আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে শামিল এক অভিনেত্রী সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘যাঁদের এখনও মনে হচ্ছে এই আন্দোলন জুনিয়র ডাক্তাররা শুধু এসি ঘর আর মহিলাদের টয়লেট-এর জন্য করছেন, তাঁদের জন্য পোস্ট করলাম এটা। ভাল করে পড়ে একবার দেখবেন তো।’
প্রতিবর্ত ক্রিয়ার অভিঘাতে মা-মাটি-মানুষের ১৩ দফা দাবি। না, সেজন্য অনশন তুলে নেওয়ার শর্ত নেই। স্রেফ অনুরোধের জায়গা থেকে সেগুলোর বিন্যাস। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, দীর্ঘসূত্রতায় বিভ্রান্ত না করে দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে অভয়ার ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে। ঠিক কথা। ন্যায়বিচার তো সবাই চাইছে, সবাই চাইছি। কিন্তু জিনিসটা ঠিক কী, সেটা এই বাজারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে কই? কী বলবেন একে? ছেলেমানুষি? অযৌক্তিক দাবি? অন্যের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে নিজের বোধবুদ্ধির অবলোপ মেনে নেওয়া?
দ্বিতীয় দাবি, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রশাসনিক অক্ষমতা ও দুর্নীতির দায় স্বাস্থ্যমন্ত্রককে নিতে হবে এবং স্বাস্থ্যসচিবকে অবিলম্বে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করতে হবে। একটা ছোট্ট জিজ্ঞাসা। স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণ চাই, এই দাবির ৫ শতাংশ যদি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ধরেও নিই, তাহলেও ৯৫ শতাংশ কি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের স্বার্থগোষ্ঠীর লাভালাভ, পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে জড়িত নয়?
দাবি ৩, অবিলম্বে রাজ্যের সমস্ত হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে কেন্দ্রীয় রেফারাল ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সে কাজ তো চলছেই।
দাবি ৪, প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ডিজিটাল বেড ভ্যাকান্সি মনিটর চালু করতে হবে। রাজ্য সরকার কি বলেছে, এটা চালু করা যাবে না? তবে এই দাবি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির প্রয়াস কেন?
৫ নং দাবি, দ্রুত সব মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব-সহ কলেজভিত্তিক টাস্ক ফোর্স গঠন করে প্রয়োজনমাফিক সিসিটিভি, অন কল রুম, বাথরুমের সাথে হেল্পলাইন নম্বর, প্যানিক বোতামের ব্যবস্থা করতে হবে। কাজ চলছে। দাবি ৬, হাসপাতালগুলিতে পুলিশি সুরক্ষা বাড়াতে হবে। সিভিক ভলেন্টিয়ার নয়, স্থায়ী পুরুষ ও মহিলা পুলিশকর্মী নিয়োগ করতে হবে।
অন্য কোনও সংবাদসূত্র নয়, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম সহযোগী সংবাদপত্রে প্রকাশিত ১৭ অক্টোবরের একটি খবরের শিরোনাম— ‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের আগেই আরজি কর থেকে সরে গিয়েছেন ২৯ জন সিভিক ভলান্টিয়ার’। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, আরজি করে নতুন করে প্রায় ৫০০টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আগে ১৯৯টি সিসি ক্যামেরা ছিল। মূল ভবনের কিছু জায়গা ছাড়া সব জায়গা সিসি ক্যামেরার নজরদারির অধীনে আনা হয়েছে। হাসপাতালে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের প্রশিক্ষণের কাজও শুরু হয়েছে। এর পরেও বিশ্বাস করতে হবে, রাজ্য সরকার চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রশ্নে উদাসীন? বিক্ষিপ্ত ঘটনার বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত তুলে আন্দোলন চলবে আর আমরা দাবির দাওয়াই হজম করব!
