ওদের পায়ের নিচে এবড়োখেবড়ো মাটি আর খাঁড়ির জল। ওদের চারিপাশে ভয়াল জঙ্গল। ওদের জীবন আটকে রয়েছে সুন্দরবনের জলা-বাঘ-বিষাক্ত প্রাণী অধ্যুষিত অনিশ্চিত এক শ্বাপদসঙ্কুল পরিবেশে। মাথা ঠেকানোর মতো আশ্রয় বলতে আছেন এক আরণ্যক বনবিবি ও তাঁর সঙ্গী শা জঙ্গলি। উল্টোদিকে আছেন অরণ্যের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক বাঘের দেবতা দক্ষিণরায়। এই বনাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি ঘরেই কোনও না কোনও পুরুষ বাঘের আক্রমণে নিহত বা আহত। পৃথ্বীশ রাণা সম্পাদিত ও পরিচালিত, সুদীপ সিংহ রচিত ‘বাদাবন’ নাটকের স্থানাঙ্কে রয়েছে যে ঝড়খালি, তার অধিকাংশ বাসিন্দাই উদ্বাস্তু, তাদের ঠিকানা অনিশ্চিত, তারা পূর্ববঙ্গ থেকে ভিটে হারিয়ে দণ্ডকারণ্যের রুক্ষ, পাথুরে জমি পেরিয়ে একটুকরো স্বাধীন মাটি খুঁজেছিল মরিচঝাঁপিতে। সেখানেও রাষ্ট্রের বুলেট তাদের জীবন কেড়েছে, ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলেছে তাদের, উদ্ভিন্ন, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে জীবন। আজ এই ঝড়খালি ব্লকের কঠিন লড়াইয়ের দিনযাপনে লোকগুলোর আর কোনও স্বপ্ন অবশিষ্ট নেই। কোনও পিছুটান নেই। নেই কোনও স্থির ভবিষ্যৎ। অতএব স্বপ্নও উধাও। অথচ এই আপাত স্বপ্নহীন, খিদে পেটে চেপে ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা দারিদ্রের আখ্যান কেবল নেতিবাচক কিছু অসম্পূর্ণ জীবনের সমাহার মাত্র নয়। তাই কঠোর রিয়ালিটি ভেঙেচুরে এই নাটকে বারবার চলকে ওঠে ম্যাজিক রিয়ালিটি। সেই জাদুবাস্তবের আয়নায় ধরা পড়ে এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম, ব্যর্থতা, স্বপ্নভঙ্গের পরেও জীবনের খুদকুঁড়ো আঁকড়ে বেঁচে থাকার চলমান যুদ্ধ। চন্দ্রাতপের মতো তাদের এই পথচলায় যেমন জড়িয়ে থাকে বনবিবির মিথ ও পরম্পরা, তেমনই প্রকট হয়ে ওঠে তাদের পারস্পরিক নির্ভরতা, প্রতারণা, লোভ, কামনা, আক্রোশ ও প্রতিশোধপরায়ণতা। মঞ্চের উপর আলোর জাদু দেখিয়েছেন অভ্র দাশগুপ্ত আর মন্ত্রমুগ্ধের মতোই আমরা হারিয়ে গেছি বাদাবনের গোলকধাঁধায়। অন্ধকারে, লণ্ঠনের আলোয় তাসের জুয়ার অস্পষ্ট দৃশ্যে আরম্ভ হয় নাটক আর বাঘের গর্জনের হাড়হিম শব্দে দর্শক খুঁজে পায় এই আখ্যানে ঢোকার প্রবেশপথ।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
ঝড়খালির বাঘ-বিধবা
বনবিবির পুজোর আয়োজন করছে যমুনা। তার জোয়ান স্বামীকে বাঘে খেয়েছিল একদিন। ছেলে মন্টু তখন পেটে। আজ মন্টুর পেশা বনবিবির পালার অভিনয়ের দল চালানো, সঙ্গে উপরি কামাই হিসেবে সুন্দরবনের নেচার গাইডের কাজ। আর পাঁচটা লোকাল মানুষের চেয়ে মন্টু ঢের বেশি চালাকচতুর কিন্তু কলকাতার নাগরিক সংস্কৃতি ও মানুষজন সম্পর্কে তীব্র আক্রোশপরায়ণ। যমুনা যখন স্বামীর মৃত্যুবৃত্তান্ত বর্ণনা করার পর তার ছেলের বউ করবীকে বলে,‘‘কী জানিস, ওই জানোয়ারটার কথা উঠলেই আমার মাথায় যেন রক্ত