যখন তিনি ডাকাত কালী

এক সময় আলো জ্বলেছে গ্রামগুলোতে! অতীতে এই গ্রামগুলোই ছিল অন্ধকারে ঢাকা। গ্রাম দখল ও লুঠপাট করে মশাল জ্বালিয়ে আসত ডাকাতের দল। রঘু, বিশু, কালু, ভৈরব, মদন, গাজি সে যুগের বিখ্যাত সব ডাকাতের নাম। তাঁরাই কালীপুজো করে, নরবলি দিয়ে রণপায়ে চেপে বেরোতেন ডাকাতি করতে। বাংলার বিচিত্র সব ডাকাতকালী নিয়ে লিখছেন রাধামাধব মণ্ডল

Must read

ডাকাত সর্দার
প্রহ্লাদের কালী বামা
পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগর পঞ্চায়েত এলাকার পাণ্ডুক গ্রামের ডাকাত দলের সাধকদের হাতে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ১৫৩ বছরের পুরোনো বামা কালী। এখানে কালী মায়ের বাঁ পা-টি এগিয়ে থাকে। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় ২২ ফুট উচ্চতার মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরি করে পুজো হয়। পাণ্ডুক গ্রামের মেটে পরিবারের পূর্বপুরুষেরা রাঢ়ের বিখ্যাত ডাকাত ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা ডাকাতি করতে যান সালারের কাছে কেতুগ্রাম থানার মেটলি গ্রামের ‘রামসীতা’ মন্দিরের স্বর্ণালঙ্কার। যাওয়ার পথে বীরভূমের মুলুকের কাছে অপরূপা নারীমূর্তি দেখে চমকে ওঠেন। ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ মেটের নির্দেশ ছিল, ডাকাতির পথে মেয়ে মানুষ আর শিশুর গায়ে হাত তোলা যাবে না। সে নীতি লঙ্ঘন করায় এক সদস্যকে সর্দার প্রহ্লাদ এক কোপে দু’টুকরো করে দেন। সেই সঙ্গে নারীর কাছে তার এই ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চান। সেই অপরিচিতা নারীর কাছে জানতে চান, “মা আপনি কে এই রাত্রিকালে? তখন নারী জানায়, আমি কালী বামা। ডাকাতি করতে যাওয়ার পথে, ডাকাতদলটি দেখে মা পথে মৃন্ময়ী মূর্তি থেকে চিন্ময়ী মূর্তি ধরে জানান, আমাকে এখান থেকে নিয়ে না গেলে তোদের সর্বনাশ হবে। তখন ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ বলেন, অত বড় মূর্তি নেওয়া অসুবিধে সঙ্গে এও বলেন, আজকে রাতে ডাকাতিতে সাফল্য পেলে, তবেই মা তোকে নিয়ে যাব। কথিত আছে, মায়ের আশীর্বাদে সাফল্যও পায় ডাকাত দলটি। তাই ডাকাতি করে ফেরার পথে, বামা মায়ের ছোট শিলা মূর্তিকে সঙ্গে নিয়ে ফেরে ডাকাত দলটি। পাণ্ডুক গ্রাম ঢোকার পথে মায়ের নির্দেশমতো তির ছোঁড়েন এবং সেই তির এসে পাণ্ডুক গ্রামের মাঝখানে পড়ে। সেখানেই মা বামাকে স্থাপন করেন সাধক ডাকাত প্রহ্লাদ বুড়ো।

আরও পড়ুন-তিনিই মহাকালী তিনিই মহালক্ষ্মী

বর্তমানে গ্রামের সমবেত মানুষের চেষ্টায় বিশাল শ্বেত মোজাইক পাথরের মন্দির নির্মিত হয়েছে, ১৪১২ সনে। যা একটি দর্শনীয় স্থান। পুরনো রীতি মেনে ডাকাত পরিবারের সদস্যরা, বামা কালীর পুজোতে এখনও কোনও না কোনও জিনিসপত্র চুরি করে আনে। ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ বুড়োর বংশধর মেটেরাই মা বামার পুজো করে।
কার্তিক মাসে অমাবস্যার গভীর রাতে, ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে ডাকাতদলের সদস্যরা মায়ের ঘট এনে পুজো করত প্রতিমার। পরে পুজো, বলি হয়ে গেলে, পরদিন রাতে কাঁধে তুলে মাকে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন করত রসফাল্লা পুকুরে। তারপরই ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ বুড়োসহ সকলে কাঁদত, মায়ের টানে। তাই মা বামার নির্দেশে তারা পরবর্তীকালে গ্রামের মেটেপাড়ায় বারোমাস একটি মূর্তি গড়ে রেখেছিল। সেটাই তারা পুজো করে, বের হত ডাকাতিতে।

