একটি কোম্পানির সমস্ত স্তরের কর্মীদের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন এবং পরিচালনের জন্য তৈরি হয়ে থাকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (Human Resource Management)। কর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধা, পরিষেবা, পদোন্নতি, বেতন, ছুটিছাটা, কর্মবিরতি, সমস্ত কিছুর সূত্রে কোম্পানি-পরিচালকদের পক্ষ থেকে দেখভাল করে এই ডিপার্টমেন্ট। কর্মীরা কোম্পানির অন্যতম সম্পদ। কোম্পানির স্বার্থে তাঁদের ভাল-মন্দ দেখার দায়িত্ব গ্রহণ করে কোম্পানি। আর এই কাজ সুসম্পন্ন করেন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজাররা। একটি কোম্পানির ভাল এবং পেশাদারি হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের মাধ্যমে কাজের পরিবেশ এবং কাজের ধরনধারণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়, কাজের গতি ত্বরান্বিত হয়। বিগত দিনে কোম্পানি বা অফিসগুলিতে পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট এই ধরনের দায়িত্ব সামলাত। কর্মীর কর্মমুখী মনোভাব তৈরি, মনোবল গঠন, কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট-এর সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের মধ্যে একটি সহায়ক সেতু হিসাবে কাজ করে থাকে হিউম্যান রির্সোস ম্যানেজমেন্ট বিভাগ।
হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (Human Resource Management) কী?
একটি কর্মীর বেতন পদ্ধতি এবং পদোন্নতির বিষয়গুলি তাঁর নিজের জন্য এবং কোম্পানির উভয়য়ের জন্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে-কোনও ধরনের কোম্পানি বা উত্পাদনমূলক সংস্থার পণ্যোত্পাদনের পরিমাণ, তার গুণমান, বাজারজাত করা ইত্যাদি বিষয়গুলি যেমন কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে, ঠিক তেমনই কোম্পানির কর্মী বা সদস্য সংখ্যা, কর্মীদের গুণমান, কোম্পানির প্রোফাইল বা কাজের সঙ্গে কর্মী সংখ্যার অনুপাত এই সমস্ত কিছুর উপরেও সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মানোন্নয়ন বা ব্যবসার বিষয়গুলি অনেকাংশেই নিভর্র করে। স্বাভাবিকভাবেই ছোট-বড় নানা মাপের কোম্পানি বর্তমানে নিজেদের হিউম্যান রির্সোস ডিপার্টমেন্টকে ঢেলে সাজাতে তত্পর, বিশেষত বাজারের প্রতিযোগিতার কারণে। হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনার পর তাই, কাজের জায়গা দ্রুত বাড়ছে।
কীরকম যোগ্যতার দরকার?
যে-কোনও শাখায় গ্র্যাজুয়েট যোগ্যতার ছেলে-মেয়েরা হিউম্যান রির্সোস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনা করতে পারেন। উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর আলাদা করে গ্র্যাজুয়েশন স্তরে বিষয়টি নিয়ে পড়ার সুযোগ খুব একটা নেই, যদিও গোড়ার পাঠ নেওয়া যেতে পারে ব্যাচেলর অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কোর্স করে। এমনিতে, যে-কোনও বিষয়ে স্নাতক স্তরের পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সে বা আলাদা করে ম্যানেজমেন্ট কোর্সেও হিউম্যান রিসোর্স (Human Resource Management) নিয়ে পড়াশুনা করা যেতে পারে আমাদের রাজ্যেই। তবে এই পেশায় সাফল্যের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি কমিউনিকেশন স্কিল এবং পার্সোনালিটি ডেভেলপমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন, সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জ্ঞান, টাইম ম্যানেজমেন্ট, অর্গানাইজেশনাল পাওয়ার প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার। দৈনিক বা মাসিক রুটিনমাফিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ, তাঁদের সমস্যার চটজলদি সমাধান, ডেটা মেনটেন, প্রোফাইল এসব সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে হয়। এজন্য উন্নতমানের পার্সোনালিটি এবং কমিউনিকেশন গড়ে তোলার মানসিকতা দরকার।
যোগ্যতা কেমন লাগে?
হিউম্যান রিসোর্স নিয়ে ২ বছরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স করা যেতে পারে। এই বিষয়ে পেশা ক্ষেত্রে উন্নতি করার জন্য এমবিএ ডিগ্রি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমবিএ কোর্সের মধ্যে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজেন্টকে স্পেশ্যালাইজেশন পেপার হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টগুলিতে পড়ার জন্য ক্যাট পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হতে হবে, ম্যাট, জ্যাট ইত্যাদি কয়েকটি পরীক্ষা দিয়েও ভর্তি হওয়া যায় অনেক জায়গায়। এছাড়াও যে-কোনও বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করার পর বিষয়টি নিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স করার সুযোগও রয়েছে।
কোথায় পড়া যায়?
ক্যাট বা ম্যাট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভারতের কোনও ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট বা ‘বি-স্কুল’-এ ভর্তি হয়ে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টকে স্পেশ্যালাইজেশন পেপার হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিউম্যান রিসোর্সের উপর একটি এক বছরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স করানো হয়। কলকাতায় অল ইন্ডিয়া ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএস, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা কোর্স, ডব্লুবিইউটি অনুমোদিত বিভিন্ন ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের কোর্স, এরকম নানা জায়গা থেকে ম্যানেজমেন্ট কোর্স করা যেতে পারে। রাজ্যের বাইরে গিয়েও দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বাইয়ের মতো শহরগুলিতে এই বিষয় নিয়ে পড়াশুনার অনেক সুযোগ রয়েছে।
কীরকম কাজ হয়?
দেশি-বিদেশি স্তরের বড় ও মাঝারি বা কর্পোরেটর অফিসগুলি তো বটেই, বহু সমৃদ্ধিশালী ছোট কোম্পানিও ভাল বেতনে হিউম্যান রিসোর্সের ডিগ্রি-ডিপ্লোমাধারীদের নিয়োগ করে। বড় কোম্পানিতে এমপ্লয়ার রিলেশন ম্যানেজার, রিক্রুটার ম্যানেজার, হিউম্যান রিসোর্স এগজিকিউটিভ, পার্সোনেল ম্যানেজার এরকম নানা পদে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। কর্মীদের বেতনক্রম, নতুন কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত কাজ (রিক্রুটমেন্ট প্রসেস) অ্যাটেন্ড্যান্স সিস্টেম, প্লেসমেন্ট প্রসেস, ওয়ার্ক কালচার তৈরি, কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধা এবং সমস্যা-সমাধান এরকম বিষয়গুলির দায়িত্ব দেওয়া হয় হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজারদের। বর্তমানে অধিকাংশ কাজ কম্পিউটারের হিসাব-নিকাশ ইন্টারনেট-মেলিং সিস্টেমের মাধ্যমে হয়ে থাকে, স্বাভাবিকভাবেই কম্পিউটার ব্যবহার সম্পর্কেও খেয়াল রাখতে হয়। কোম্পানির মালিক পর্যায়ের লোক, কর্মী, কর্মী ইউনিয়ন এই সমস্ত বিভাগের মধ্যে সমন্বয়সাধনের গুরুদায়িত্ব রয়েছে তাঁদের উপর।
পেশায় চাহিদা কেমন?
বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, কর্পোরেট হাউস, ব্যাঙ্কিং ও অর্থলগ্নি সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি সমস্ত ক্ষেত্রেই হিউম্যান রিসোর্স কর্মীদের নিয়োগ করা হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই, বিশ্বায়ন এবং উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নতমানের ম্যানেজমেন্ট বা প্রোডাকশন সিস্টেম তৈরি করার জন্য সমস্ত ধরনের কোম্পানিই সচেষ্ট। ফলত, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে উপযোগী এবং আপডেটেড এইচআর সিস্টেম গড়ে তোলার জন্যেও তত্পর থাকতে হয়, একটি এইচআর ম্যানেজারের অধীনে একাধিক এগজিকিউটিভ বা ট্রেনিকে নির্দিষ্ট কোনও দায়িত্বে বা একাধিক অফিস বা সেন্টারে নিয়োগ করা হয়। যার দরুন এই পেশার জন্য কাজের পরিধিটাও বাড়ছে। এর বাইরেও একাধিক এইচআর এজেন্সি তৈরি হয়েছে, যারা অন্যান্য কোম্পানির নিয়োগ সংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব নিয়ে থাকে বা বেকার বা কর্মসন্ধানী প্রার্থীদের নিজেদের প্রোফাইল অনুযায়ী উপযুক্ত স্থানে নিয়োগের বন্দোবস্ত করে থাকে। এই সমস্ত জায়গাতেও বিগত কয়েক বছরে অনেক নতুন কর্মসংস্থানের রাস্তা তৈরি হয়েছে। ফলে, রয়েছে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ার সুযোগও।