২০১৮ সালের মার্চ মাসের ১৪ তারিখে ছিয়াত্তর বছর বয়সি স্টিফেন হকিং প্রয়াত হলেন। মাত্র বাইশ বছর বয়সে যাঁর অসুস্থতা দেখে ডাক্তার বলেছিলেন আর বড়জোর বছর দুয়েক বাঁচতে পারেন, সেই মানুষটিই আরও চুয়ান্ন বছর বেঁচেই রইলেন শুধু নয়, মহাকাশবিজ্ঞানের কিছু বিষয় নিয়ে এমন সব কাজ করে গেলেন, যা ওইরকম শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে যে কেউ কখনও করে উঠতে পারবেন, তা মনে হয় না। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ দশজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নামের তালিকা বানালে তাতে তাঁর নাম যে থাকবেই, এ একেবারে নিশ্চিত করেই বলা যায়।
হ্যাঁ, সেই স্টিফেন হকিং শায়িত আছেন এখানে। এ-জায়গার নাম ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে। তাঁর নশ্বর দেহকে দাহ করবার পর সেই ছাই নিয়ে সমাধি দেওয়া হয় এখানে। আর যে-জায়গায় এই সমাধি, সেটা দু-জন বিরাট মাপের বিজ্ঞানীর একেবারে মাঝখানে, তাঁদের একজন আইজ্যাক নিউটন, অন্যজন চার্লস ডারউইন। তাঁর সমাধি-ফলকের ওপর খোদিত হয় এই কথাটি— ‘Here lies what was mortal of Stephen Hawking’— এখানে শায়িত রয়েছেন স্টিফেন হকিং-এর পার্থিব। সেই সঙ্গে রয়েছে একটি সমীকরণ। বেকেনস্টাইন-হকিং সমীকরণ নামে যার পরিচিতি। মৃত্যুর প্রায় পনেরো বছর আগে তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর ইচ্ছে, যেন এই সমীকরণটিই তাঁর এপিটাফ হিসেবে খোদিত হয়।
আরও পড়ুন-বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠক
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে-র কথা
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে ব্রিটেনের অনেককাল আগের পুরনো চার্চগুলোর মধ্যে একটি। টেমস নদীর তীরে বিরাট চত্বর জুড়ে বিস্তৃত এই জায়গাটা প্রায় ন-শো বছরের পুরনো। এখন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে খ্যাত এই চার্চ-চত্বরে কয়েক শতক আগে থেকেই সে-দেশের রাজপরিবারের নানা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। যেমন রাজা প্রথম হেনরি-র সঙ্গে স্কটল্যান্ডের মাটিল্ডার বিয়ে হয়েছিল এগারোশো সালে এবং একেবারে সম্প্রতি ২০১১ সালে এখানেই বিয়ে হয় প্রিন্স উইলিয়াম আর ক্যাথেরিন মিডলটন-এর।
এছাড়াও এই অ্যাবে-র সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ অবশ্যই এখানে শায়িত থাকা বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সমাধিগুলো এবং আরও বহু ব্যক্তির মূর্তি আর স্মৃতিসৌধ। এখানে শায়িত আছেন যাঁরা, তাঁদের নামের তালিকা বলতে শুরু করলে শেষ হবে না সহজে। আছেন তেরোজন রাজা, চারজন রানি এবং বেশ কয়েকজন রাজপরিবারের সদস্য। আর শুধু কবিদের জন্য আলাদা যে বিভাগটি, সেখানে আছেন জিওফ্রে চশার (১৪০০ সালে কবি হিসেবে তাঁকেই প্রথম প্রোথিত করা হয়েছিল), রবার্ট ব্রাউনিং, এডমন্ড স্পেনসার, জন ড্রাইডেন, রাডিয়ার্ড কিপলিং; সেখানেই আবার উপন্যাস-লেখক হয়েও আছেন চার্লস ডিকেনস। আবার কবি লর্ড বায়রন-কে এখানে সমাধিস্থ করতে দেওয়া হয়নি তাঁর বিতর্কিত জীবন-যাপনের জন্য। পরে অবশ্য তাঁর নামে একটি স্মৃতিফলক এখানে প্রোথিত হয়েছে। এছাড়াও এখানে আছে বহু অখ্যাত যুদ্ধ-শহিদদের সমাধি। আবার এখানে এমন অনেকের স্মৃতি-ফলক বা অনেকের নামে খোদাই করা সৌধ রয়েছে, যাঁদের সমাধিস্থ করা হয়েছে অন্যত্র। সে-নামের তালিকাও শেষ হওয়ার নয়। অনেকের সমাধি আবার কখনও এখান থেকে তুলে নিয়ে অন্যত্র প্রোথিত করা হয়েছে, যেমন সেই বিখ্যাত শাসক অলিভার ক্রমওয়েল। তাঁর দেহাবশেষ সমাধি খুঁড়ে তুলে নিয়ে গিয়ে আবার ফাঁসিতে চড়ানো হয়, আরও পরে পুঁতে দেওয়া হয় অজ্ঞাত এক জায়গায়।
