কয়েকদিন আগে ‘জাগো বাংলা’ দৈনিকে হুমকি-সংস্কৃতি সংক্রান্ত প্রবন্ধে আমি বামফ্রন্ট আমলে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এস এফ আইয়ের অত্যাচারের প্রসঙ্গ এনেছিলাম এবং মন্তব্য করেছিলাম, বামফ্রন্ট আমলে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হত না। এই বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কিছু কথা, কিছু তথ্য উল্লেখ করছি।
আরও পড়ুন-মুড়িগঙ্গায় বিরল নীল তিমি, আগলে রেখে সাগরে ফেরাল বন দফতর
অবসরের আগে ৩৮ বছরের অধ্যাপনা জীবনে প্রথম ৫ বছর বিদ্যাসাগর কলেজ এবং যোগমায়া দেবী কলেজ ও পরবর্তীকালে ৩৩ বছর সরকারি কলেজে কাজ করেছি। ১৯৭৭-এ যখন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল, তখন অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পরিষদের হাতেই ছাত্র সংসদ ছিল। ১৯৮০/১৯৮১ সাল পর্যন্ত এই অবস্থা মোটামুটি অপরিবর্তিত ছিল। আমি সরকারি কলেজে এলাম কংগ্রেস শাসনের শেষ দিকে। প্রথম পোস্টিং ছিল কলকাতার মৌলানা আজাদ কলেজে। সেই সময় ছাত্র পরিষদ কলেজের ছাত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৮০ সালেও ছাত্র পরিষদ ক্ষমতাসীন ছিল। ১৯৮২-এর বিধানসভা নির্বাচনের পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করে। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি যখন চন্দননগর সরকারি কলেজে বদলি হলাম, সেখানে ছাত্র সংসদ ছাত্র পরিষদের হাতে ছিল। ১৯৮৬ বা ১৯৮৭-র ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক গোলমাল হল। ছাত্র পরিষদের প্রার্থীরা মনোয়নপত্র জমা দিতে পারল না। তাদের কলেজে ঢুকতেই দেওয়া হল না। কলেজের মূল দরজা সিপিএমের পতকা হাতে কিছু গুণ্ডা শ্রেণির লোক গেট আটকে দাঁড়িয়ে ছিল। ছাত্র পরিষদের ছেলেদের রাস্তায় মারধর করা হল। আমি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অনুরোধ করতাম, থানায় ফোন করতে। থানা কলেজ থেকে হেঁটে ২ মিনিটের রাস্তা। মহকুমা শাসকের কার্যালয়ের দূরত্ব বড়জোর ৩ মিনিট। সিপিএমের তল্পিবাহক অধ্যক্ষ থানায় ফোন করতে রাজি হলেন না। আমি জোর করে ফোনটা তুলে থানায় ফোন করলাম। থানার আধিকারিক নিরাসক্ত কণ্ঠে বললেন— দেখছি! তখন একজন অধ্যাপককে সঙ্গে নিয়ে মহকুমা শাসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। মহকুমা শাসক তাঁর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন কি তিনি ভয়ে কাঁপছেন! বুঝলাম, বামফ্রন্ট শাসনে আমলাতন্ত্র তার মেরুদণ্ড হারাচ্ছে। পরবর্তীকালে ওই মহকুমা শাসক রাজ্যের মুখ্যসচিব হয়েছিলেন! যাই হোক, ছাত্র পরিষদের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিতে ব্যর্থ হল। এসএফআই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হল।
১৯৮৮ সালে দুর্গাপুর সরকারি কলেজে বদলি হলাম। ১৯৮৯-তে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুর্গাপুর শহরে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন বামফ্রন্ট ক্ষমতার শিখরে, অত্যাচারের শিখরে। ছাত্র পরিষদের ছেলে-মেয়েরা মনোনয়ন জমা দিয়েছিল। মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগের দিন সিপিএমের স্থানীয় কমিটির লোকেরা ছাত্র পরিষদের প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন, মনোনয়ন প্রত্যাহার না করলে তাঁদের এবং পুরো পরিবারকে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। চেষ্টা হয়েছিল, যাতে মনোনয়ন প্রত্যাহার না করা হয়। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা সজল চোখে বলেছিলেন, সিপিএম এক হিংস্র দল। কথা না শুনলে ঘর-বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে পারে, এমনকী মেয়েদের উপরও অত্যাচার হতে পারে, প্রার্থীরা মনোয়ন প্রত্যাহার করার ফলে এসএফআই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই জিতে গেল।
