হিন্দু জোট, আরও হিন্দু চাই, হিন্দুরা সব গেল কোথায় ভাই

নিছক একটা উপনির্বাচন। তবু তার ফলাফল নিয়ে এত আগ্রহ ছিল বাংলার রাজনৈতিক মহলে! রাম-বাম-কং সবাই জানত তাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে না। তবু আগ্রহ ছিল সব্বার। সেই উপনির্বাচনের ফল কীসের ইঙ্গিতবাহী হয়ে দেখা দিল বাংলার রাজনৈতিক আকাশে? লিখছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

কালীগঞ্জের উপনির্বাচন। তার ফলাফলে রাজ্য বিধানসভায় পালা বদলের কোনও সম্ভাবনা ছিল না। গুরুত্বের বিচারে তাই উপেক্ষণীয়।
কিন্তু উপনির্বাচনের উপেক্ষণীয় ফলাফলটাকেই অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। গদ্দার কুলের পোদ্দার এই ব্যক্তিটির সৌজন্যে কালীগঞ্জের মহিমা আজ বিশেষভাবে আলোচনা যোগ্য হয়ে উঠেছে।
সংক্ষেপে কালীগঞ্জের উপনির্বাচনের ফলাফল এরকম। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ৫০,০৪৯ ভোটে জয়ী হয়েছেন। ২০২১-এ এই বিধানসভা থেকে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের নাসিরুদ্দিন (লাল) আহমেদ। তিনি জিতেছিলেন ৪৬,৯৮৭ ভোটে। সে দিক থেকে তুলনা করলে চার বছর পর পিতার জয়ের ব্যবধানকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন কন্যা।
এতে চমকের কিছু নেই। থাকার কথাও ছিল না। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেদিক থেকে এই ফলাফল প্রত্যাশিত।
তদুপরি, পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনে শাসকপক্ষের জয়ের একটা ট্রাডিশন আছে। সেই দিক থেকেও এই ফলাফলে অস্বাভাবিকত্ব কিছু নেই।
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল।
বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী এই নির্বাচনে পেয়েছেন ২৮,৩৪৮টি ভোট। শতাংশের বিচারে ১৫.২১ শতাংশ ভোট। গত বিধানসভা নির্বাচনে কংরেড প্রার্থী আবুল কাশেম-এর চেয়ে কম ভোট পেয়েছিলেন। তিনি পান ২৫,০৭৬টি ভোট। তৃতীয় স্থানাধিকারীর প্রাপ্ত ভোট নিয়ে কেউ মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করে না। তাই কংরেড প্রার্থীর ভোটের বাড়া-কমা কারও আলোচ্য বিষয় নয়। হওয়ার কথাও ছিল না।
এটাও ঠিকই আছে। কোনও চমক নেই। অসীম স্বাভাবিকত্বে শূন্যত্বের অধিকারীরা ফের সাইনবোর্ড থেকে দেশলাই বাক্স, সেখান থেকে বারুদ নয়, আগুন নয়, নিঃসীম অন্ধকারে।
গ্রিক পুরাণে একেই নেমেসিস বলে। সাঁইবাড়িতে যারা যাদের ছেলেকে মেরে মাকে রক্ত মাখা ভাত খাইয়েছিল, আজ যদি তারাই সেই হত্যাকারীর হাত ধরে ভোট ভিক্ষা করে, তবে এই ফলই প্রার্থিত, প্রত্যাশিত এবং অনিবার্যভাবে উপলব্ধ। ১৯৯১-তে হাওড়া জেলার কেন্দুয়াতে যারা যাদের ভোট দেওয়ার অপরাধে গোপাল পাত্র-সহ সাতজন গ্রামবাসীর হাতের কবজি কেটে নিয়েছিল, ২০২৫-এ মালদহে তারাই যদি ‘হাত’ প্রতীকে হামলাকারী কাস্তেকে পাশে নিয়ে ভোট ভিক্ষে করে, তবে এই ফল প্রার্থিত, প্রত্যাশিত এবং অবশেষে উপলব্ধ। এতেও কোনও চমক নেই। সেদিনের আক্রান্ত ও আক্রমণকারী গলাজড়াজড়ি করকে শূন্য থেকে ঋণাত্মক হওয়ার দিকে ক্রমঅগ্রসারমান।
এ-পর্যন্ত বেঠিক কিছু নেই।
কিন্তু হিসেবের গোলমাল হচ্ছে অন্যখানে।
কালীগঞ্জের উপনির্বাচনে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করতে চেষ্টার অন্ত ছিল না বিজেপির। বিশেষ করে বিরোধী দল নেতা লোডশেডিং অধিকারীর। গলা উঁচিয়ে বুক বাজিয়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হোন। ৭০ শতাংশ হিন্দু একজোট হলেই বিজেপির জয় নিশ্চিত। বঙ্গের বুকে ইতিপূর্বে এমন বেহায়ার মতো হিন্দুভোটের জন্য আকচা-আকচি বোধ করি সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও করেননি, যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে ধর্মীয় আবেদনে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট ভিক্ষায় বিরক্ত সুভাষচন্দ্র সাফ বলেছিলেন, ‘হিন্দু মহাসভা যদি বাংলা রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে মাথাচাড়া দিতে চায়, তবে সেটা জন্মের আগেই গুঁড়িয়ে দিতে বাধ্য হব, যদি বলপ্রয়োগ করতে হয়, তা হলে সেটাই করব।’ সুভাষ নিজে শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করে একথা বলেছিলেন এবং শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ডায়েরিতে সেকথা লিখে গেছেন।