চড়ে যায়। কোনও জ্ঞান থাকে না”, তখন স্বামী হারানোর বেদনার সঙ্গেই এক চলমান আতঙ্কের বিরুদ্ধে একটানা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জেদ ধরা পড়ে। এলাকার সমস্ত মেয়ে-বউ বাড়ির পুরুষ যতদিন জঙ্গলে থাকে ততদিন আলতা-সিঁদুর পরে না, আমিষ খায় না, বিধবার মতো কাটায়। কারণ, এই এলাকার মেয়েদের কাছে বাঘ এক জ্যান্ত প্রতীক, যেকোনও মুহূর্তে সে তাদের জীবনের সবটুকু আনন্দ কেড়ে নিতে পারে। বাঘ-বিধবা যমুনার সেই থেকেই অন্তিম আক্রোশ, “মনে হচ্ছিল জানোয়ারটাকে সামনে পেলে মাথায় এক কোপ বসাই।” এই ধিকিধিকি জ্বলতে-থাকা আক্রোশ নাটকের অন্তিমে পৌঁছে নিয়তির মতো সত্যি হয়ে উঠবে একসময়।
আরও পড়ুন-রাজ্যপাল কি সরকারের বাইরে? বোসের আলটপকা মন্তব্য, ধুইয়ে দিলেন ব্রাত্য বসু
ছেলে মন্টুর ওপরচালাকি, চালিয়াতিকে ভয় পায় যমুনা। কিছুটা যেন সন্দেহই করে, কারণ, সুন্দরবনের সোঁদা ঘ্রাণের পরতটুকু পেলেও মন্টুর মধ্যেও অজান্তে জেগে উঠেছে নাগরিক লোভ। টাকার লোভ। যা ঝড়খালির বাঘ-বিধবা যমুনার চোখে অচেনা ও অনুচিত। বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ ১৯৭৯ সালে যখন মরিচঝাঁপি খালি করার জন্য চারদিক ঘিরে ফেলে গুলি চালায়, বড় ছেলে ঝন্টুর রক্তাক্ত দেহটা তার হাতের উপরেই ঢলে পড়েছিল। যমুনার প্রতিস্পর্ধা তাই বাঘ, নাগরিক লোভ ও ক্ষমতার আস্ফালন সবকিছুর বিরুদ্ধেই। নাটকের শেষে বনবিবির পালায় বাঘ-রূপী মন্টুকে চিনতে না পেরে তার মাথাতেই দা-এর কোপ বসিয়ে ছেলেকে হত্যা করে যমুনা। তার এতদিনের জিঘাংসার এক করুণ পরিণতির অংশ হয়ে পড়ে সে।
আরও পড়ুন-আজ রাত পোহালেই মকরস্নান, নয়া রেকর্ড
ম্যাসাকারের দিনরাত্রি
মাস্টারকাকা যখন মরিচঝাঁপির রক্তাক্ত ইতিহাস বলে ডকুমেন্টারি বানাতে আসা শহুরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে-পড়া কৌশিককে, তখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভিক্টিম সবহারানো উচ্ছেদ-হওয়া মানুষ আর সরকারি বাম-ভাষ্যের শেখানো বুলি আউড়ে যাওয়া কৌশিকের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতের বৈপরীত্য প্রকট হয়ে ওঠে। সরকারের সাহায্য ছাড়াই কিছু ছিন্নমূল নীচু জাতের নীচু নমঃশূদ্র মানুষ নিজেদের মতো জীবন গড়ে নিতে চাইছে, এরা নিশ্চিত পার্টির আনুগত্য মানবে না। তাই কমরেডরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল গ্রামকে গ্রাম, গুলি করে মেরেছিল মানুষকে। যে দৃশ্যে কানাই বাউরি, প্রভঞ্জন হালদার, কৃপাসিন্ধু মণ্ডল, নরেন মিস্ত্রিরা নিজেদের বাঘের হাতে-পড়ার গল্প বলে, সেখানেই বাঘের মুখোশ-পরা গৌতম এসে বসে। মন্টু বলে ওঠে, “বাঘের মুখে— মানুষের গল্প শুনতে বেশ লাগবে”। গোটা নাটকে বাঘের মানুষীকরণ আর মানুষের বাঘ-হয়ে-ওঠার এই স্থানবদলের দুরন্ত খেলাটিকে পৃথ্বীশ অসামান্য মুন্সিয়ানায় ব্যবহার করেছেন একাধিকবার। মাস্টারকাকার উক্তি, “আমরা যা করেছি বাঁচার জন্য করেছি