সমুদ্রের টানে আগেই দেখা যেত পর্যটকের ভিড়, জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠার পর দিঘায় প্রায় প্রতিদিনই নামছে জনজোয়ার। বহুগুণ বেড়ে গেছে সৈকত শহরের জনপ্রিয়তা। সমুদ্রতীরে সময় কাটানো, নবনির্মিত জগন্নাথমন্দির দর্শনের পাশাপাশি বহু মানুষ ঘুরে দেখছেন দিঘা শহরের এবং আশেপাশের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট। কিছু পুরনো, কিছু নতুন। কয়েকটি স্পটের উপর আলোকপাত করলেন অংশুমান চক্রবর্তী
বাঙালির পছন্দের উইক-এন্ড ডেস্টিনেশন হল দিঘা। অনেকেই বলেন দিঘাসুন্দরী। প্রধান আকর্ষণ উত্তাল সমুদ্র, বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট, ঝাউবন। এর ইতিহাস প্রায় ৫০০ বছরের। জায়গাটা পূর্বে ‘বীরকুল’ নামে পরিচিত ছিল। অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশরা আবিষ্কার করে এবং তখন এটা ‘বিয়ারকুল’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯২৩ সালে জন ফ্রাঙ্ক স্মিথ নামে একজন ইংরেজ পর্যটক দিঘার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে বসবাস শুরু করেন। তাঁর লেখালেখির ফলে দিঘা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বাড়ে। স্বাধীনতার পর এখানে পর্যটন সুবিধা বাড়াতে তিনি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে উৎসাহ দেন। বাকিটা ইতিহাস। গত কয়েক দশকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং উপকূলীয় সবুজের কারণে দিঘা শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্রগুলির মধ্যে উঠে এসেছে। এমনিতেই সারা বছর ভিড় চোখে পড়ে। সম্প্রতি ভিড়ের মাত্রা আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দির। অক্ষয়তৃতীয়ার দিন উদ্বোধন হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিকল্পিত এই মন্দিরের। তারপর থেকেই সৈকত শহরে বেড়ে গেছে দেশ-বিদেশের পর্যটকের আনাগোনা। উপকৃত হচ্ছেন স্থানীয় মানুষেরা। বেড়েছে ব্যবসা। দিঘা শহর এবং আশেপাশে আছে বেশকিছু ট্যুরিস্ট স্পট। কিছু পুরোনো, কিছু নতুন। দিঘাকে কেন্দ্র করে ঘুরে আসা যায়। স্পটগুলো কী কী?
আরও পড়ুন-ফের হার ম্যান ইউয়ের
ওল্ড দিঘা সমুদ্র সৈকত
দিঘায় অবস্থিত ওল্ড দিঘা সমুদ্র সৈকত। জায়গাটি খুবই শান্ত। পাথরের আসনে বসে আরাম করে বিশাল সমুদ্রের ঢেউ উপভোগ কর যায়। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার জন্য একটি আদর্শ জায়গা। সমুদ্র সৈকতের অগভীর জলের মধ্য দিয়ে সূর্যের রশ্মির সোনালি রং প্রতিফলিত হয়। এই সৈকতে নেমে স্নান না করাই ভাল। যে কোনও সময় বিপদ ঘটে যেতে পারে।
নিউ দিঘা সমুদ্র সৈকত
নিউ দিঘা সমুদ্র সৈকত বাঙালির ছুটি কাটানোর জন্য অন্যতম সেরা গন্তব্য। ওল্ড দিঘা সমুদ্র সৈকত থেকে ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। একটা সময় ছিল ফাঁকা ফাঁকা। বর্তমানে প্রচুর হোটেল এবং গেস্টহাউস হয়েছে। সারা বছর বহু পর্যটক ভিড় জমান। সমুদ্র সৈকতে পাওয়া যায় সুস্বাদু খাবার। সামুদ্রিক মাছের নানারকম পদ। নিউ দিঘা সমুদ্র সৈকতের কাছে রয়েছে অমরাবতী পার্ক, মিউজিয়াম, অ্যাকোয়ারিয়াম ইত্যাদি। বহু মানুষ ঘুরে দেখেন।
