সংরক্ষণ এক জীবন্ত জ্ঞান
ভোরের নরম আলো ছড়িয়েছে চারদিকে। চোখ মেলতে শুরু করেছে গ্রাম। হঠাৎ ওয়ানাডের সবুজের বুক চিরে বেরিয়ে আসেন এক আদিবাসী মহিলা। পিঠে ঝুড়ি। তাঁর পিছু নেয় একদল ল্যাঙ্গুর। মাথা নাড়তে নাড়তে তাঁর পথ ধরে ছুটে যায়। অন্যদিকে রাজস্থানের দূরবর্তী তৃণভূমিতে, একজন বিষ্ণোই বৃদ্ধ তাঁর খেতের কাছে চরতে থাকা একটি একাকী কৃষ্ণসার হরিণকে জল দেন। আরও অনেক দূরে মেঘালয়ে, মাওলিনং গ্রামে, যা এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার বলে পরিচিত, ভোরের নীরবতা মুছে দিয়ে মুখরিত হয়ে ওঠে মৌমাছি এবং পাখির কলরবে। কর্নাটকের আগুম্বে গ্রামে মানুষের নিকটতম প্রতিবেশী বিষধর সাপ! নাগাল্যান্ডের খোনোমা গ্রাম বর্তমানে শিকার-মুক্ত। হিমাচল প্রদেশের স্পিতির বৌদ্ধ মাঠগুলো দিয়ে আসছে অহিংসার শিক্ষা। বলে আসছে ক্ষুদ্রতম পোকামাকড়কেও রক্ষা করার কথা। এইগুলো কিন্তু গল্পকথা নয়, বাস্তব। ভারতের কিছু অংশে মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে দ্বন্দ্বের নয়, রচিত হয়েছে সম্প্রীতির সম্পর্ক। পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা এবং ক্রমবর্ধমান মানুষ-বন্যপ্রাণীর উত্তেজনার সঙ্গে লড়াই করা বিশ্বে, এই সম্প্রদায়গুলি এমন একটি জীবনধারা সংরক্ষণ করেছে, যা প্রকৃতির বন্যপ্রাণীদের সম্মান করে, রক্ষা করে এবং উদযাপন করে। দেশের এই জায়গাগুলোতে সংরক্ষণ কেবল একটি নীতি নয়, এটা একটা জীবন্ত জ্ঞান, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। এখানে ভারত জুড়ে এমন কয়েকটি অনুপ্রেরণামূলক জায়গার কথা বলা হল, যেখানে মানুষ এবং বন্যপ্রাণী কেবল পাশাপাশি নয়, বরং আত্মীয়তার সঙ্গে বসবাস করে।
আরও পড়ুন-বনমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে আবদার পড়ুয়াদেরও
গড়ে উঠেছে সবুজ গ্রাম
কিছুদিন আগেও নাগাল্যান্ডের খোনোমা গ্রামে শিকার ছিল জীবনযাত্রার অঙ্গ। কিন্তু ১৯৯৮ সালে, বাসিন্দারা স্বেচ্ছায় তাঁদের বনভূমির ২০ বর্গকিলোমিটারকে শিকার-মুক্ত অঞ্চল ঘোষণা করেছেন। ফলে সেখানে ভারতের প্রথম সবুজ গ্রাম গড়ে উঠেছে। তখন থেকে খোনোমা সম্প্রদায়-চালিত সংরক্ষণ হয়ে উঠেছে একটি আলোকবর্তিকা। এই গ্রাম প্রমাণ করেছে যে, সংরক্ষণ প্রচেষ্টা বাইরে থেকে আসে না। যদিও এই পরিবর্তন সহজ ছিল না। এর মধ্যে ছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংলাপ, সাংস্কৃতিক অভ্যাসের পরিবর্তন। আজ, বনাঞ্চলটি বার্কিং ডিয়ার, হর্নবিল, সিভেট এবং বিরল প্রজাপতির বিচরণক্ষেত্র। ভবিষ্যতে এই বনে বাঘ ঘুরে বেড়ালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
শিশুদের মধ্যে সঞ্চারিত
রাজস্থানের শুষ্ক মরুভূমিতে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে এক আশ্চর্য সম্প্রীতির সম্পর্ক রচিত হয়েছে। পঞ্চদশ শতকে গুরু জাম্বেশ্বর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তাঁদের বিশ্বাসে ২৯টি নির্দেশিকা নীতি রয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলো পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাঁরা সবুজ গাছ কাটেন না, পশু শিকার করেন না, বাসা-বাঁধা পাখিদের বিরক্ত করেন না। কৃষ্ণসার হরিণ, ময়ূর এবং নীলগাইয়ের প্রতি স্নেহ ঝরে পড়ে। প্রাণীগুলো তাঁদের মাঠে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই করুণা কিন্তু প্রতীকী নয়; জীবন্ত। বিষ্ণোই পরিবারগুলো বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার জন্য পরিচিত।