কৌশিক। আপনি মরিচঝাঁপির মধ্যে রাজনীতি খুঁজে পাচ্ছেন। আর আমরা খুঁজেছি দেশ। আমরা উদ্বাস্তুরা আসলে উদ্বৃত্ত, ফালতু। তাই আমাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। আর বর্তমানটা শুধু ফুটবলের মতো নেতা-মন্ত্রীদের পায়ে-পায়ে ঘুরে বেড়ায়… মরিচঝাঁপির ঘটনার পর বাঘের দোহাই দিয়ে জঙ্গল থেকে নৃশংসভাবে উদ্বাস্তুদের তাড়ানোর পর এখানকার মানুষ এক অদ্ভুত ধারণার শিকার হয়। তারা ভাবে, প্রশাসন অর্থাৎ সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ তাদের থেকে বাঘকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আর নিজেদের গুরুত্ব বুঝতে পেরে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা বাঘ এরপরই সুন্দরবনের মানুষকে দুর্বল এবং নিজেদের খাদ্য ভাবতে শুরু করে। বাঘ সুন্দরবনের মানুষের কাছে ভদ্রলোকের রিপ্রেজেন্টেটিভ, যারা অনায়াসে তাদের মেরে ফেলতে পারে।” বনবিবির পালায় আছে, দেবী অরণ্যের এলাকা ভাগ করে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা, ২০ দেশের অংশগ্রহণ উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী
একদিকে থাকবে মানুষের বসতি। অন্যদিকটা দক্ষিণরায়ের, অর্থাৎ বাঘের। অলিখিত মিউচুয়াল সেটলমেন্ট হল, কেউ কারও এলাকায় ঢুকবে না। বাঘ-মানুষের বৈপরীত্যই এই নাটককে জাদুবাস্তবের ভিতরে বাস্তবকে ঠাঁই দেওয়ার কৌশল গড়ে তুলেছে। এটাই এই নাটকে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র।
বনের বাঘ, মনের বাঘ
কানাই বাউরি মন্টুর উদ্দেশে বলেছিল, “বনের বাঘকে তবু সামলানো যায়, কিন্তু মনের বাঘকে সামলানো খুব কঠিন”। এই মনের বাঘই হল লোভ, যা মন্টুর ভিতর পুরোমাত্রায় বেড়েই চলেছে। সে শহুরে ভদ্রলোকেদের ঘেন্না করে। স্থানীয় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার স্রোতস্বিনীকে অপছন্দ করে তার শহুরে উৎসের কারণে। শহুরে টুরিস্ট পার্টির লোকেরা এলে সে আপ্রাণ দাঁও মারতে চায় তাদের উপরে। এই টাকা আদায়ের ফিকিরে তার ঘৃণা যেন খানিক শান্ত হয়। অথচ সেই আবার নিজের এলাকার লোকেদের ঠকায়। ক্যামেরার সামনে তাদের হাজির করিয়ে কথা বলায় ডকুমেন্টারির জন্য। অথচ কৌশিক জনপিছু পাঁচশো টাকা দিলেও সে ওই টাকা মেরে দেয়। প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেয় মাত্র একশো টাকা। মাঝপথে বনবিবির পালা থামিয়ে দিয়ে হারানকাকাকে বলে, আরও অতিরিক্ত টাকা না দিলে আর পালা চলতে দেবে না সে। কৌমজীবনের স্বাভাবিক রীতিনীতি মানে না মন্টু। যে নাগরিক মানুষদের সে অপছন্দ করে, তাদেরই জীবনযাপনের সাচ্ছল্য, প্রতারণা, ভোগের আসক্তি তার চরিত্রের অন্যতম দিক। সুদূর পুরুলিয়ার মেয়ে করবীকে বিয়ে করেছে সে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ভৌগোলিকভাবে দুই প্রান্ত থেকে আসা লোক, অথচ করবীর মধ্যে বস্তুগত আসক্তি প্রায় নেই। স্বামীর রোজগার নিয়ে তার কোনও মিথ্যা গর্ব নেই। মন্টু