এক-এক বছর পার হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক একটা মাইলফলক পূর্ণ করছে। জনগণের প্রতি সরকারের যে দায়বদ্ধতা থাকা উচিত তার প্রতি কতটা সুবিচার করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। সাধারণ মানুষের তিনটি মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান-এর যে প্রয়োজনীয়তা তা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছে পূরণ করার। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, মানবাধিকার রক্ষা এবং বৈষম্য ছাড়াই মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা যে কোনও রাষ্ট্রের বা সহযোগী রাজ্যের নৈতিক দায়িত্ব। ভারতবর্ষের সংবিধান বলছে ভারতীয় নাগরিকদের কিছু মৌলিক অধিকার রয়েছে। প্রথমত, সমতার অধিকার যা সংবিধানের ১৪ থেকে ১৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত। যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে যে কোনও ধরনের বৈষম্য প্রতিরোধ করা এবং সকলকে সমান সুযোগের নিশ্চয়তা প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার অধিকার, যা সংবিধানের ১৯ থেকে ২২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত। সেই বর্ণনায় উল্লেখ আছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, অবাধ চলাচলের অধিকার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার ইত্যাদি। তৃতীয়ত, শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার সংবিধানের ২৩ থেকে ২৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে। চতুর্থত, ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার। সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ অনুচ্ছেদে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে।
পঞ্চমত, সংস্কৃতিক ও শিক্ষার অধিকার যা বর্ণিত আছে সংবিধানের ২৯ ও ৩০ অনুচ্ছেদে। ষষ্ঠত, সাংবিধানিক প্রতিকারের অধিকার যা বর্ণিত আছে সংবিধানের ৩২ থেকে ৩৫ অনুচ্ছেদে। সুতরাং সাধারণ মানুষ সরকারের কাছে কী কী মৌলিক দাবি জানাতে পারে তা সবিস্তারে সংবিধানে বর্ণিত আছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মীয়, ভাষাগত, বিভাগীয় নানান বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করে সকলের জন্য সমানতালে কাজ করা অনেক সময় সম্ভবপর হয়ে ওঠে না সরকারগুলির পক্ষে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান অনেকটা মিনি ভারতবর্ষের মতো, যা জল, জঙ্গল, নদী, পাহাড়, পর্বত, সমভূমি, মালভূমি দ্বারা বেষ্টিত। পশ্চিমবঙ্গে বিচিত্র ধর্মের মানুষজনের বাস। সেইরকম পরিস্থিতিতে সকলের জন্য সমানভাবে ভাবনা এবং তাদের জন্য নিরন্তর জনকল্যাণমুখী কাজ করা খুবই কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে ১১ কোটির ওপর জনসংখ্যা বিশিষ্ট রাজ্যে সরকারি সুবিধা পৌঁছে দেওয়া যতটা না কষ্টসাধ্য, তার থেকে বেশি কষ্টসাধ্য জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের ভাবনা মাথায় আনা। কিন্তু বিগত ১৩ বছরের পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস অন্য কথা বলছে। সরকারের বাজেট বিশ্লেষণ বলছে বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মোট ৮ দফায় ১১ কোটির ও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। তার মধ্যে ৮ কোটির বেশি মানুষকে সরাসরি সরকারি পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। যা যে কোনও সরকারের কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তির মূলে রয়েছে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মস্তিষ্ক প্রসূত ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প। ‘দুয়ারে সরকার’ হল এমন একটি প্রকল্প যা সরকারি পরিষেবা ও কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি রাজ্যবাসীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায়। বিশ্ব ইতিহাসে এমন কোনও প্রকল্প বা কোনও সরকারের এমন সদিচ্ছা হয়েছে বলে মনে হয় না। যে প্রকল্পের সাহায্যে