১৭৩০ সালে এখানকার অমৃতা দেবী বিষ্ণোই নামের এক নারী খেজরি গাছ রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই ঘটনাটি পরিবেশ রক্ষার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। রাজা অভয় সিংয়ের নির্দেশে সৈন্যরা খেজরি গাছ কাটতে এলে অমৃতা দেবী এবং তাঁর তিন কন্যা-সহ গ্রামবাসীরা গাছগুলিকে জড়িয়ে ধরে এর প্রতিবাদ করেন। এই সময় গাছ কাটার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁরা শহিদ হন। অমৃতা দেবীর করুণ পরিণতির কাহিনি এই অঞ্চলের নীতি-নৈতিকতায় গভীরভাবে গেঁথে আছে। আজ, এই মূল্যবোধগুলি ভাষার মতোই স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে, যা বংশ পরম্পরায় বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে।
জীববৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা
মেঘালয়ের পূর্ব খাসি পাহাড়ে অবস্থিত মাওলিনং। গ্রামটি এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। দাগহীন অলিগলি এবং বাঁশের ডাস্টবিনের বাইরে আরও কিছু লুকিয়ে আছে এই গ্রামে। সেটা হল প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। এখানে, বন কেবল একটি পটভূমি নয়; একটি আবাসস্থল। স্থানীয় খাসি উপজাতির মানুষেরা পবিত্র বনভূমিকে সম্মান করেন এবং গ্রামবাসীরা প্রাচীন বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের জন্য একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। এই অঞ্চলে বনের বিশাল অংশে শিকার নিষিদ্ধ। পর্যটকদের ফুল ছিঁড়ে ফেলা বা পোকামাকড়কে বিরক্ত না করার জন্য অনুরোধ করা হয়। আনন্দের সঙ্গে উড়ে বেড়ায় প্রজাপতি, পাখি। ছুটে বেড়ায় নানারকমের প্রাণী। নিশ্চিন্তে, নিরাপদে। ছড়িয়ে রয়েছে শান্তি হিমাচল প্রদেশের স্পিতি। প্রথম নজরে অনূর্বর মনে হতে পারে। কিন্তু এর নিরেট ভূদৃশ্যে লুকিয়ে আছে তুষার চিতাবাঘ, আইবেক্স এবং নীল ভেড়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, এই অঞ্চলের বৌদ্ধ মঠগুলি অহিংসা এবং করুণার শিক্ষা দিয়ে আসছে। বলে আসছে ক্ষুদ্রতম পোকামাকড়কেও রক্ষা করার কথা। কিব্বার এবং ল্যাংজার মতো গ্রামে, এই আধ্যাত্মিক দর্শন বিশ্বের সবচেয়ে অধরা কিছু প্রজাতিকে রক্ষা করতে সাহায্য করেছে। সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে শান্তি। এই শান্তি আসে জ্ঞান থেকে। ভদ্রভাবে বেঁচে থাকাও একটি শিক্ষা। এখানকার মানুষ অন্যরকম জীবনযাপনের পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন, উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্যকে সবসময় সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয় না।
আধুনিকতার চাপ বাড়ছে
কেরলের ওয়েনাডের পাহাড়ি বনাঞ্চলে, আদিবাসী সম্প্রদায়, বিশেষ করে কুরিচিয়া এবং পানিয়া উপজাতিরা দীর্ঘদিন ধরে সবুজ বনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বসবাস করে আসছেন। তাঁদের ঘরবাড়ি টেকসই উপকরণ দিয়ে তৈরি, তাঁদের খাদ্য আসে বনজ সম্পদ থেকে। তাঁদের আধ্যাত্মিক অনুশীলনগুলো সমস্ত জীবন্ত জিনিসকে সম্মান করার উপর কেন্দ্রীভূত। তাঁরা সহজেই বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মিশে