কোথায় দাঁড়িয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক

পরিবর্তিত পরিস্থিতি। চিন্তার মাত্রা বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলে তবে দেশের সঞ্চয়ের ভিত মজবুত হবে, বাঁচবে বাণিজ্য ভারসাম্য। অথচ ভারতের তিন দিকে যে রাষ্ট্রগুলো আছে তাদের সাথে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের সম্পর্ক কিন্তু তলানিতে ঠেকেছে। এর থেকে বের হওয়ার উপায় কী? আলোচনা করছেন বারাসত কলেজের অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈদেশিক বাণিজ্য অর্থনীতির ভাগ্য নির্ধারণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে রফতানি বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতি যেমন চাঙ্গা হয় তেমনি কর্মসংস্থানের মুখ ও উন্মুক্ত হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম একটা দিক হল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা, যা দেশের সঞ্চয়ের ভিত মজবুত করে এবং বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষার উন্নতি করা বিদেশ নীতির এক ও অদ্বিতীয় লক্ষ্য। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলি যেমন আমাদের আশ্বস্ত করেছে তেমনি কিছু ঘটনাবলি আমাদের চিন্তারমাত্রাও বৃদ্ধি করেছে। বৈদেশিক বাণিজ্য কেবলমাত্র অর্থনীতির পায়া শক্ত করে তা নয়, জীবনযাত্রার মান উন্নত করতেও সহায়ক। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমেরিকার সাথে ভারতবর্ষের সম্পর্ক নিয়ে বেশ চর্চা হচ্ছে, সেই বৈদেশিক বাণিজ্যের বেশ কিছু সহায়ক তথ্য বলছে ২০২৪-এর এপ্রিলে ভারতবর্ষ মোট পণ্যদব্য রপ্তানি করেছিল ৩৫৩০৩.৬০ ইউএস মিলিয়ন ডলারের, কিন্তু ২০২৫ এর এপ্রিলে আশা করা যাচ্ছে তা বেড়ে হয়েছে ৩৮৪৮৭.৭৪ ইউএস মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ বৃদ্ধির পরিমাণ ৯.০২ শতাংশের মতো। অপরদিকে ২০২৪-এর এপ্রিলে ৫৪৪৮৮.০৫ মিলিয়ন ইউ এস ডলারের পন্য দব্য আমদানি করা হয়েছিল কিন্তু ২০২৫-এ আশা করা যাচ্ছে আমদানির পরিমাণ বেড়ে হবে ৬৪৯১২.১৬ মিলিয়ন ইউ এস ডলার, অর্থাৎ বৃদ্ধির হার প্রায় ১৯.১৩ শতাংশ। যা কিনা ৩৭.৭৪ শতাংশ ঋণাত্মক ভারসাম্যে চলছে। সারা বিশ্ব জুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্য দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি হল পণ্য দ্রব্য ও অন্যটি হল পরিষেবা। পরিষেবা ক্ষেত্র যদি দেখি ২০২৪-এর এপ্রিলে রফতানি মূল্য ছিল ৩০.১৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার তা ২০২৫-এর এপ্রিলে আশা করা যাচ্ছে ৩৫.৩১ বিলিয়ন ইউ এস ডলার হবে। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার প্রায় ১৭ শতাংশ। অপরদিকে আমদানি পরিষেবায় ২০২৪-এর এপ্রিলে যা ছিল ১৬.৭৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার তা ৪.৬৫ শতাংশের মতো পরিবর্তিত হয়ে হতে পারে ১৭.৫৪ বিলিয়ন ইউ এস ডলারের মতো। অর্থাৎ পরিষেবা ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ কিন্তু কিছুটা হলেও উন্নতি করেছে। এবার প্রশ্ন ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের আবহে হঠাৎ করে তৃতীয় দেশ হিসেবে আমেরিকা কেন যুদ্ধ-বিরোধী ঘোষণা করল, তারও কিন্তু কারণ এই ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ ধরেই পাওয়া যাবে। পরিসংখ্যান বলছে ২০২০ সালে আমেরিকায় রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৯.২২ বিলিয়ন ইউ এস ডলার, তা ২০২১ এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১.৪১ বিলিয়ন ইউ এস ডলার অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ৪৫.০৮ শতাংশ। তেমনভাবেই ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪-এ আমেরিকায় রফতানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৮০.৩২, ৭৫.৮০ ও ৮০.৭৯ বিলিয়ন ইউ. এস. ডলার, অর্থাৎ ২০২১ থেকে ২০২২-এ বেড়েছে ১২.৪৮ শতাংশ, ২০২২ থেকে ২০২৩-এ সামান্য কমেছে যা ৫.৬৩ শতাংশ আর ২০২৩ থেকে ২০২৪ বেড়েছে ৬.৫৮ শতাংশ। এছাড়া ২০২০ থেকে ২০২৪, এই পাঁচ বছরে আমেরিকার বাজারে ভারতের অংশীদারিত্বের পরিমাণ ২.