকে মা-মাটি-মানুষের জন্য কল্যাণকামী কাজের দিকগুলি তুলে ধরে, তেমনই আজ কেন্দ্রীয় সরকার আবাস যোজনার টাকা বন্ধ করে দিয়ে ২০০ আসনের স্বপ্ন না পূরণের শাস্তি বাংলার মানুষকে দিচ্ছে সেখানেও মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষের ত্রাতা হয়েছেন। তিনি চাননি রাজ্যের কোনও দরিদ্র মানুষ নিজেদের মাথার উপর ছাদ, নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকুক। আজ ‘বাংলার বাড়ি প্রকল্প’তে ১২ লক্ষ পরিবার ৬০০০০ করে টাকা পেয়েছেন, আগামী বছরে মোট ২৮ লক্ষ পরিবারের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে যাবে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। এই অর্থবর্ষেই এই প্রকল্পের জন্য প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। কথা দিয়ে কথা রাখার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন্দ্রীয় বঞ্চনার আর এক নজির ১০০ দিনের কাজ। রাজ্যের মেহনতি মানুষের প্রাপ্য অর্থ থেকে এই বঞ্চনা তিনি চুপ করে বসে মেনে নিতে পারেননি। তাই তো ৩ ফেব্রুয়ারিতে রেড রোডের মঞ্চ থেকে তিনি ঘোষণা করেন, কেন্দ্র টাকা দিল ভাল, আর কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না তাঁর সরকার। সেই কথামতো রাজ্যের একুশ লক্ষ শ্রমিকের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে গিয়েছে রাজ্য সরকার থেকে প্রেরিত অর্থ। একইসঙ্গে রাজ্য সরকার ৫০ দিনের নিশ্চিত কাজের ঘোষণা করেছে।
আর এক বঞ্চনা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কার্যকর না করা। স্বাধীনতা থেকে বারেবারে কেন্দ্রের নানান সরকারের কাছে এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও দীর্ঘদিনের সমস্যার কোনও সমাধান ঘটেনি। কেন্দ্রের দায়িত্বভুক্ত এই প্রকল্প নির্মাণেরও সকল দায়ভার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিয়েছেন ঘাটালের মানুষের দীর্ঘকালীন যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার বাসনায়।
আরও পড়ুন-শ্রমিকদের সুরক্ষায় বাংলা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে বামশাসিত কেরল
এমনই আর এক বঞ্চনা ও দায়বদ্ধতার দুটি নিদর্শন পাওয়া যায় পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ লকডাউন করে দিয়ে যাতায়াতে যে বাধার সৃষ্টি করেছিল তার ফলে যেধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় তাতে রেললাইন যেমন পরিযায়ী শ্রমিকদের রক্তে রক্তাক্ত হয়েছে তেমনই ট্রেনের মধ্যে বা স্টেশনে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকের বুকের দুধ খেতে এক শিশুকে দেখা যায়। এমনই নানান দৃশ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থাকে ব্যক্ত করে। যখন প্রধানমন্ত্রীর নামে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য যে কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্প এল সেখানে ১৬৪ জেলার শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত হলেও পশ্চিমবঙ্গের কোনও জেলার নাম নেই। উল্টোদিকে বাংলার বিজেপি নেতারা প্রচার করলেন যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সব থেকে বেশি পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে কাজে যায়। চিত্র কিন্তু আলাদা। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা দফতর ২০২৪-এ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে পরিযায়ী শ্রমিকদের গন্তব্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় স্থানে রয়েছে। তেমনই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্মসাথী প্রকল্প গড়ে, বর্তমানে হাজারের বেশি পরিযায়ী শ্রমিককে কাজের সংস্থান করে দেওয়া গেছে।
রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রেও গত প্রায় এক যুগ সময়ে এসেছে অভূতপূর্ব বিস্তার। তৈরি হয়েছে ৫০টির উপর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। মাধ্যমিক থেকে পিএইচডি স্তর অবধি চালু হয়েছে বিবেকানন্দ মেরিট কাম স্কলারশিপ। শিক্ষার সুযোগ আজ অনেকটাই বিস্তৃত। তারসঙ্গেই বেড়েছে কর্মসংস্থানের চাহিদা। সেই সঙ্গেই এসেছে বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজনও। অতি সম্প্রতি রাজ্যে ইনফোসিসের বিনিয়োগ এল। যা চার হাজারের অধিক কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে। এসেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেমিকন্ডাকটর সংস্থা Global Foundries এর R&D ও কারখানার বিনিয়োগ। Matix Fertiliser পানাগড়ে তাদের কারখানা নির্মাণ করছে ৭৫০০+ কোটি বিনিয়োগে। সব মিলিয়ে আগামিদিনে রাজ্যের শিল্প চালচিত্রও যে উল্লেখযোগ্য উচ্চতাকে স্পর্শ করবে তা বলাই বাহুল্য।