যান। তাঁদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন। হাতি, বুনো শুয়োর এবং বানর প্রায়শই কৃষি জমিতে নিরাপদে ঘুরে বেড়ায়। কেউই হিংসাত্মক প্রতিশোধ নেন না। পরিবর্তে, অনেক কৃষক ধোঁয়া, ফলের ফাঁদ বা শব্দ তৈরির মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিরোধক ব্যবহার করেন। বয়স্করা শিশুদের শেখান কীভাবে পথ বুঝতে হয়, বিভিন্ন প্রাণীর ডাক আলাদা করতে হয় এবং তাদের ক্ষতি না করে কীভাবে নিরাপদ থাকতে হয়। যদিও আধুনিকতার চাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলো এখনও হয়তো পিছিয়ে রয়েছেন। তবে তাঁরা প্রমাণ করেছেন, সংঘাতের চেয়ে সহাবস্থান অনেক ভাল হতে পারে। এর পিছনে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রী সুশাসনে জনমুখী প্রকল্পে বাংলায় এসেছে ‘ডিজিটাল বিপ্লব’
কোবরা রাজধানী
সাপের নাম শুনলেই মনের মধ্যে জাগে ভয়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই সরীসৃপের উপস্থিতি চিরন্তন। কখনও শিবের গলায় জড়িয়ে রয়েছে, কখনও আবার গ্রামবাংলার মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কৃষকের উপর। লোককথা থেকে পুরাণ, মন্দির থেকে মাটির ঘর— সব জায়গাতেই সাপের ছায়া। তবে জানেন কি, ভারতে এমন একটি গ্রাম রয়েছে, যেখানে সাপ কেবল পুরাণের চরিত্র নয়— তারা বাস্তবের রাজা? এমন একটি জায়গা, যেখানে সাপ শুধু প্রতিবেশী নয়, বরং এখানকার সংস্কৃতি, জীববৈচিত্র্য ও গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। এক গ্রাম, যার সঙ্গে ‘কোবরা’ শব্দটি জুড়ে আছে, ঠিক যেমন গঙ্গার সঙ্গে হিমালয়। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ থেকে আধুনিক আচার— সর্বত্রই এই বিষধর সাপটি যেন দেবতাদের এক প্রতীক। প্রতি বছর নাগপঞ্চমী উৎসবে দেশ জুড়ে হয় নাগদেবতার পুজো। কিন্তু শুধু পুরাণেই নয়, ভারতের কিছু কিছু অঞ্চল বাস্তবেও সাপের আধিপত্যের জন্য বিখ্যাত। তেমনই একটি জায়গা পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বুকে অবস্থিত কর্নাটকের আগুম্বে। গ্রামটিকে বলা হয় ‘ভারতের কোবরা রাজধানী’। এখানে এত বৃষ্টি হয় যে একে ‘দক্ষিণের চেরাপুঞ্জি’ও বলা হয়। সবুজ-শ্যামল ছোট গ্রাম। আয়তনে মাত্র ৩ বর্গ কিলোমিটার, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ২৭০০ ফুট। মাত্র ৬০০ জনের বাস এই জনপদে। চারপাশে ঘন অরণ্য, পাহাড়, জলপ্রপাতে ঘেরা এই জায়গা প্রকৃতিপ্রেমী ও বন্যপ্রাণ গবেষকদের কাছে স্বর্গরাজ্য। শুধুই সাপের জন্য নয়, এখানকার গাঢ় অরণ্যে দেখা মেলে বহু দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের। ভারতের কোবরা রাজধানী আগুম্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বাসিন্দা নিঃসন্দেহে রাজনাগ বা কিং কোবরা। বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা বিষধর সাপ। তবে সবার থেকে আলাদা, কারণ অন্য সাপের মতো ইঁদুর বা ব্যাঙ নয়— এরা মূলত অন্য সাপ খায়। এমনকী বিষধর সাপ যেমন ক্রেইটকেও এরা খাবার হিসেবে বেছে নেয়। সাপদের সাপ— বনের খাদ্য শৃঙ্খলে একেবারে শীর্ষে। এই আগুম্বেই ভারতের সেই রহস্যময় প্রাকৃতিক কোষাগার— যেখানে সাপ শুধু ভয় নয়, গবেষণা, শ্রদ্ধা আর জীববৈচিত্র্যের চাবিকাঠি। দেশ জুড়ে এরকম দ্বিতীয় কোনও গ্রাম নেই— যেখানে সাপ এতটা নিকটতম এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী।