দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য গ্রামোন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত নাকি শহরের উন্নতিতেই দেশের উন্নতি? পুরনো এই প্রশ্নের উত্তর যা-ই হোক, তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসাবে ভারতে এখনও পর্যন্ত গ্রামীণ এলাকাই সিংহভাগ। এই সমস্ত অঞ্চলের উন্নতির মাধ্যমে সার্বিকভাবে দেশকে উন্নয়নের মুখ দেখানো যাবে— এটাই সর্বজনগ্রাহ্য। স্বাধীনতার পর থেকেই বিস্তৃর্ণ গ্রামীণ এলাকার আর্থিক, সামাজিক, স্থিতিশীল উন্নতি ঘটিয়ে নগরায়নের লক্ষ্য তৈরি করে রেখেছে সরকার। যার সঙ্গে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যগত উন্নয়ন, শিল্পায়ন— সমস্ত কিছুই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এই সমস্ত কিছুর জন্যেই প্রয়োজন সঠিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রুরাল ম্যানেজমেন্ট (Rural management)। প্রত্যেক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেই গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য বহুল পরিমাণে বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে সরকারের পক্ষ থেকে। স্বাভাবিকভাবেই, এই বিনিয়োগকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ এলাকার সর্বস্তরের উন্নয়ন ঘটানোর জন্য রুরাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের প্রয়োজন হয়। ফলে পেশার জায়গাটাও অনেক বেশি। রুরাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনা করার পর সরকারি স্তরে বা বেসরকারি সংস্থা, গ্রামীণ সমবায় ক্ষেত্র-সহ নানা জায়গায় কাজের সুযোগ তৈরি হয়ে যায়।
রুরাল ম্যানেজমেন্ট (Rural management) কী?
দেশের গ্রামীণ এলাকার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ, উন্নয়নের নীতি নির্ধারণ, উন্নয়নের কর্মকাণ্ড সংগঠিত করা থেকে শুরু করে বিদ্যমান নীতিকে সংশোধন করে সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে ওঠা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকেই রুরাল ম্যানেজমেন্ট বলা যেতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনার পর দেশের উন্নতির লক্ষ্যে বিভিন্ন রুরাল ডেভেলপমেন্ট স্কিম নিয়ে কাজ করতে হয় প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের। ম্যানেজমেন্ট স্তরের বিভিন্ন কাজের মধ্যে অন্যতম রুরাল ম্যানেজমেন্ট, যেখানে সরকারি বেসরকারি সর্বক্ষেত্রেই অফরুন্ত কাজের সুযোগ রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির পেছনে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত রুরাল ম্যানেজমেন্ট প্রার্থীদের হাত রয়েছে এ-কথা বলা বাহুল্য।
কীরকম যোগ্যতা লাগে?
রুরাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পোস্ট গ্র্যাজেুয়শন স্তরে এমএ বা ডিপ্লোমা করা হয়। তার জন্য স্নাতক শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াও সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়া হয়ে থাকে। আসন সংখ্যা সীমিত থাকার কারণে প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি নেওয়া হয়। পোস্ট গ্র্যাজেুয়ট ডিগ্রি থাকলে পিএইচডি স্তরে এই বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনা করা যেতে পারে। শিক্ষাগত যোগ্যতার বাইরেও ভারতের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা, স্তরভিত্তিক বিন্যাস, গ্রামীণ সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস, আর্থিক-বাণিজ্যিক নীতি, কৃষি ব্যবস্থা, শিল্প সংগঠন— সমস্ত বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। সার্বিকভাবে উন্নয়ন ঘটিয়ে কীভাবে উন্নততর সমাজব্যবস্থা, আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব এবং গ্রামীণ প্রতিকূলতাকে সরিয়ে রেখে প্রযুক্তির হাত ধরে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। গ্রামে-গ্রামে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কাজ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। এ ছাড়াও স্থানীয় ভাষা সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা আবশ্যিক। কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে এই বিষয়টি নিয়ে সার্টিফিকেট কোর্সও করানো হয়।
কী ধরনের কোর্স রয়েছে?
গ্র্যাজুয়েশনের পর স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনা করা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে রুরাল ডেভেলপমেন্ট এবং ম্যানেজমেন্ট নামেও বলা হয়ে থাকে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্তরে এমএ ডিগ্রি বা পিজি ডিপ্লোমা ডিগ্রি করানো হয়। কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে এই বিষয়টি নিয়ে সার্টিফিকেট কোর্সও করানো হয়। এ ছাড়াও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন স্তরের পর বিষয়টিতে পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে।
কোথায় পড়া যেতে পারে?
এ রাজ্যে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রুরাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয় নিয়ে এমএ ডিগ্রি এবং পিএইচডি করানো হয়। এমএ স্তরের পড়ার জন্য অনার্স গ্র্যাজুয়েট যোগ্যতা দরকার হয়। ইগনু থেকে রুরাল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে ২ বছরের মাস্টার ডিগ্রি কোর্স করানো হয়। কলকাতায় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে এই বিষয় নিয়ে ম্যানেজমেন্ট কোর্স করা যেতে পারে। এর জন্যেও যে-কোনও শাখায় স্নাতক যোগ্যতা দরকার। রাজ্যের বাইরে পড়াশুনা করার জন্য রয়েছে ইনস্টিটিউট অব রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ (গুজরাট), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট (হায়দরাবাদ), ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব রুরাল ম্যানেজমেন্ট (জয়পুর), দ্য গান্ধীগ্রাম রুরাল ইনস্টিটিউট (তামিলনাড়ু)— এরকম বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
আরও পড়ুন-রূপান্তরকামীদের জন্য বোর্ড গঠন করল পুরসভা
কী ধরনের কাজ?
রুরাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের ম্যানেজমেন্ট থেকে প্ল্যানিং, ডেভেলপমেন্ট বা ইমপ্লিমেন্টেশন— নানা সেক্টরে কাজ করতে হয়। সরকারি স্তরে রুরাল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে যে ধরনের কাজ হয়, সেখানে উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে একাধিক স্তরে কাজ ভাগ হয়ে থাকে। বেসরকারি ক্ষেত্রেও এগজিকিউটিভ থেকে প্রজেক্ট ম্যানেজার স্তরে উন্নীত হওয়া যেতে পারে। যে-কোনও উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তাবায়নের জন্য আগে বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষা, গবেষণা, এরপর নীতি রূপায়ণ, বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তুতীকরণ এবং এরপর তার প্রক্রিয়াকরণ সমস্ত ধরনের বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিদ্যুৎ, জল, নিকাশি, শিক্ষা, ব্যাঙ্কিং, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইত্যাদির উন্নতির স্বার্থে। কোথায় কী খামতি রয়েছে, কোথায় পুরনো অবস্থার সংস্কার করতে হবে, কোন অঞ্চলে আর্থিক এবং সামাজিক দিক থেকে একেবারেই পিছিয়ে রয়েছে যাদের আধুনিকতার আয়ত্তে নিয়ে আসা দরকার এই সমস্ত কিছুই নির্ভর করে রুরাল ডেভেলপমেন্ট বা রুরাল ম্যানেজমেন্ট বিষয়টির উপর।
পেশায় চাহিদা কেমন?
রুরাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনা করলে ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকেই অনেক সময় কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এর বাইরেও সরকারি ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ রয়েছে। ইউপিএসসি বা স্টাফ সিলেকশন কমিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন দপ্তরে অফিসার নিয়োগের জন্য রুরাল ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের প্রয়োজন হয়। সরকারি জায়গার বাইরেও একাধিক নন-গভর্নমেন্ট সংস্থা যারা রুরাল ডেভেলপমেন্টের উপর কাজ করে থাকে। মাইক্রো ফিনান্স এন্টারপ্রাইজ, এগ্রি-বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, এগ্রিকালচার মার্কেটিং-ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক, ইনশিওরেন্স এবং অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থায় কাজের ব্যাপক সুযোগ। সমীক্ষা বলছে, ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষই গ্রামাঞ্চলের মধ্যে অবস্থান করে। সরকারি বা বেসরকারি প্রচেষ্টায় সেই সমস্ত অঞ্চলগুলিকে ধীরে-ধীরে উন্নয়নের রাস্তা দেখানোর জন্য একাধিক প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে, যার দরুন রুরাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনার পর কাজেরও অভাব নেই। সরাসরি চাকরির রাস্তায় না গিয়ে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য ব্যবসা বা এনজিও গড়া যায়। শিক্ষাকতার সুযোগ তো রয়েছেই।