‘হযবরল’-এর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল।
ঠিক তেমনই পাক অধিকৃত কাশ্মীর টার্গেট হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাংলার আকাশে পরিযায়ী ভোট পাখিদের আনাগোনা দেখে মালুম হচ্ছে, টার্গেট বদলে গেছে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বদলে নয়া টার্গেট এখন বাংলা। আরও স্পষ্ট করে বললে, নবান্ন।
বিজেপি স্পষ্টত বাংলা দখলের খেলা খেলতে নেমেছে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, পরেরবার পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও কথা হলে, আমাদের পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধার নিয়েই আলোচনা করা উচিত। জাকার্তার মাটিতে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য, প্রবাসী ভারতীয়রা বহন করে ভারতের বহুত্ববাদ, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’-র দর্শন এবং প্রতিকূলতার মধ্যে শক্তির উদাহরণ। আজকের দিনে সীমান্ত পার হওয়া সন্ত্রাসবাদ গোটা বিশ্বের চ্যালেঞ্জ। আমাদের সবাইকে—আপনি যদি ছাত্র হন, কিংবা অন্য যে কোনও পেশায় থাকেন—এ বিষয়ে মুখ খুলতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসবাদীদের লালন-পালন, আশ্রয়দান এবং নিরাপদে ষড়যন্ত্র করার সুযোগ দিয়েছে। এর পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ বিশ্ববাসীর চোখের সামনে রয়েছে। আজকের দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তারা সন্ত্রাসবাদীদের শেষকৃত্যে হাজির থাকছেন—এটাই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয় যে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের মদতদাতা রাষ্ট্র!
কিন্তু মোদি-শাহের বচনে এসব বুলি নেই। সেখানে কেবল সিঁদুর, কেবলই সিঁদুর। এবং সেই সিঁদুরের টার্গেট পশ্চিমবঙ্গ।
পাকিস্তান এখন নিজেকেই আগুন লাগিয়ে, নিজেই দমকল বাহিনী সাজছে। এটাই যেমন ওদের দ্বিচারিতা তেমনই মোদি-শাহের দ্বিচারিতা প্রমাণিত সিঁদুরের বিপণনে।
অন্যদের উপর ভরসা না করে, আমাদেরই দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানের মুখোশ বিশ্ববাসীর সামনে খুলে দেওয়া। ৯/১১ হোক বা ২৬/১১— প্রায় সব বড় সন্ত্রাসবাদী হামলার সূত্রই পাকিস্তানে গিয়ে মেলে। হাফিজ সইদ, ওসামা বিন লাদেন, কিংবা জইশ-ই-মহম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠন— সব কিছুরই সঙ্গে পাকিস্তানের যোগ রয়েছে। তারা একদিকে শান্তি আলোচনার নাটক করে, অন্যদিকে অস্ত্র চালায়। সন্ত্রাস ও শান্তি আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না।
অভিষেক বলে চলেছেন, ‘‘গত ৫০ বছর ধরে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসেছি। আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গৌতম বুদ্ধের দেশ থেকে এসেছি। আমাদের কাছে যুদ্ধের কথা বলা শেষ পছন্দ। কিন্তু এবার, যদি আমাদের সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসে, আমি সরকারের কাছে এবং সমস্ত ভারতবাসীর কাছে অনুরোধ করব—আমাদের অবস্থান স্পষ্ট হোক: আমরা পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধার নিয়েই আলোচনা করব, যেখানে ভারতীয়দের উপর সন্ত্রাস হামলার ছক কষা হয়েছে, এবং রক্তপাতের জন্য সন্ত্রাসের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।”
আরও পড়ুন-আমছায়ার নীড়