৭ নং দাবি, হাসপাতালগুলিতে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের শূন্যপদগুলি অবিলম্বে পূরণ করতে হবে৷ এটা নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ধরে রাখার প্রণোদনাতেই এই চলমান প্রক্রিয়ায় যতি টানার জো নেই। ফলে, এই দাবির আলাদা গুরুত্ব নেই।
৮ নং দাবি, প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে থ্রেট সিন্ডিকেটে জড়িতদের বিরুদ্ধে এনকোয়ারি কমিটি বসিয়ে তাদের শাস্তি দিতে হবে। রাজ্যস্তরেও এনকোয়ারি কমিটি তৈরি করতে হবে। সিনিয়র ডাক্তারবাবুদের কী বক্তব্য, সেটা জানার ইচ্ছে করছে একটা কথা সামনে আসার পর থেকে। একাধিক সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে প্রকাশ, ‘বাম আমলে আরজি করে পর্ন চক্র! ডাক্তারের মৃত্যুতে নাম আজকের বিক্ষুব্ধদেরও’। বিশদে বললে দাঁড়াচ্ছে, সেটা এরকম—
বারাকপুরের বাসিন্দা চতুর্থ বর্ষের মেডিক্যাল পড়ুয়া ছিলেন সৌমিত্র বিশ্বাস। ২০০১ সালের ২৫ অগাস্ট আরজি করের ললিত মেমোরিয়াল হস্টেলের ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তাঁর মৃতদেহ। অভিযোগ, গলায় বাঁধা দড়ি নাকি এতটাই ‘পোক্ত’ ছিল যে, পৃথিবীর সবচেয়ে রোগা লোকটাও ঝুলতে চাইলে মুহূর্তে তা ছিঁড়ে যাবে। সেই অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় এসএফআইয়ের কেষ্টবিষ্টুদের কয়েকজনের ‘দুবেজি’, ‘ধরবাবু’ ও ‘গোসাঁই ঠাকুর’— এই তিনজন এসএফআই ‘মাতব্বর’-এর নামে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগ এনেছিলেন সবিতাদেবী, মৃতের মা। সেদিনের সেই ‘গোসাঁই ঠাকুর’,অন্য কেউ নন, অভয়া আন্দোলনের অন্যতম হোতা এবং ‘নেতা’ সুবর্ণ গোস্বামী। নানা প্রকার অসত্য তথ্য ও বিভ্রান্তিকর খবর রটিয়ে (১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়া গেছে, ক্রাইম সিন নষ্ট করা হয়েছে, সিবিআই চার্জশিট দেয়নি ইত্যাদি) রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অযথা লোক খেপানোর কান্ডারি।
আর একটি কথা। আজকের মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক এবং উত্তর কলকাতা কেন্দ্র থেকে গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী ডাঃ বিপ্লবচন্দ্র সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘আজ থ্রেট কালচার বলে এত কথা বলছেন ডাঃ গোস্বামী! বিরোধী সংগঠন করেছি বলে আমাদের ছাত্রাবস্থায় ওঁরাই যে কত থ্রেট করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।’
৮ নং দাবি নিয়ে তাই অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। শুধু বিনীত বক্তব্য, শিরদাঁড়া নিয়ে নাটুকে হইচই করার আগে একটু আয়নার সামনে দাঁড়ান আন্দোলনে মদতদাতা অশ্বিনী কুমাররা।
৯ নং দাবি, রাজ্যের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রসংসদ নির্বাচন করতে হবে। কলেজে আরডিএ-কে স্বীকৃতি দিতে হবে। কলেজ/হাসপাতাল পরিচালনার কমিটিতে ছাত্রছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে হবে। এটি ডাক্তারি পড়ুয়াদের স্বার্থর সঙ্গে জড়িত।
দাবি ১০, WBMC ও WBHRB-এর অভ্যন্তরে যে ব্যাপক দুর্নীতি ও বেনিয়মের অভিযোগ আছে তার সাপেক্ষে দ্রুত তদন্তপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
সে তো হচ্ছে এবং হবেই। কিন্তু আপনারা যাঁকে ফাঁসাতে চাইছেন, তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ না মিললে, তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে আপনাদের অবস্থান ঠিক কী হবে, সেটাও আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। এসবের উল্টো দিকে রাখুন মা-মাটি-মানুষের হয়ে রোজ সওয়াল করছে যে স্বর, তার দাবিগুলো।
১) সব হাসপাতালে ডাক্তারদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হোক। সঙ্গে তাঁদের ডিউটির সময় অনুযায়ী উপস্থিতি, রোগী দেখাও সুনিশ্চিত হোক।
২) সরকারি হাসপাতালের কাজ ফেলে, সুবিধে মতো ডিউটি বদলে বাকি সময় প্রাইভেট হাসপাতালে কাজ করা চলবে না।
৩) প্রেসক্রিপশনে একই গুণমানের কমদামি ওষুধের বদলে ওষুধ কোম্পানির প্রভাবে দামি ওষুধ লেখা চলবে না। জেনেরিক টার্মে ওষুধ লিখুন, কোম্পানির ব্র্যান্ড নয়।
৪) ওষুধ ও বিভিন্ন সরঞ্জাম (পেস মেকারসহ) কোম্পানির স্পনসরশিপে অনুষ্ঠান, দেশ-বিদেশে ভ্রমণ চলবে না। ওঁরা সমাজসেবা করেন না। কমিশন, কাটমানির অভিযোগের বন্ধ/সুরাহা করতে হবে।
৫) কথায় কথায় বিভিন্ন পরীক্ষার নামে নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কেউ যেন কমিশন না নেন।
৬) ডাক্তারদের ফি যাতে মানুষের নাগালে থাকে, তার কাঠামো চাই। প্রত্যেককে রশিদ দিতে হবে।
৭) হয় সরকারি, নইলে বেসরকারি বেছে নিন, দুটো একসঙ্গে কোনও নিয়ম দেখিয়ে চলবে না।
৮) সাধারণ মানুষের করের টাকার ভর্তুকিতে যাঁরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়বেন, তাঁদের সরকারি কাজেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোটি টাকা দিয়ে বেসরকারিতে পড়াদের কথা আলাদা।
৯) স্পেশালিস্ট, সিনিয়রদের ঠিকমতো ডিউটি করতে হবে। লবি করে কলকাতায় পোস্টিং বা জেলায় গেলেও কৌশলী রোস্টারে তিন/চার দিন কলকাতায় এসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চলবে না। জেলার হাসপাতালে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে।
১০) শূন্যপদ পূরণ হোক। পরিকাঠামো বাড়ুক। কিন্তু নিজেদের কর্মক্ষেত্রকে রোগীবন্ধু রাখার দায়িত্ব সরকারের পাশাপাশি ডাক্তারদেরও নিতে হবে। কারণ সরকারি কাঠামোতে দুর্বলতা দেখিয়ে রোগীকে বেসরকারিতে যেতে বাধ্য করা/টেনে দেওয়ার অভিযোগ আছে, বন্ধ করতে হবে এসব।
১১) বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তিতে বিপুল টাকা, পড়তে টাকা, সেমিস্টারে ফেল করিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে পাশ- এইসব অভিযোগবন্ধনীতে কিছু ডাক্তারও আছেন। এসবে স্বচ্ছতা ও তদন্ত দরকার।
১২) বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কিছু কোটা দীর্ঘকাল আছে। মুখ্যমন্ত্রীর কোটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধ করেছেন। কিন্তু হাসপাতালের কোটাগুলি নিয়ে বহু অনিয়মের অভিযোগ, বহু ডাক্তার জানেন, সেগুলি বন্ধ হোক বা স্বচ্ছতা আনা হোক।
১৩) চিকিৎসার গাফিলতিতে নির্দিষ্ট FIR বাধ্যতামূলক হোক।
স্পষ্ট, নির্দিষ্ট স্বার্থ গোষ্ঠী বা ইন্টারেস্ট গ্রুপের দাবি নয়, জন স্বার্থে গণ স্বাস্থ্যে ঘুঘুর বাসা ভাঙার দাবি।
কোনটা বেশি দরকার? আপনারাই বলুন, প্লিজ।
আরও পড়ুন- কুণালের সঙ্গে বৈঠকে ডাক্তার নেতা নারায়ণ