সাধারণ মানুষ সহজেই হাতের নাগালে তার প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি একসঙ্গে পেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের বৃহৎ শ্রেণির মানুষ এখনও গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো নানা কারণে সরকারি স্কিমগুলোয় আবেদন করতে পারতেন না। কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে সরকারি অফিসে কাজ হয়তো কালবিলম্বে হয় এবং সরকারি পরিষেবা পেতে অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয়। মাটি থেকে উঠে আসা সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী মাননীয়া মখ্যমন্ত্রী বুঝতে পেরেছিলেন গরিব মানুষের অসুবিধার কথা। যার ফলে সাধারণ মানুষজনকে সরকারের কাছে যাওয়ার বদলে সরকারকেই মানুষের সামনে হাজির করলেন। দুয়ারে সরকারের বাস্তবতা যেন মানুষ উপলব্ধি করল সর্বাত্মক ভাবে।
আরও পড়ুন- আস্থা নেই বিজেপিতে, দলত্যাগ ৫০ জনের
২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রকের ডিজিটাল ইন্ডিয়া অ্যাওয়ার্ড-এর সর্বোচ্চ প্ল্যাটিনাম পুরস্কার পেয়েছে দুয়ারে সরকার। দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ জনপ্রিয় প্রকল্পের শিরোপাও জিতে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, দুয়ারে সরকার প্রকল্পটি স্কচ অ্যাওয়ার্ডও জিতেছে। শুধু দুয়ারে সরকারের সাফল্যই নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এমন আরও অনেক সুবিধা চালু করেছে যা জনকল্যাণে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে আগামিদিনে। আটদফা দুয়ারে সরকার পরিষেবার মাধ্যমে নতুন করে ৪১ লক্ষের বেশি কৃষক ‘কৃষক বন্ধু’ (নতুনভাবে) প্রকল্পে যুক্ত হয়েছেন, আগের ১০১ লক্ষ কৃষক তো পানই। চাষির নিবন্ধীকরণের স্থিতি, MSP এর অর্থ প্রদান এবং নিবন্ধীকরণের আবেদন এবং ধান বিক্রির জন্য পছন্দসই তারিখ ও সময় ঠিক করা যাবে Paddy Procurement Portal (http://epaddy.wb.gov.in) অথবা ‘খাদ্যসাথী অন্নদাত্রী’ মোবাইল আ্যপের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক কদম এগিয়ে দুয়ারে পশু চিকিৎসার জন্য চাষিদের ঘরে ঘরে প্রাণী পালন পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাজ্যস্তরে ভ্রাম্যমাণ প্রাণী পালন চিকিৎসাকেন্দ্র খুলেছে। ইতিমধ্যে ৩৪৪টি ব্লকে কলসেন্টার পরিষেবার মাধ্যমে কাজ শুরু করে দিয়েছে। দুয়ারে রেশন প্রকল্পের মাধ্যমে ‘খাদ্যসাথী’ সুবিধা প্রাপকরা e-pos পদ্ধতিতে Aadhaar No এর ভিত্তিতে খাদ্যশস্য প্রায় ঘরে বসেই পাচ্ছেন। এমনকী হাতের কাজ শেখার জন্য ‘আমার কর্মদিশা ২.০’ সেবা পোর্টাল চালু করেছে নতুনদের কাজ শেখানোর জন্য। ই-খাজনা (e-khajna) মডিউল দ্বারা সাধারণ মানুষ ঘরে বসেই ভূমি রাজস্ব জমা দিতে পারছে। দূরদূরান্তে বসে পরিযায়ী শ্রমিকরা ‘কর্মসাথী’ পোর্টাল বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে পারছে। স্কুল বা কলেজের ভর্তি হোক বা স্কলারশিপ, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে পঞ্চায়েতে বা পুরসভার নাগরিক পরিষেবা, সরকারি অনুদান হোক বা ব্যবসা বাণিজ্যের আবেদন ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে পরিষেবা প্রদান জনগণের কাছে সেরা প্রাপ্তি। এককথায় বলতে গেলে সরকার এখন জনগণের হাতের মুঠোয়। এরপরও যদি কেউ কোনও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন তাহলে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং তাঁদের অভিযোগ শুনছেন এবং তার ফলাফলও আমরা নানান সময়ে দেখতেও পাচ্ছি।
আসলে জনগণের জন্য সরকার, আর জনগণ সরকারের কাছে কী চাইছে সেটা যদি সরকার আগে থেকেই অনুমান করতে পারে তবে সরকারের সার্থকতা সেখানেই। সরকারকে কীভাবে মানুষের উন্নতিকল্পে লাগানো যায় তার ভাবনা সর্বস্তরের থেকে ভাবছেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী (Mamata Banerjee)। জনগণের অধিকার রক্ষায় এহেন প্রয়াস আগের কোনও রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজ্যপ্রধান করেছেন কি না তা বলা কঠিন।