আর মোদি-শাহ এরাজ্যের বুকে দাঁড়িয়ে বলছেন, হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার জন্য গরম গরম কথা। তাঁর শরীরে রক্তের বদলে গরম সিঁদুর বইছে জাতীয় ডায়ালগ। বছর ঘুরলেই বাংলা দখলের ভোট। তাই পাল্টে গিয়েছে স্ক্রিপ্ট। তাঁর ভাষণে স্পষ্ট, পাক অধিকৃত কাশ্মীর নয়, তাঁর লক্ষ্য বাংলা দখল। সেই কারণেই জাতীয় ভাবাবেগে উদ্বুদ্ধ করার মতো রক্ত গরম করা ভাষণ না দিয়ে আক্রমণের ফলা ঘুরিয়ে দিয়েছেন বাংলার তৃণমূল সরকারের দিকে। চাকরিহারা শিক্ষকদের জন্য চোখের জলও ফেললেন। কিন্তু তাঁদের সমস্যার প্রতিকার তিনি চান না। সমস্যা জিইয়ে রাখলেই লাভ। তাই ওই সমস্যা সমাধানে যিনি স্রেফ মানবিক কারণে লড়াই করছেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারকে, নির্মম বলছেন। আর এসব করতে গিয়েই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে যে ঐক্যের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী তার টুঁটি টিপে ধরছেন।
কিন্তু কিছুতেই বলছেন না, কেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটা কথায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী চুপ করে যান? কেন সেদিন পহেলগাঁওয়ে নিরাপত্তারক্ষী ছিল না? উলটে মুর্শিদাবাদের গোষ্ঠী সংঘর্ষের প্রসঙ্গ উসকে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে যখন তাঁর ঐক্যের বার্তা দেওয়ার কথা, তখন তিনি খেলে দিলেন বিভাজনের তাস। তাতেই বোঝা গেল, সোফিয়া কুরেশিকে সামনে রেখে ‘অপারেশন সিন্দুরে’র সাফল্যের ফিরিস্তি দেওয়ানোটা আন্তরিক ছিল না, তা ছিল একটা পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের অঙ্গ।
কেন বলছি? তাহলে একটা সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বলি।
জমির অধিকার কার—এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিবাদ চলছিল দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে। এবার কবর খোঁড়া নিয়ে বিবাদের জেরে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়াল নৈনিতালের রামনগরে। কবরের গর্তের মধ্যে শুয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন কয়েকজন। স্থানীয় বিজেপি নেতারা চলে আসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না হয়, তার জন্য পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র সীমা বলের জওয়ানরা এলাকায় টহল দিচ্ছে।
আরও পড়ুন-চক্রান্ত! ভুয়ো খুনের মামলায় প্রধান আসামি শেখ হাসিনা
রামনগরের গৌজানি এলাকায় একটি গোরস্থান রয়েছে। হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ওই গোরস্থানটি ব্যবহার করে। কিন্তু ওই জায়গার বাইরেই একটি জমি নিয়ে ১৯৯৪ সাল থেকেই বিবাদ চলছে। একপক্ষের দাবি, ওই জমিটি গোরস্থানেরই অংশ। অন্যপক্ষ তা মানতে নারাজ। বৃহস্পতিবার ওই জমিতে একটি কবর খোঁড়া শুরু হয়। যা নিয়ে নতুন করে বিবাদের সূত্রপাত। কয়েকজন যুবক দাবি করেন, ওই জমিতেই কবর খোঁড়া হবে। এরপর তাঁরা সেখানে শুয়ে পড়েন। স্থানীয় বিজেপি কর্মীরা পাল্টা দাবি করেন, গোরস্থানের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া জায়গাতেই নতুন কবর খুঁড়তে হবে। শেষপর্যন্ত মহকুমা শাসকের নেতৃত্বে বিরাট পুলিশ বাহিনী এসে সবাইকে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়।
এই মোদির অভিযানের প্রশস্তির সিংহভাগ জুড়ে উত্তম পুরুষের একবচন। আর সংশয়টা এখানেই। সেনা অভিযানের কৃতিত্ব তিনি যে একাই নিতে চান, সেটা স্পষ্ট হয়।
আর সেই সঙ্গে এটাই বোঝা যায়, নরেন্দ্র মোদির আসল টার্গেট পাক অধিকৃত কাশ্মীর নয়, বাংলা।