দীর্ঘদিন কবিতা-চর্চায় নিমজ্জিত রয়েছেন মধুসূদন দরিপা। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘আর্ষ’। সমাদর পেয়েছে বিদগ্ধ পাঠক মহলে। বেরিয়েছে এই কবির কয়েকটি কবিতার বই। হাতে এসেছে ‘অস্তরাগ’। সিগনেট প্রেস প্রকাশিত ৪৮ পৃষ্ঠার বইটিতে আছে ৪০টি নাতিদীর্ঘ কবিতা। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, কবিতাগুলো যেন নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। আত্মসংলাপ। নিচু স্বরে বাঁধা নীরব কবিতা। শান্ত। ধীরে ধীরে মরমে প্রবেশ করে। ভাবায়। দেয় প্রাণের আরাম। ছবি আঁকেন কবি। অক্ষর দিয়ে। অক্ষরের পাশে অক্ষর সাজিয়ে রচনা করেন এক আশ্চর্য মায়াজগৎ। যে জগৎ তাঁর একান্ত নিজের। তাঁর হাত ধরেই প্রবেশ ঘটে আগ্রহী পাঠকের। আলোর রোশনাই নয়, সেখানে জ্বলে মাটির প্রদীপ, মোমবাতি।
আরও পড়ুন-১০ বছরেও দূর হবে না বেকারত্ব, মত বিশেষজ্ঞদের
কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘জলরেখাসীমা’। কবি বলেছেন জীবনের বিভিন্ন পর্বের কথা। সম্পর্কের কথা। শুরুটা এইরকম— ‘তখন নিকটে ছিল জল/ হাত বাড়ালেই ভিজে যেত/ জীবন যৌবন।’ এই জল হল সম্পর্ক। সম্পর্কের নানা রং। নানা নাম। অংশটি প্রকাশিত হয়েছে সহজ সরল ভাষায়। পরের অংশে কবি বলেছেন, ‘জলের গভীরে যেতে চিরকাল ভয়।’ এই ভয় কী কারণে? তিনি কি সম্পর্ক-পলাতক? প্রেম-পলাতক? এড়িয়ে চলেন বৃত্তের গভীর? হয়তো তাই। যদিও তিনি রোমাঞ্চিত হন অন্যকে দেখে। বলেন, ‘অথচ তোমাকে দেখি/ কী অনায়াসে/ ডুব দিয়ে ছুঁয়ে আসো/ প্রবালের দেশ।’ কোথাও যেন আক্ষেপ ঝরে পড়ে। দেখা যায় বৈপরীত্য। সঙ্কোচনের পাশে প্রসারণ। একজন ভীরু। অন্যজন দারুণ সাহসী, মরিয়া, জানেন সম্পর্কের স্বীকৃতি আদায় করতে। শেষমেশ নিজের পরাজয় মেনে নেন কবি। ততক্ষণে জলরেখাসীমা বহু যোজন দূরে।
একটি কবিতা থেকে আরেকটি কবিতায় যেতে যেতে মনে হয়েছে, এই কবির কবিতা বহুমাত্রিক। বিচিত্র বিষয় তিনি ছুঁয়ে যান। ব্যতিক্রমী তাঁর উপস্থাপন। আছে পরিমিতিবোধ। গভীর কথা বলে দেন সহজেই। ‘সপ্তরথী’ কবিতায় তিনি লেখেন, ‘মানুষের মুখ দেখি/ জড়দের মুখ দেখি/ মানুষ জড়ের মতো হয়/ এই সত্য জানি।’ প্রথম দুই পঙক্তি চমকহীন। কিন্তু তৃতীয় পঙক্তিতে এসে জোর ধাক্কা লাগে। বলছেন কী? ‘মানুষ জড়ের মতো হয়’? হয় কি? নিজের দিকে প্রশ্ন রাখি। উত্তর পেয়ে যাই। হয় তো। অবশ্যই হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ তো জড়ের অধিক। নীরব দর্শক। বাক্যহীন থাকে অন্যায় দেখেও। কবি আঙুল তুলেছেন সমাজের প্রতি। আমাদের প্রতি। যাওয়া যাক পরের অংশে। কবি লেখেন, ‘জড় কী মানুষ হয়?/ এই সত্য জানে যারা/ সপ্তরথী হয়ে তারা/ প্রতিদিন সূর্যের রথ টেনে যায়।’ অংশটি কবিতাটিকে আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। মানবের মাঝে কেউ কেউ অতিমানব। তারাই সপ্তরথী হয়ে সূর্যের রথ টেনে নিয়ে যেতে পারে। জীবন টেনে নিয়ে যেতে পারে। ‘জড় কী মানুষ হয়?’-এর ‘কী’টা ‘কি’ হওয়া উচিত ছিল। যেহেতু উত্তরে আসে ক্রিয়াবিশেষণ। কবিতাটি অনবদ্য।
আরও পড়ুন-সাকা ম্যাজিকে শেষ চারে ইংল্যান্ড
মৃত্যুচেতনা ধরা পড়েছে কয়েকটি কবিতায়। ‘মৃত্যু’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘মৃত্যুকে বন্ধু মনে হয় এই বেলা/ তার সাথে কথা হয় রোজ/ সে সব সান্ধ্যভাষা সাংকেতিক সব/ ইশারায় বুঝে নিতে হয়।’ মৃত্যু চিরসত্য। অনিবার্য। তাই ভীত নন কবি। থাকেন আশ্চর্য স্বাভাবিক। সাংকেতিক, সান্ধ্য ভাষায় মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর কথোপকথন চলে। তিনি মৃত্যুর মুখ দেখেন। কীভাবে? কবিতাটি যায় পরাবাস্তবতার দিকে। কবি লেখেন, ‘আলো নয় অন্ধকারে তার/ মুখ দেখা যায়।’ অংশটি কুয়াশাচ্ছন্ন। রহস্যময়। বিস্তার করে মায়াজাল। কবির হাত ধরে আমরাও মনে মনে কল্পনা করি মৃত্যুর মুখ। গাঢ় অন্ধকার।
ভাল লাগে ‘সহবাস’, ‘অধিকার’, ‘পরিচয়’, ‘সঙ্গম’, ‘কৃপা’, ‘পাহাড়িয়া’, ‘রোদ’, ‘ছায়া’, ‘আলো’ প্রভৃতি কবিতাগুলো। অস্তরাগ প্রতিফলিত হয় সূর্যাস্তের পরে। এই ‘অস্তরাগ’ পাঠের শেষে পাঠক-মনে ঘটে বোধের উন্মেষ। চতুর্দিক থেকে ঠিকরে পড়ে আলো। জ্ঞানের আলো। থেকে যায় দীর্ঘক্ষণ। শান্তনু দে-র প্রচ্ছদ মায়াময়। দাম ২৫০ টাকা।
আরও পড়ুন-১০ বছরেও দূর হবে না বেকারত্ব, মত বিশেষজ্ঞদের
অস্তরাগ
মধুসূদন দরিপা
সিগনেট প্রেস
২৫০ টাকা