উদয়পুর সমুদ্র সৈকত
উদয়পুর সমুদ্র সৈকত ওড়িশার সীমান্তে অবস্থিত অনাবিষ্কৃত এবং অপ্রচলিত সমুদ্র সৈকতগুলির মধ্যে একটি। নিউ দিঘা এবং তালসারির মধ্যে অবস্থিত। দেখা যায় ক্যাসুয়ারিনা গাছ। এখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখতে ভালো লাগে। শান্ত সমুদ্র সৈকতে বিক্রি হয় মাছ। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
গোপালপুর সমুদ্র সৈকত
গোপালপুর একটি নির্জন নিরিবিলি সমুদ্র সৈকত। ওড়িশার দক্ষিণ অংশে গঞ্জাম জেলার বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত। এটা একটা উপকূলীয় বন্দর শহর। দিঘা থেকে খুব দূরে নয়।
শঙ্করপুর সমুদ্র সৈকত
শঙ্করপুর সমুদ্র সৈকত দিঘা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দেখা যায় স্থানীয় মাছ ধরার নৌকা এবং সারিবদ্ধ গাছ। সৈকতের কাছে বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে, অনেকেই দর্শন করার জন্য যান। এই সমুদ্র সৈকত মূলত মৎস্যজীবীরা মাছ সংগ্রহ করার জন্য ব্যবহার করেন। কারণ সৈকতের এই অংশটি বেশ অগভীর এবং ঢেউ কম, যা মাছ ধরার পক্ষে অনুকূল।
চন্দনেশ্বর মন্দির
চন্দনেশ্বর মন্দির দিঘা থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মন্দিরটি ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। ওড়িয়া পঞ্জিকার প্রথম দিনে মন্দির কর্তৃপক্ষ একটি বিশাল বার্ষিক মেলার আয়োজন করে। প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক পর্যটক আসেন এবং বার্ষিক মেলায় অংশগ্রহণ করেন। জায়গাটি খুবই শান্তিপূর্ণ। যাঁরা ধর্মীয় স্থান পছন্দ করেন, তাঁরা মন্দিরটি পরিদর্শন করতে পারেন।
আরও পড়ুন-খ্রিস্টানদের পরিচালিত সংগঠনগুলির ভূমিকা তুলে ধরলেন ডেরেক
তালসারি
তালসারি সমুদ্র সৈকত ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় অবস্থিত। দিঘা থেকে খুব দূরে নয়। এলাকায় বিস্তৃত ধানের খেত, নদী এবং পাহাড় রয়েছে। এছাড়াও দেখা যায় প্রচুর নারিকেল, পাম ও ঝাউ গাছ। নির্জন সমুদ্র সৈকতে চোখে পড়ে লাল কাঁকড়া।
বিচিত্রপুর ম্যানগ্রোভ
প্রকৃতিপ্রেমীদের বেড়ানোর আদর্শ জায়গা ওড়িশার বালাসোরের বিচিত্রপুর ম্যানগ্রোভ অভয়ারণ্য। দিঘা থেকে দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। এখানে অপার শান্তি এবং বিস্ময়ের ছোঁয়া লেগে রয়েছে। বঙ্গোপসাগর এবং সুবর্ণরেখা নদীর সঙ্গমস্থলটি দেখার মতো। এখান থেকে নৌকা ভ্রমণে যাওয়া যায়। নৌকা ভ্রমণের সময় বিভিন্ন ধরনের বিরল কাছিম এবং লাল কাঁকড়া দেখতে পাওয়া যায়, যা ভ্রমণকে অসাধারণ করে তোলে।
পুরুষোত্তমপুর সমুদ্র সৈকত
ভ্রমণকারীদের জন্য একটি দুর্দান্ত অফবিট পিকনিক স্পট। দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুরের কাছে অবস্থিত। পুরুষোত্তমপুর সমুদ্র সৈকত বলা হয়। লাল কাঁকড়ায় পরিপূর্ণ। এই সৈকত ক্যাম্পিং করার জন্য বেছে নেওয়া যায়। মন্দারমণির খুব কাছেই। দিঘা থেকে দূরত্ব ৩১ কিলোমিটার।
দিঘা মোহনা