আরও পড়ুন-শারদ সাহিত্যের আলোকিত অক্ষরমালা

তেলো ভেলোর
মাঠের ডাকাত কালী
মা সারদা, পায়ে হেঁটে তাঁর গ্রাম কামারপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বরে যাচ্ছিলেন সঙ্গে আরও কয়েকজন মহিলা ছিলেন। ছিলেন ভূষণ মা-ও। হাঁটাপথে ক্লান্তি, তবুও সন্ধের আগে তেলো ভেলোর মাঠ পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা সকলের। সঙ্গীরা এগিয়ে গেলেও, মা সারদা পথে হাঁটতে পারেননি। পিছিয়ে পড়লেন। ডাকাতের ভয়ে সঙ্গীরা তাঁকে ফেলে এগিয়ে যায়। মা-ও বলেন, তারকেশ্বরে গিয়ে ওঠো, সেখানেই তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। কামারপুকুর গ্রাম থেকে আরামবাগ আট মাইলের পথ। জলাজঙ্গলের পথ ছিল সেদিন। আর ওই মাঠটির নাম এখনও তেলো ভেলোর মাঠ। সেটি ছিল ডাকাতদের ঘাঁটি। জনমানুষশূন্য অন্ধকার মাঠে মা চলছেন একা। এমন সময় হাড় হিম করা চিৎকার। দৈত্যের মতো কালো এক চেহারার প্রকাণ্ড মানুষ, লাঠি ঠুকে এসে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার মাথায় ঝাঁকড়া চুলের গোছা, হাতে পায়ে লোহার বালা, কপালে রক্ততিলক। আচমকা এমন রূপ দর্শন করে, মা চমকে উঠলেন। মা সারদা বুঝতে পারলেন, তিনি ডাকাতদের কবলে পড়েছেন। কেউ বলেন সেই ডাকাত সর্দারের নাম ছিল সাগর সাঁতরা, তবে তাঁকেই অনেকে ডাকাত ভীম বলে জানত। সে কর্কশ গলায় মাকে প্রশ্ন করে, কে তুই? কোথায় চলেছিস? মা বললেন, আমি তোমার মেয়ে গো বাবা, সারদা। যাচ্ছি তোমার জামাইয়ের কাছে দক্ষিণেশ্বরে। বিচলিত না হওয়া গলায়, মায়ের এমন উত্তর শুনে চমকে ওঠে সর্দার ভীম। মন টলে গেল, ডাকাতের। সেই সময়ই মা সারদা স্মরণ করেন রামকৃষ্ণ ও জগতের জননীকে। হঠাৎ এক অলৌকিক আলোতে, ভরে গেল তেলো ভেলোর মাঠ।

আরও পড়ুন-বিজেপির ভাঁওতা মানুষ ধরে ফেলেছে

মা সারদার পরনে ছিল সাদা শাড়ি, তবে লাল পাড়। মাথায় ঢালা সিঁদুরে ডগমগ হয়ে জ্বলছে, অন্ধকারে। মা অনুভব করলেন, যেন মা এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে আর ভয় নেই। ডাকাত দলের অনেকেই দেখতে পেলেন, এ যেন সারদা নন, দাঁড়িয়ে আছে সর্দারের মেয়ে। সারদার কণ্ঠস্বর শুনে, ছুটে এসে ডাকাত ভীম সর্দার মায়ের হাত দুটো ধরেন। মা সারদা আবার বলেন, চিনতে পারো না। আমি সারদা, তোমার জামাইয়ের কাছে দক্ষিণেশ্বরের রাণি রাসমণির কালীবাড়ি যাচ্ছিলুম। সঙ্গীরা সবাই এগিয়ে গেছে। আমি তো আর হাঁটতে পারছি না। ভাগ্যে তোমরা এলে। ততক্ষণে ডাকাতের স্ত্রী এগিয়ে এসেছে সত্যি সত্যিই।
সেই সে রাতে, সারদাকে জোর করে নিয়ে যায় তার বাড়ি। মা-কে খাইয়ে, পরম আদরে বিছানা পেতে দেয় মাটির দাওয়াতে। পরদিন ভোর হতেই, ডাকাত সর্দার ভীম নিজে মাকে পৌঁছে দেয়, সঙ্গীদের কাছে। মেয়ে রূপে দেখা এই মাকে, প্রতিষ্ঠা করে ডাকাত সর্দার ভীম। এখনও মেয়ে রূপে তাঁর পুজো হয়। মায়ের নিত্যভোগের সঙ্গে দেওয়া হয়ে থাকে মুড়ি মুড়কি চালভাজা। সে রাতে মা সারদাকে খেতে দেওয়া সর্দারের সেই খাবারই আজও মায়ের ভোগে লাগে।

