হিন্দু সমাজে কুমারীপূজা (kumari puja) একটি বিশেষ পূণ্যজনক কার্য্য বলিয়া পরিচিত। তন্ত্রশাস্ত্রের অনেক স্থলেই ইহার আবশ্যকতা বিবেচিত হইয়াছে। কিন্তু তন্ত্রে ইহার বহুল প্রচার আছে বলিয়া উহাকে তন্ত্রের নিজস্ব বলিয়া মনে করিলে বড়ই ভুল করা হইবে। কারণ প্রাচীন স্মৃতি নিবন্ধে ইহার বিধান এবং সমর্থক পৌরাণিক প্রমাণাবলী দেখিতে পাওয়া যায়। এই প্রবন্ধে কেবল স্মৃতি নিবন্ধ প্রমাণানুযায়ী পূজার বিবরণই প্রদর্শিত হইবে।
নির্ণয়ামৃত নামক স্মৃতি নিবন্ধে কথিত হইয়াছে যে, আশ্বিনের শুক্লপক্ষে প্রতিপদ্ হইতে আরম্ভ করিয়া নবমী পর্যন্ত প্রত্যেক তিথিতে কুমারীপূজা করিতে হইবে। নিজের বিভবানুসারে এক একটি বৃদ্ধি করিয়া অথবা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করিয়া অর্থাৎ প্রথম দিনে একটি দ্বিতীয় দিনে তিনটি অথবা চারিটি এই হারে অথবা প্রতিদিনেই নয়টি করিয়া পূজা করিবে, অনন্তর ভোজন করাইবে। এই বিষয়ের প্রমাণ স্কন্দপুরাণে কথিত হইয়াছে।
এক বর্ষ বয়স্কা কন্যা গন্ধপুষ্পফল প্রভৃতির স্বাদগ্রহণ করিতে পারে না; অতএব তাহাকে বাদ দিয়া দ্বিবর্ষা হইতে দশমবর্ষা পর্য্যন্তকে পূজা করিবে। এই কুমারীপূজা সর্বকার্য্যের অঙ্গরূপেই বিধানানুসারে কর্তব্য। বয়সের বিশেষানুসারে ইহাদের পৃথক পৃথক নাম এবং পূজার বিশেষফল কথিত হইয়াছে। যথা দ্বিবর্ষা–কুমারিকা, ত্রিবর্ষা–ত্রিমূৰ্ত্তিণী, চতুর্বর্ষা–কল্যাণী, পঞ্চবর্ষা—রোহিণী, ষড়বর্ষা–কালী, সপ্তবর্ষা—চণ্ডিকা, অষ্টবর্ষা—শাম্ভবী, নববর্ষা—দুর্গা এবং দশবর্ষা—সুভদ্রানামে অভিহিতা হইয়াছে। ইহার অতিরিক্ত বয়স হইলে তাহাকে পূজা করিবে না। দুঃখ দারিদ্র্য নাশ, শত্রুনাশ, আয়ুবৃদ্ধি এবং বল বৃদ্ধির জন্য কুমারীকে পূজা করিবে। এইরূপ প্রত্যেকের পূজারই ফল বিশেষ উক্ত হইয়াছে, অনাবশ্যক বোধে এবং বাহুল্যভয়ে তাহা উপেক্ষিত হইল।
প্রয়োজন বিশেষ সম্পাদনার্থ ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় কুমারীর পূজা বিহিত হইয়াছে। এমন কি অন্ত্যজ জাতীয় কুমারীপূজারও (kumari puja) পরিচয় পাওয়া যায়, যথা—সাধারণতঃ সকল কার্য্যেই ব্রাহ্মণ কন্যাকে পূজা করিবে। জয়াভিলাষী মানব ক্ষত্রিয়কন্যাকে পূজা করিবে, ধনলাভকামী মানব বৈশ্যকন্যাকে পূজা করিবে, পুত্রকামী মানব শূদ্রবংশজাত কন্যাকে পূজা করিবে এবং শত্রুর মারোণোচ্চাটন প্রভৃতি ক্রূরকর্ম্ম সম্পাদনভিলাষী মানব অন্ত্যজাতীয় কন্যাকে পূজা করিবে।