তাকে মোবাইল উপহার দিতে চাইলেও সে তা নিতে সম্মত হয় না। করবী কৌমমনের আরও কাছাকাছি মানুষ। কিন্তু নিজের উচ্চাশা আর টাকার লোভ, নিজের কমিউনিটির মানুষকে বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করা, এগুলোই মন্টুকে কৌমজীবনের চেয়ে আলাদা করে দেয়। মন্টুর নাগরিক মানুষজন, কলকাতার সংস্কৃতির প্রতি তীব্র বিরাগ যতটা যৌক্তিক, ঠিক ততটাই বিসদৃশ অবিকল ওই নাগরিক সংস্কৃতির চুঁইয়ে-পড়া ক্ষয়িষ্ণু লক্ষণগুলোকে নিজের ভিতরে ধারণ করা। এ থেকে এটাই বোঝা যায় যে, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কোনও সরলরেখা ধরে এগোয় না। একই ব্যক্তির ভিতরে পরস্পরবিরোধী অভিব্যক্তির সমন্বয় তাকে আরও বেশি নাটকীয় করে তোলে।
আরও পড়ুন-মনন চিন্তন কল্পনার উৎসব
বাদাবনের ম্যাজিক
এহেন ব্যাখ্যা-প্রতিব্যাখ্যা নাটকের আখ্যান ঘিরে চলতেই থাকবে। কিন্তু একটা নাটকের টেক্সট সার্থক নাট্যপ্রযোজনা হয়ে উঠতে পারে তার পরিচালক, রচয়িতা, মঞ্চ, আলো, আবহ, সর্বোপরি তার অভিনয়শিল্পীদের গুণে। আর এই দিকগুলোর সাপেক্ষে না মেনে উপায় নেই, ‘বাদাবন’ প্রায় ফুল মার্কস পেয়ে গেছে। যে অসম্ভব কুশলতায় পৃথ্বীশ এই নাটকের বহুস্তরিক অন্তর্বস্তুকে মঞ্চে উপস্থাপিত করেছেন, তা কুর্নিশযোগ্য। মঞ্চের বাঁদিক ঘেঁষে বনবিবির আলো-আঁধারি থান, পিছনে দু’দিকে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া সিঁড়ি, নিচু পাটাতনগুলোকে নৌকার আদলে ব্যবহার, যেখানে গ্রামীণ বয়স্কদের নৌকার উপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকার ভঙ্গিমা— সবগুলোই দক্ষ প্রয়োগের নমুনা। এমনকী পিছনের ছোট্ট ডিঙিনৌকোটিও তাদের চলমান অনিকেত জীবনের ভেসে যাওয়ার প্রতীক। গোটা মঞ্চকে ভাগ করে নিয়ে বনবিবির পালার দৃশ্য বা নাচগানের সমবেত উচ্চারণ আর সেইসঙ্গে অভ্র দাশগুপ্তর আলোর সাঙ্কেতিক প্রয়োগ, মুহূর্তের পর মুহূর্তে আলোর বদলে বদলে যাওয়া সেই প্রয়োগকুশলতার আরও একটা নিদর্শন। কোরিওগ্রাফি এই নাটকে সুন্দরবনের লোকজীবনের ভিতরের আর্তি, প্যাশন, দ্রোহকে তুলে ধরেছে, এটাও বলার।
শেষ যে কথাটা না বললেই নয় তা হল এই নাটকের অভিনয়। আনকোরা, অনামা একঝাঁক অল্পবয়সি ছেলেমেয়েকে এই নাটকে সুযোগ দিয়েছেন পৃথ্বীশ। বড় নামের পিছনে ছোটেননি। আর, বাংলা মঞ্চে নতুন অভিনেতা আসছে না— এই হা-হুতাশ যাঁরা করে থাকেন, তাঁদের গালে থাপ্পড় কষিয়ে এইসব নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দর্শকের আত্মায় ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষত মন্টু গাইডের ভূমিকায় নীলাঞ্জন গাঙ্গুলি, মাস্টারকাকার ভূমিকায় অনির্বাণ সরকার, যমুনার ভূমিকায় পান্না মণ্ডল, করবীর ভূমিকায় মৌমিতা দত্ত বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। আর, আবহনির্মাণে অভিজিৎ আচার্য বরাবরের মতোই দুরন্ত। এই সবকিছু মিলিয়েই মঞ্চের উপরে তৈরি হয়েছে ম্যাজিক— বাদাবনের ম্যাজিক।