হচ্ছেটা কী!

Must read

মিথ্যে কথা বলার একটা লিমিট আছে। এরা তো দেখছি, সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে!
কথাগুলো আমাদের পুরোনো পাড়ার নিরু পিসির পেটেন্ট ডায়ালগ। সাধারণত উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কোনও দোকানদার কিংবা সবজি বিক্রেতা। কিন্তু এবার পিসির টার্গেট মোদি সরকার।
কারণটা কী? হঠাৎ কী হল!
খোঁজ নিয়ে যা যা জানলাম, সেটা জ্ঞাত হওয়ার পর চক্ষুচড়কগাছ। অক্কা পাওয়ার জোগাড় আমাদের সক্বলেরই।
বাজারে শুনছিলাম, আপাতত পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। তারপর আগামী তিন বছরের মধ্যেই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির রাষ্ট্রে পরিণত হবে ভারত। নীতি আয়োগ সম্প্রতি জানিয়েই দিয়েছে যে, এখনই নাকি জাপানকে পিছনে ফেলে ভারত চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি।
আর এখন জানছি, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে জানতে পারছি, আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক অথবা আর্থিক সংস্থাগুলি থেকে ঋণ নিয়ে উন্নয়নের প্রবণতা আগের মতোই অব্যাহত। বস্তি উন্নয়ন, নিকাশি, পরিবহণ উন্নতি, পরিকাঠামোর সংস্কার, পানীয় জলের পাইপলাইন ইত্যাদি নগরোন্নয়ন প্রকল্পে বহু বছর ধরেই ভারত সরকার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নিয়ে এসেছে।
২০২৫ সালে এসে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি ভাষণে যেখানে বিকশিত ভারতের স্লোগান, সেখানে ফের ঋণ নেওয়ার পথই বজায় থাকছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে ভারত। ৫ বছরের সময়সীমায় যে ঋণ দেওয়া হবে, সেটি কাজে লাগানো হবে শহুরে পরিকাঠামো, মেট্রো রেলের নতুন কাঠামো নির্মাণ, নতুন রিজিওনাল র‍্যাপিড ট্র্যানজিট সিস্টেম, ট্রান্সপোর্ট করিডর ইত্যাদি প্রকল্পে। একইসঙ্গে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বেসরকারি লগ্নিতেও সহায়তা করবে। আরবান চ্যালেঞ্জ ফান্ড প্রকল্পে দেশের ১০০টি শহরকে চিহ্নিত করে নগরোন্নয়ন এবং পানীয় জল ও নিকাশি প্রকল্পে টাকা দেওয়া হবে। পাশাপাশি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক রাজ্য এবং পুরসভাগুলির প্রকল্পেও ৩০ লক্ষ ডলার আর্থক সহায়তা দেবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের সঙ্গে বৈঠকে ভারত জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ থাকবে শহরাঞ্চলে। তাই আগামী ৫ বছরের জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শহরাঞ্চলের পরিকাঠামো আমূল বদলে ফেলতে হবে। জল নিকাশি, আবাসন এবং কর্মসংস্থান প্রধান টার্গেট। ভারত ১১ লক্ষ কোটি টাকা পরিকাঠামো খাতে ব্যয় করবে বলে বিগত দুই বাজেটেই ঘোষণা করা হয়েছে। সেই টাকা কি এভাবে আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক সংস্থা থেকে নেওয়ার পরিকল্পনাই করা হয়েছে? তাহলে বাজেটে যে ১১ লক্ষ কোটি টাকা ঘোষণা করা হচ্ছে সেটা কী কারণে? বুলেট ট্রেনের ব্যয়ও আসছে জাপানের ঋণে। ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডরের নির্মাণ ব্যয় চলছে জাপানের‌ আর্থিক সংস্থার ঋণে।
ভারত একদিকে বলছে তারা দ্রুত হবে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, আবার অন্যদিকে এখনও নগরোন্নয়নের মতো মূলগত উন্নয়ন প্রকল্পেও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ঋণ ভরসা?
দুটি বিষয়ে তো সামঞ্জস্য নেই।
তাহলে হচ্ছেটা কী!
এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
সকলেই জানি, বৃহৎ লগ্নি, উৎপাদন সেক্টরের বৃদ্ধিহার, এফডিআই, কর্মসংস্থান, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য তো রয়েছেই। সেসবের পাশাপাশি দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নতি। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের জিডিপি বৃদ্ধিহারের সঙ্গে যে যে ফ্যাক্টরগুলি যুক্ত, তার মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই ৩০ শতাংশ। কারণ, ভারতের বৃহৎ শিল্প উৎপাদনের ওঠাপড়া রয়েছে। সেখানে গ্রাম, মফসসল, ছোট বড় শহরের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই দেশের অর্থনীতি তথা জিডিপির প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু নতুন আর্থিক বছরে এসে জানা যাচ্ছে, ওই চালিকাশক্তি এবার ধাক্কা খেয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ব্যাঙ্ক-ঋণ কমে গিয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যানই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
ক্ষুদ্র শিল্পের ভরসা ব্যাঙ্ক ঋণ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলি ব্যাঙ্কঋণের জন্য যত বেশি আবেদন করে, ততই বেশি আর্থিক বৃদ্ধি ঘটে। প্রধানমন্ত্রী কর্মসংস্থান বৃদ্ধি প্রকল্পের অধীনে ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে এই ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক-ঋণ মঞ্জুর হয়েছিল মোট ১৭ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তী এক বছরে তা অনেক কমে গিয়েছে। ঋণের অঙ্ক এসে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা কম। কোভিডকালের পর, ২০২১ সাল থেকে ক্রমেই ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য ঋণের চাহিদা বেড়েছে। এমনকী ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ বেড়েছে। সেই প্রবণতাই ধাকাক খেয়েছে সদ্য সমাপ্ত অর্থবর্ষে। শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রকের অনুমান, সামগ্রিক বাণিজ্যে মুনাফার প্রবণতা কমেছে। সেই কারণে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও কমে গিয়েছে। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে যত সংস্থা ব্যাঙ্ক ঋণের আবেদন করেছিল, সেই সংখ্যাও ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে অনেক কম।
এই প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্যই ছিল, কর্মীদের যাতে গ্রাম অথবা মফসসল ছেড়ে পরিযায়ী হতে না হয়। সেই লক্ষ্যেই স্বনিযুক্তি প্রকল্পকেও আনা হয়েছিল এর অধীনে। এই প্রকল্পের সুবিধা হল— সরকার প্রথমে কিছু আর্থিক অনুদান প্রদান করে, যাতে ক্ষুদ্র শিল্প অথবা উদ্যোগ শুরু করা যায়। পাশাপাশি ব্যাঙ্ক থেকে প্রদান করা হয় ঋণ। এই প্রথম দেখা যাচ্ছে, সেই ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। ২০২০-’২১ আর্থিক বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্ক-ঋণ অনুমোদিত হয়। ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে সেটা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৮ হাজার কোটি টাকায়। কিন্তু তারপর থেকে সেই অঙ্ক কমতে শুরু করেছে। এখন সর্বনিম্ন! এরকম একটা পরিস্থিতিতে নিরু পিসিরা তো আর্তনাদ ছাড়বেনই।
হচ্ছেটা কী!

আরও পড়ুন: ফেডারেশন-পরিচালক বৈঠক

Latest article