অ্যাবে-র উত্তর-পূর্ব দিকে বিজ্ঞানীদের জন্য নির্ধারিত এলাকায় আছে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর সমাধি এবং আরও অনেকের স্মৃতি-সৌধ। এই এলাকাকে অনেকে মজা করে বলেন কেমব্রিজ কর্নার, কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রায় তিনশো বছর ধরে হয়ে উঠেছিল গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত জায়গা যেখান থেকে বিজ্ঞানের প্রায় সব বড়-বড় আবিষ্কারগুলো একের পর এক উঠে আসত। আইজ্যাক নিউটন বা আর্নেস্ট রাদারফোর্ড থেকে শুরু করে জোসেফ জন থমসন বা লর্ড কেলভিন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, পল ডিরাক, জ্যোতির্বিদ জন হারশেল বা হালের স্টিফেন হকিং— এঁরা প্রত্যেকেই কেমব্রিজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কোনও না কোনও সময়।
নিউটনের সমাধি
নিউটন প্রয়াত হয়েছিলেন ১৭২৭ সালে, চুরাশি বছর বয়সে। অবিবাহিত এই মানুষটি প্রায় গোটা জীবনই কাটিয়েছিলেন বিজ্ঞানের সঙ্গে ঘর করেই। সাম্প্রতিককালে তাঁকে সমকামী বলে প্রমাণ করবার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কোনও কোনও মহল থেকে, সে-ব্যাপারটা বাদ দিলে এটা নিশ্চিত যে নিউটন যখন প্রয়াত হন, তাঁর নিকট-আত্মীয় বলতে ছিলেন তাঁর এক ভাগনি ক্যাথরিন বার্টন আর তাঁর স্বামী জন কনডুইট।
জীবনের শেষ প্রায় তিনটে দশক তিনি কাটিয়েছিলেন লন্ডনে, এবং বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি অন্য আরও নানা বিষয়ে মাথা ঘামাতেন, যার মধ্যে আছে অ্যালকেমি বা ধর্মতত্ত্বও। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী, যাঁর ঠাঁই হয়েছিল এই অ্যাবে-র সমাধিস্থলে। তাঁর সমাধির ওপর ল্যাটিনে লিখে দেওয়া হয় ‘Hic depositum est, quod mortale fuit Isaaci Newtoni’, যেটাকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায় হকিং-এর সমাধির ওপর লিখে দেওয়া কথাটাই, নামটা স্রেফ বদলে দিলে যা হয়।
বছর তিনেক পরে এই সমাধির কাছেই সাদা আর ধূসর মার্বেল পাথরে গড়ে তোলা হয় দারুণ একটি স্মৃতিসৌধ। নিউটন সেখানে ভর দিয়ে আছেন কয়েকটি বইয়ের ওপর, সেগুলোর তাঁরই লেখা। তাঁর অন্য হাতের কাছে দুটি ডানাওয়ালা বালক। পেছনে একটি পিরামিড, তার সামনে দৃশ্যমান গোলাকার পৃথিবী। সেই পৃথিবীর ওপর আবার বসে আছেন গ্রিক দেবতা ইউরেনিয়া, যিনি জ্যোতির্বিদ্যার দেবী।
নিউটন আর ডারউইনের মাঝে এখন হকিং সাহেবের নিরাভরণ সমাধিফলক। নিউটন যেমন একদিকে ধর্মভীরু, অন্যদিকে ডারউইন একেবারেই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না, যে-কারণে তাঁকে প্রথম দিকে এখানে সমাধিস্থ করতে অনুমতিই দেওয়া হচ্ছিল না। স্টিফেন হকিং-ও গোটা জীবন ঈশ্বরে অনাস্থা দেখিয়েছিলেন।
তাঁর প্রিয় বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের মতোই কেমব্রিজের লুকাশিয়ান অধ্যাপক পদে বসবার সুযোগ পেয়েছিলেন স্টিফেন হকিং। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছিলেন যে বিরাট একটা হলঘরের এক প্রান্তে হুইলচেয়ারে বসে থাকা তাঁর সামনে যখন সেই জাবদা খাতাটি আনা হয় তাতে তাঁর সই করানোর জন্য, সেই খাতার একটু আগের পাতাতেই ছিল স্বয়ং নিউটনের সই। সেদিন কি সই করতে তাঁর হাত কেঁপেছিল? মনে হয় না।