‘অন্তেভবাঃ—অন্ত্যাঃ’ অন্তে অর্থাৎ আর্যপল্লীর বাহিরে যাহাদের বাস করিবার অধিকার, তাহারাই অন্ত্য শব্দের প্রতিপাদ্য। আর্য্যজাতির সহিত এক গ্রামেও যাহাদের বাস করিবার অধিকার নাই, তাহাদের কন্যাও প্রয়োজন বিশেষে দেবতার ন্যায় পূজনীয়া, এই ব্যাপার আপাততঃ বড়ই বিস্ময়কর বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু শাস্ত্রে এরূপ ব্যাপার নিতান্ত বিরল নহে। সাধারণতঃ দেখা যায়, নাপিত ক্ষৌরকর্ম্ম করিয়াই সাধারণের উপকার সম্পাদন করিয়া থাকে, কিন্তু হিন্দুর বিবাহকার্য্যে নাপিতকে গৌরবচন পাঠ করিতে হয়, ইহা কুলাচার বা দেশাচার নহে, উহা শাস্ত্রসম্মত ব্যবস্থা। চূড়াকরণ সময়ে নাপিত মহাশয়কে সাক্ষাৎ সূর্য্যদেব রূপে ধ্যান করিতে হয়। সুতরাং হিন্দুধর্ম্মের আনুষ্ঠানিক গভীরতা সাধারণ বুদ্ধির বিষয় নহে।
এখানে একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক যে, যদিও অদ্যাপি বাঙ্গালা দেশে কুমারী পূজার অনুষ্ঠান দেখিতে পাওয়া যায়, তথাপি উহাকে বাঙ্গালার ধর্ম্ম বা বাঙ্গালীর নিজস্ব বলিয়া গণ্য করিবার উপায় নাই। কারণ কুমারী পূজায় যে সমস্ত দ্রব্য দানের ব্যবস্থা আছে, তন্মধ্যে কঞ্চুক দানেরও উল্লেখ আছে। কঞ্চুকের সহিত বঙ্গমহিলার পরিচয় ছিল না। অদ্যাপি অনেক সমাজে মহিলার কঞ্চুক ব্যবহার পাপজনক ব্যাপার বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে।
আরও পড়ুন- মুখোশ খসে পড়ল সিপিএমের, ডাক্তারদের আন্দোলনে প্রকাশ্যে যোগদানের ‘নির্দেশ’ কর্মীদের
বিশেষতঃ যে নির্ণয়ামৃতে কুমারীপূজার (kumari puja) বিস্তৃত বিবরণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাকে বাঙ্গালার গ্রন্থ বলিয়া দাবী করিবার কোনও হেতু দেখা যায় না। উক্ত গ্রন্থ কোন্ দেশে রচিত হইয়াছিল, তাহারও কোন নিশ্চয়ক হেতু নাই। কেবল পরবর্ত্তি নিবন্ধনকারীদের গ্রন্থে উক্ত গ্রন্থের প্রমাণাবলী এবং নাম নির্দেশ দেখিয়া উহার প্রাচীনতা উপলব্ধি করিতে পারা যায়। রঘুনন্দন ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থে নির্ণয়ামৃতের প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায়।
গ্রন্থের উপক্রমোপসংহার পাঠে ইহাই জানা যায় যে, সূর্যসেন নৃপতির আদেশানুসারে তদাশ্রিত ‘বল্লাট’ নামা পণ্ডিত ‘নির্ণয়ামৃত’ নামক গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। ইনি সিদ্ধ লক্ষ্মণের পুত্র।
উপসংহারেও দেখিতে পাওয়া যায়, গ্রন্থকার রাজাদেশানুসারে গ্রন্থ রচনারই উল্লেখ করিয়াছেন এবং নিজকেই রচয়িতা বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।
সূর্যসেন নৃপতির পূর্ব্বপুরুষাধ্যুষিত রাজধানীর উপকণ্ঠে যমুনা নদী প্রবাহিত ছিল, এমত বর্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়। যেন নগরীর সমীপে মহাদেবের কণ্ঠ-সমানকান্তি যমুনা নদী প্রবাহিত হইয়া নগরী সমুখিত বেদধ্বনির সান্নিধ্যবশতঃ যেন সমগ্র পবিত্রতা অভ্যাস করিতেছে।