আরও পড়ুন-১০ দুষ্কৃতী মিলে গণধর্ষণ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে

মুর্শিদাবাদের জলঙ্গিতলার ডাকাত কালী
জেলা মুর্শিদাবাদের শক্তিপুর বেলডাঙা ২ নং ব্লকের শক্তিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের, রামনগর-বহরমপুর রাস্তার উপর, তালডাঙার জলঙ্গিতলার এই ডাকাত কালীর স্থান। কার্তিক মাসের অমাবস্যার গভীর রাতে, ডাকাত কালীর পুজো হয়। এখানকার ডাকাত সর্দার ছিলেন হাজরা পরিবারের কেউ। জানা যায় তিনিই ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে, এই কালীর আরাধনা করতেন। পরে যেতেন ডাকাতিতে। তান্ত্রিক ডাকাত সর্দার নিজের হাতে এই পুজো ইংরেজ আমলে শুরু করেছিলেন বলে জানান এলাকার বাসিন্দা অজিত রায়। ডাকাত সর্দার পরিবারের হাজরাদের ছয় পরিবারের শরিকরা, পালা করে এই পুজোর ব্যয়ভার বহন করেন। আজও জাঁকজমক করে পুজো হয়। আর এখানকার ২১ পোয়া প্রাচীন নিয়মের মাটির মূর্তি বর্তমানে ছোট করা হয়েছে, নানা কারণে। তবে আজও রজ, বীর্য ও ডাকাতি বীরত্বের প্রথায়, হাজরা সর্দার প্রতিষ্ঠিত তিন আসনে মায়ের মূর্তিকে নিয়ে গিয়ে পুজো ও বলি প্রথা চালু রয়েছে।

আরও পড়ুন-ঋষিকে প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ বরিসের

গড় শিমুলিয়ার
ডাকাত কালী পুজো
হুগলি জেলার এই মাঠ ও প্রাচীন গড়ের এলাকাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। গড় শিমুলিয়ার এই ডাকাত কালীবাড়ি আর কালীর ইতিহাসের প্রাচীনত্ব প্রায় ৮০০ বছরের। এ অঞ্চল তখন ছিল গভীর জঙ্গলের ঘেরাটোপে বন্দি জনমানবহীন এক ভয়ঙ্কর এলাকা। গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রথম ডাকাতরাই শক্তির সাধনা শুরু করেছিল। এলাকার মানুষের কাছে জানা যায়, এই জঙ্গলে ডাকাতরা কালীর পুজোতে লোকালয় থেকে মানুষকে তুলে এনে বলি দিত।
ধীরে ধীরে জঙ্গল কেটে, মানুষের বসতি শুরু হয়। ডাকাতরাও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ক্রমশ ডেরা গুটিয়ে নিয়ে, চলে যায় অন্যত্র আরও জঙ্গল গভীরে। সে ঘটনার অনেক পরে, দুর্গাদাস শিরোমণি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মায়ের পুজোকে আরও জনকোলাহলে আনেন। প্রতি বছর কার্তিক মাসের অমাবস্যা নিশিতে মায়ের পুজো হয়। মেলা বসে। শিমলাগড়ের এই ডাকাত কালীর গলায় রক্তজবা ফুলের মালা, নিত্যদিন বদলে দেন পুরোহিত। মাথায় সোনার মুকুট, মানুষের দানে হয়েছে। আর শ্বেতপাথরের বেদির উপর, প্রায় ফুট পাঁচেক মায়ের বিগ্রহের উচ্চতা। মন্দিরের সামনে, বিরাট ফাঁকা মাঠ ও মাঠে সুবিশাল নাটমন্দির, শ্বেতপাথরে মোড়া।