এ হল সেই হিন্দুত্ববাদী শ্যামাপ্রসাদ যিনি ২৬ জুলাই ১৯৪২-এ বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন আর্থার হারবার্টকে টিঠিতে লিখেছিলেন, ‘কংগ্রেস খুব শীঘ্রই যে ব্যাপক আন্দোলনের ডাক দিতে চলেছে এই (দ্বিতীয় বিশ্ব) যুদ্ধের সময়, তা প্রতিরোধের জন্য সমস্তরকম ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিতে হবে। যে স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, তা আমরা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছি। (আর এজন্যই বোধহয় বিজেপি ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭-এর আগেই বঙ্গবিভাজনের দিবসকে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসেবে পালনে এত আগ্রহী!) যুদ্ধের জন্য হয়তো তা একটু সীমাবদ্ধ, কিন্তু জন সাধারণের ভোটেই তো আমরা মন্ত্রী হয়েছি। আমরা মন্ত্রীরা মানুষকে বোঝাব যে ব্রিটেনের স্বার্থে নয়, ভারতের জনসাধারণের স্বার্থেই আমাদের ‘‘ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের বিরোধিতা করতে হবে।’
এই শ্যামাপ্রসাদের উত্তরাধিকার আজকের বিজেপি এবং বঙ্গে তার অগ্রণী নেতা ‘মোদিপুত্র’ শুভেন্দু অধিকারী। তিনিই শ্যামাপ্রসাদী ঘরানায় হিন্দু ভোট এক করার ডাক দিয়েছিলেন কালীগঞ্জে। তিনিই মুসলমান বিদ্বেষের নোংরামিকে অত্যুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন প্রাক-কালীগঞ্জ উপনির্বাচন পর্বে।
এবং তার ফলটা কী হয়েছে? বিষবৃক্ষ কি বিষফল দিয়েছে?
এক কথায় উত্তর, না, দেয়নি। বরং প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপির হিন্দুত্বের তাস কি গদ্দার কুলের পোদ্দারের সৌজন্যে, অবলাকান্ত হাফ প্যান্ট মন্ত্রীর অতি প্রয়োগের সুবাদে অকেজো হয়ে গেল? রাজ্যের বিরোধী দলনেতা ও কেন্দ্রের হাফ প্যান্ট মন্ত্রীর কারণে বিজেপির হিন্দুত্বের তাস অশ্বডিম্ব প্রসব করতে শুরু করল? অন্তত এই রাজ্যে?
কারণটা খুব স্পষ্ট। গেরুয়া পোশাক পরিহিত বাহ্যত সাধুদের দিয়ে প্রচার করিয়েও বিজেপি ভোটে কোনও ফায়দা তুলতে পারছে না তারা। উপনির্বাচনের ফলেই তা স্পষ্ট।
ফলাফল বলছে তিন শতাংশ ভোট কমেছে বিজেপির।
ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, কালীগঞ্জ, মাটিয়ারি, গোবরার মতো হিন্দু অধ্যুষিত একাধিক পঞ্চায়েত এলাকায় বিজেপি পিছিয়ে পড়েছে।
উদাহরণস্বরূপ কালীগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের কথা বলা যেতে পারে।
ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে ৭০ শতাংশ ভোটার হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সময়েও এই পঞ্চায়েতে বিজেপি লিড পেয়েছিল। কিন্তু এবারের উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৮৬৩৩টি ভোট পেয়েছে। বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৬৫৪৮। পার্থক্য, ২০৮৫টি ভোটের। অথচ একবছর আগেও এখানে বিজেপি ৪০৭ ভোটে এগিয়েছিল।
বলা যেতে পারে গোবরা গ্রাম পঞ্চায়েতের কথাও।
বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। হিন্দুপ্রধান পঞ্চায়েত। ৮৫ শতাংশ ভোটার ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এখান থেকে পদ্মপ্রার্থীর লিড ছিল ১৪০৫ ভোটের। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তা কমে হয় ৯৮৫ ভোটের। গত বছরই সেই লিড বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১,০৮৯ ভোটের। এবারের উপনির্বাচনে সেসব ধুয়ে-মুছে সাফ। লিড পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ওখানে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট বেড়ে এবার ৬৭৬৯।
সব মিলিয়ে যা দাঁড়াল, তা এরকম।
বিজেপি সব ধর্মের মানুষের কাছেই প্রত্যাখ্যাত।
ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তো তাদের আগেই তাদের থেকে মুখ ফিরিয়েছে।
সুতরাং, ২০২৬-এ কী হবে, তা এখনই আভাসিত।
আর সেখানেই কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের ফলাফলের গুরুত্ব।

আরও পড়ুন: প্রথম ভারতীয় নভশ্চর হিসেবে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে শুভাংশু, শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

Latest article