আরও পড়ুন-২৫০-র বেশি আসন নিয়ে ২৬-এ ফের মুখ্যমন্ত্রী
১৯৯৩-এ দ্বিতীয়বারের জন্য মৌলানা আজাদ কলেজে ফিরে এলাম। ১৯৯৪ সালে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ৩০ আসনের মধ্যে ছাত্র পরিষদ ১৫ এবং এসএফআই ১৪টি আসন পেল। একটি আসনে উভয়েই সমান সংখ্যক ভোট পেল। মাত্র একটি ব্যালটের বৈধতা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হল। ব্যালটটিতে ছাত্র পরিষদের পক্ষে ভোট দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনার হিসাবে ব্যালটটি পরীক্ষা করে বৈধ ঘোষণা করলাম। উপস্থিত অধ্যাপকেরা আমার বক্তব্যকে সমর্থন করলেন। ফলে ছাত্র পরিষদ ১৬, এসএফআই ১৪। সঙ্গে সঙ্গে এসএফআই কলেজে গোলমাল শুরু করল। ক্লাসের চেয়ার, বেঞ্চ, অফিস— সমস্ত ভাঙচুর করা হল। কলেজের বাইরে সিপিএমের পতাকা হাতে বহু লোক হাজির হলেন। বাস-ট্রাম বন্ধ হয়ে গেল। শুনলাম, বিমান বসু কলেজের গেটে এসেছিলেন। বিমানবাবু মৌলানা আজাদ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। কয়েকদিন পর যেদিন সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ প্রভৃতির নির্বাচন ছিল, সেই দিন ছাত্র পরিষদের ১৬ জন নির্বাচিত প্রতিনিধিই অনুপস্থিত ছিল। ফলে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও এসএফআই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্র সংসদ দখল করেছিল। পরে খবর পাওয়া গেল, রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে সিপিএম ছাত্র পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখিয়েছিল, একই হুমকি-সংস্কৃতি। তারপর থেকে ২০১০ পর্যন্ত মৌলানা আজাদ কলেজে এসএফআই ছাড়া অন্য কোনও ছাত্র সংগঠন মনোনয়ন পত্র জমা দিতে পারেনি।
আরও পড়ুন-বীরভূমের দেউচা-পাঁচামি নিয়ে বৈঠক করলেন মুখ্যসচিব ও ডিজি
এই তিনটি তথ্য দিলাম। এসএফআইয়ের তাণ্ডব ও হুমকি-সংস্কৃতি এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিক্যাল কলেজে ঘটেছে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। বহুলাংশে দক্ষিণ কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজে এবং গােয়েঙ্কা কলেজে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে দেবাশিস পাঠক গােয়েঙ্কা কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁকেও হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগের রাত প্রায় ১২টার সময় সুভাষ চক্রবর্তী- আশ্রিত সিপিএমের এক হার্মাদ দেবাশিসবাবুর বাড়িতে ঢুকে তাঁর বাবাকে হুমকি দেয়, মনোনয়ন প্রত্যাহার না করলে অবস্থা খুব খারাপ হবে। কিন্তু দেবাশিস প্রার্থিপদ প্রত্যাহার করেননি এবং নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন।
হুমকি-সংস্কৃতি নিয়ে লম্বা-চওড়া ভাষণ দেওয়ার আগে সিপিএম নেতারা আয়নায় নিজেদের মুখ দেখুন। অবশ্য সিপিএমের লজ্জা-শরম, অনুতাপ বলে কিছু আছে কি?