আরও পড়ুন-ঋষিকে প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ বরিসের

আউশগ্রাম মেটেপাড়ার
ডাকাত কালী
জনশ্রুতি আজও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বন নবগ্রাম গ্রামের মেটেপাড়ায় ছিল দুর্ধর্ষ ডাকাত দল। তাদের অত্যাচারে, এলাকার জমিদাররা ভয়ে কাঁপত। সেই আতঙ্কেই জমিদাররা সমবেত হয়ে, কথিত আছে, বেশ কিছু চোর, ডাকাত ও ফাঁসুড়েদের সমবেত ভাবে আক্রমণ করতে পাঠায়, মেটেপাড়ায়। স্বয়ং কালী মা এ গ্রামের চোর কুলিতে, সেই আক্রমণকারীদের হত্যা করেন। সেই ডাকাতদের ডাকাত কালী আজও পূজিত হয়ে আসছে। গ্রামের মেটেপাড়ায় ‘ডাকাত’ পরিবারের এই কালী, পাণ্ডুকের বিখ্যাত ডাকাত কালী বামার বোন বলে পূজিত হয়। কার্তিকী অমাবস্যায় পুজো হয়। বর্তমানে গ্রামের ডাকাত পরিবারের সদস্য কেষ্ট মেটে, পঞ্চানন মেটে, উত্তম মেটেরা কালীর পূজারি। গ্রামে সে সময় বেশ কয়েকটি ডাকাতদের দল গড়েছিল মেটেরা। থান্দারপাড়া বলে মেটেদেরই অন্য একটি পাড়াতে, রয়েছে আরও একটি ডাকাত কালী। তাদের পরিবারের সুরেন্দ্রনাথ মেটে ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত ডাকাত। তাঁরই হাতে প্রতিষ্ঠিত কালীটি এখনও পূজিত হয়ে আসছে গ্রামে।

আরও পড়ুন-সম্মেলনকক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হল জিনতাওকে

সিঙ্গুরের ডাকাত কালী
পুরুষোত্তমপুরের ডাকাত কালী। শ্রীরামপুর তারকেশ্বর বাস চলাচলের পথে, সিঙ্গুরের প্রসিদ্ধ এই ডাকাত কালী মায়ের মন্দিরের অবস্থান। স্থানীয় মতে খুবই প্রাচীন এই কালীপুজো প্রায় চারশো বছরের।
প্রাচীন মন্দিরের আদল বদলে গেছে বারবার সংস্কার হয়ে। খুব সুন্দর দেখতে মন্দিরের বর্তমান আদল। মন্দিরের গর্ভগৃহের অধিষ্ঠাত্রী মৃন্ময়ী মূর্তির উচ্চতা প্রায় নয় ফুট। অধিকারী বংশের মানুষরা পুজোর দায়িত্ব পালন করে। দ্বিমত রয়েছে কালী প্রতিষ্ঠা নিয়ে। একটি মতে বলা হয়, এই কালীর প্রতিষ্ঠা করেন ডাকাত সর্দার রঘু। অন্য মতে প্রচারিত হয়েছে এ কালীর প্রতিষ্ঠা করেন গগন ডাকাত বা ডাকাত সর্দার বিশু।
ইতিহাসের সূত্রে জানা যায়, নীলচাষি, শাসকের অত্যাচার এবং পরবর্তী কালে নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে জন্ম হয় বিশু ডাকাতের। সময়কাল ছিল ১৮৫৯ থেকে ১৮৬০! জানা যায়, বহু নীলকর সাহেবদের খুন করে জ্বালিয়ে দিয়েছিল এই বিশু ডাকাত।
আরও জানা যায়, চালকেবাটির মোড়ল দেবীর স্বপ্নদিষ্ট হয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় জঙ্গলের মধ্যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মায়ের পুজোকে কেন্দ্র করে, ডাকাতরাও পেয়েছিল আশ্রয়। ডাকাতি করতে যাওয়া ও ফেরার পথে মায়ের পুজো দিত ডাকাতরা। সেই সঙ্গে হত নরবলি।

Latest article