মোহনা ওয়াচ ভিউ পয়েন্টটি পুরাতন দিঘা সমুদ্র সৈকতের কাছে অবস্থিত। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সূর্যের আলোর অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করার জন্য আদর্শ জায়গা। একই সঙ্গে শান্ত এবং আকর্ষণীয়। নদী এবং সমুদ্রের সংযোগস্থল। একটি মোহনা, যেখানে অসংখ্য জেলে তাজা মাছ ধরে। তাজা মাছ কেনা যায় এবং জেলেদের ধরা বিভিন্ন ধরনের মাছ দেখা যায়।
মনচাশা
দিঘার কাছে অবস্থিত মনচাশা অন্যতম সেরা অফবিট স্থান। পৌষী বাগদা নদীর তীরে অবস্থিত। এখানকার শ্যামলী বীথি ঔষধি গাছ, ফল এবং শাকসবজিতে পরিপূর্ণ একটি বাগান। গ্রামে হেঁটে বেড়ানো সময় কাটানোর একটি ভাল উপায়। ঈশানী এবং নৈত্রী মাছের ট্যাঙ্ক পরিদর্শন করা যায়। এখানে প্রচুর মাছের প্রজনন হয়। সময় থাকলে, মধ্যযুগে নির্মিত বাহিরি মন্দিরে যাওয়া যায়। দিঘা থেকে দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার।
মন্দারমণি
দিঘার খুব কাছেই অবস্থিত দাদনপাত্রবাঢ়। বর্তমানে মন্দারমণি নামে পরিচিত। যদিও মূল মন্দারমণি দাদনপাত্রবাঢ় থেকে বেশ খানিকটা দূরে। চাউলখোলা দিয়ে যেতে হয়। দাদনপাত্রবাঢ বা মন্দারমণির বালুকাময় সমুদ্র সৈকত, ঠান্ডা বাতাস এবং তীরে দোল খাওয়া গাছপালা পর্যটকদের মুগ্ধ করবেই।
সৈকতে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য অনেক জলক্রীড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। দিঘা থেকে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার।
তাজপুর সমুদ্র সৈকত
তাজপুর সমুদ্র সৈকত একটি অসাধারণ পর্যটন কেন্দ্র। মন্দারমণি ও শঙ্করপুরের মাঝে অবস্থিত। পর্যটন কেন্দ্রটি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নির্জন নিরিবিলি সমুদ্র সৈকতে বহু মানুষ বেড়াতে আসেন। পরিবারের সঙ্গে একান্তে সময় কাটিয়ে যান।
আরও পড়ুন-মুম্বইয়ে সক্রিয় আইএস স্লিপার সেল! এনআইএর হাতে ধৃত ২
জুনপুট সমুদ্র সৈকত
দিঘা ও মন্দারমণির কাছে অবস্থিত জুনপুট এক মনোরম সমুদ্রসৈকত। ভিড় এড়িয়ে নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য আদর্শ বেলাভূমি। কাঁথি থেকে সরাসরি যাওয়া যায়। জুনপুট লাগোয়া আর একটি সৈকত বাঁকিপুট তিন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
খেজুরি সমুদ্র সৈকত
দিঘা থেকে খুব সহজেই পৌঁছনো যায় খেজুরি সমুদ্র সৈকত। ভারতের প্রথম ডাকঘর, রাজা রামমোহন রায় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থান। এখানে এলে হুগলি নদীর মোহনা দেখতে পাওয়া যাবে। বিস্তৃত বালিয়াড়ি মন ভোলাবে। পাশাপাশি রয়েছে হিজলি শরিফ, প্রাচীন ডাকঘরের ধ্বংসাবশেষ, প্রাচীন লাইট হাউস। অনতিদূরে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। আজও বর্তমান কপালকুণ্ডলা মন্দির। এছাড়াও রয়েছে ভারতের বৃহত্তম মৎস্যবন্দর দেশপ্রাণ মৎস্যবন্দর। পরিযায়ী পাখির দেখাও মিলবে।
কাঁথি
দিঘার খুব কাছে অবস্থিত কন্টাই বা কাঁথি। কাঁথি নামেও পরিচিত। সপ্তাহান্তে ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা। এই অঞ্চলে অনেক ঐতিহাসিক ভবন দেখতে পাওয়া যায়। কন্টাইতে কাজু চাষ প্রচলিত। এখান থেকে হট্টনগর শিবমন্দির যাওয়া যায়। আছে রাজবাড়ি।