নির্ণয়ামৃতের রচয়িতা যে সমস্ত মূলগ্রন্থ এবং নিবন্ধ পর্যবেক্ষণ পূর্ব্বক গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন, ভূমিকায় তাহার একটী তালিকা দিয়াছেন। তৎপাঠে জানা যায় তিনি মনুস্মৃতি বিষ্ণু পরাশর আপস্তম্ব প্রভৃতির ধর্ম্মসংহিতা মিতাক্ষরা, (যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার বিজ্ঞানেশ্বরকৃত টীকা) অপরার্ক (যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার অতি বিস্তৃত টীকা) পারিজাত (সম্ভবতঃ মদন পারিজাত) স্মৃত্যর্থসার, স্মৃতিচন্দ্রিকা,মৎস্যপুরাণ, কূর্ম্মপূরাণ, বরাহপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, বামনপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ভবিষোত্তর, মহাভারত, পরিশিষ্ট, হেমাদ্রি, অনন্তভট্টীয়, গৃহ্য পরিশিষ্ট, কালাদর্শ, চিন্তামণি, ত্রিদণ্ডীয়, কৃত্যকল্পতরু, পুরাণ সমুচ্চয়, দুর্গোৎসব, রামকৌতুক, সংবৎসর প্রদীপ, ভোজদেবের নিবন্ধ, দিবদাসীয়, রূপনারায়ণীয়, বিদ্যাভট্টকৃত বিস্তৃত পদ্ধতি, মহাদেবীয় এবং বিশ্বরূপকৃত শুম্ভ নিবন্ধ দেখিয়া নির্ণয়ামৃত রচনা করিয়াছেন।
‘অগাধগ্রন্থ পাথোধি মথালোচ্য ধিয়া ময়া
সমুদ্ধৃতং নৃপাদেশাত্তেনেদং নির্ণয়ামৃতম্।
মনুস্মৃতিং বিষ্ণুপরাশরাপস্তস্বস্বস্মৃতী বীক্ষ্য মিতাক্ষরাঞ্চ
তথাপরাকার্ণব পারিজাতান্ স্মৃত্যর্থসারং স্মৃতিচন্দ্রিকাং চ।।
মাৎস্যং কৌর্ম্মংচ বারাহং দৃষ্টা বৈষ্ণব বামনে
মার্কণ্ডেয় পুরাণং চ ভবিষ্যোত্তর ভারতে।
পরিশিষ্টং হেমাদ্রি মনন্তভট্টীয় গৃহ্য পরিশিষ্টে
কালাদর্শং চিন্তামণিং ত্রিদণ্ডীং চ কৃত্য কল্পতরুম্।
সকল পুরাণ সমুচ্চয় দুর্গোৎসবরামকৌতুকানিতথা
সভোজরাজীয় দেবদাসীয়ম রূপনারায়ণীয়ং বিদ্যাভট্টপদ্ধতিং
বিততাম্
বীক্ষ্য মহাদেবীয়ং শুম্ভং নিবন্ধং চ বিশ্বরূপকৃতম্।।
উল্লিখিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে স্কন্দপুরাণের নাম দৃষ্ট হয় না। সুতরাং গ্রন্থকার কুমারীপূজার বিধায়ক স্কন্দপুরীয় প্রমাণগুলি পূর্ববর্ত্তী কোনও নিবন্ধ হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন বলিয়া মনে হয়; অতএব বাঙ্গালার ন্যায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশেই কুমারী পূজার অনুষ্ঠান হইত এমত বলা যাইতে পারে। বর্তমান সময়ে কামাখ্যাধামের কুমারীপূজা অতি প্রসিদ্ধ। তত্রত্য কুমারী পূজা পাইয়া পরিণত বয়স্ক মানবেরও মস্তকে চরণ তুলিয়া দিয়া যখন রণিতার ন্যায় আশীর্বাদ করে, তখন পূজকের এবং দ্রষ্টার মনে যুগপৎ বিস্ময়ের ও ভক্তির উদ্রেক হয়।
* সম্পাদিত ও সংক্ষেপিত।
— ছবিটি সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাতৃমূর্তি