০৫, ২.৪৩, ২.৩৮, ২.৩৯ ও ২.৪০ শতাংশ যথাক্রমে। ভারতবর্ষ যে পাঁচটি দেশের সাথে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা বাণিজ্য করে তারা হল আমেরিকা, ইউনাইটেড আরব এমিরেটস, নেদারল্যান্ড, ইউনাইটেড কিংডম ও চিন এবং তাদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ যথাক্রমে ১৮.৯২ শতাংশ, ৮.০৭ শতাংশ, ৬.১৪ শতাংশ, ৩.৪৩ শতাংশ ও ৩.২৮ শতাংশ যথাক্রমে। অর্থাৎ কেন আমেরিকা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে তা কিছুটা হলেও আমাদের কাছে স্পষ্ট। তবে কোনও দেশ যদি কোনও দেশের ওপর অতি-নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে তা দরকষাকষির পর্যায়ে চলে যায়। ভারতবর্ষের সাথে আমেরিকার ব্যবসায়িক অবস্থানটা ঠিক এখন সেই দরকষাকষির পর্যায়ে চলে গেছে। যার ফলে আমেরিকা বাইরের দেশ হয়েও কিছুটা ভারতবর্ষের সিদ্ধান্ত গ্রহণে হস্তক্ষেপ করছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সাথে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণটা ০.০৬ শতাংশ। যা কোনওভাবেই ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে আঘাত করার মতন অবস্থায় নেই, অর্থাৎ পাকিস্তানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলেও ভারতের কোনও ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ভারতবর্ষের ওপর পাকিস্তান কিন্তু অনেকাংশে নির্ভরশীল। যেমন চিনি, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, রাবার ইত্যাদির জন্য পাকিস্তান কিন্তু ভারতের ওপর নির্ভর করে আছে, সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর যে আঘাত আসবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এছাড়া সিন্ধু জল চুক্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে পাকিস্তানের কৃষিকাজ যে প্রবল ক্ষতির মুখে পড়বে সে-বিষয়টাও কিন্তু পরিষ্কার। বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈদেশিক নীতি সময় সময়ে পরিবর্তিত হচ্ছে। উন্নত বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি দেশের অভ্যন্তরে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিতেও সহায়ক। যার ফলে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা গড়ে ওঠে এবং পণ্য ও পরিষেবার মান উন্নত হয়। দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্রমাগত তাদের ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করছে। সেইখানে কার কী রকম ব্যবসায়িক বন্ধু হবে তাও ঠিক হবে আমদানি ও রফতানির ওপর নির্ভর করে, অর্থাৎ ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ কাদের বন্ধু ভাববে আর কাদের শত্রু ভাববে তা বৈদেশিক নীতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে। তৃণমূল কংগ্রেসের মতো শক্তিশালী দল ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে, বিশেষ করে যেখানে ভারতবর্ষের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে সেই পদক্ষেপে ভারত সরকারের পাশে থাকবে তা কিন্তু নিশ্চিত করেছে। ভারতের তিন দিকে যে রাষ্ট্রগুলো আছে তাদের সাথে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের সম্পর্ক কিন্তু তলানিতে ঠেকেছে, সীমান্ত সুরক্ষায় এটা কিন্তু বেশ চিন্তার বিষয়। এছাড়াও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে তুরস্কের মতন দেশ, যাদের ভারতবর্ষ আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তারা কিন্তু সাম্প্রতিক যুদ্ধে পাকিস্তানের মতো সন্ত্রাসবাদীর দেশকে সাহায্য করেছে। এই ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের পররাষ্ট্র নীতি কিন্তু হোঁচট খেয়েছে। আগামীদিনে এই সকল ভুলভ্রান্তি দূর করে বিদেশ নীতি আরও কতটা উন্নত হয় সে বিষয়ে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
(তথ্যসূত্র : বাণিজ্য ওশিল্প মন্ত্রণালয়, ভারত সরকার)

আরও পড়ুন-ইউপিএসসি: বাজিমাত রাজ্য সরকারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পড়ুয়াদের

Latest article