সরস্বতী আসলে কে, কী এবং কেন?

তিনি স্বরূপত কী? দেবী নাকি নদী? সরস্বতী পুজোর প্রতিবেশে উত্তরের খোঁজে দেবাশিস পাঠক

Must read

সরস্বতী আসলে কে, কী এবং কেন? —এ নিয়ে তাবৎ জিজ্ঞাসার একটাই উত্তর হতে পারত। ঋক্ বেদের ২.৪১.১৬ নং সূক্ত। সেখানে ঋষি গৃৎসমদ সরস্বতীকে সম্বোধন করে বলেছেন—
অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতী।
এখানে এই একটিমাত্র মন্ত্রে সরস্বতীকে সর্বশ্রেষ্ঠ মাতা, সর্বশ্রেষ্ঠ নদী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দেবী বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এই তিনটি পরিচয়েই সরস্বতীর তাবৎ পরিচয় উন্মোচিত হয়েছে। বোঝা গিয়েছে, সরস্বতী, যাঁকে আমরা মা দুর্গার এক কন্যা বলে জানি, তিনি একাধারে মাতা, নদী এবং দেবী।
এসবেও কিন্তু ধোঁয়াশা পুরোপুরি কাটে না। কারণ, মাতৃরূপের সঙ্গে দেবী পরিচয় লগ্ন থাকতে পারে, কিন্তু নদী পরিচয় তাতে জুড়ে যায় কোন সূত্রে, সেটা বোঝা যায় না। অন্তত আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সেটা বুঝে উঠতে পারে না।
শ্রী অনির্বাণের মতো মানুষদের কথা আলাদা। পূর্বাশ্রমে তাঁর নাম ছিল নরেন্দ্রচন্দ্র ধর। এগারো বছর বয়সে মুখস্থ করে ফেলেছিলেন অষ্টাধ্যয়ী পাণিনি এবং শ্রীমদ্ভগবত গীতা। এহেন শ্রী অনির্বাণ তিন খণ্ডে ‘বেদ মীমাংসা’ লিখেছেন। সেই গ্রন্থে এই সূক্তে সংগুপ্ত তিনটে সুতো তিনি টেনে বের করে এনে মিলন বিন্দুর মতো সুতো তিনটের গিঁটটা কোথায় তা চিনিয়ে দিয়েছেন।
তাঁর মতে, যে-কোনও জিনিসকে তিনটে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। যে দৃষ্টিকোণে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসমূহকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, সেটি হল অধিভূত দৃষ্টিকোণ। আর একটি দৃষ্টিকোণ হল অধিদৈবত দৃষ্টিকোণ। এই দৃষ্টিকোণে বুদ্ধির অগম্য বিষয়সমূহ সামনে উঠে আসে। তৃতীয় দৃষ্টিকোণটি হল অধ্যাত্ম দৃষ্টিভঙ্গি। ‘অধ্যাত্ম’ কথাটির অর্থ দ্বিবিধ। ‘Spiritual’ এবং ‘আত্মবিষয়ক’। একই সঙ্গে শরীর আর ব্রহ্মের কথা বলে অধ্যাত্মবাদ। তবে তার গোড়ায় থাকে subjectivity। এর অর্থই হল নিজস্ব বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, অনুভূতিকে প্রাধান্য প্রদান। বাস্তবতা এখানে গৌণ।

আরও পড়ুন-বারাকপুরের নয়া সিপি অজয়কুমার ঠাকুর

শ্রী অনির্বাণ বেদমীমাংসায় লিখছেন, সরস্বতী অধিভূত দৃষ্টিতে স্রেফ জলের ধারা। ‘সরস্বতী’ ব্যুৎপত্তিগত অর্থে তো তাই। সরস্ [জল] + মতুপ্ + ঙীপ্ [স্ত্রীলিঙ্গে; তাই ‘ঈ’]।
অধ্যাত্ম দৃষ্টিতে সেটাই প্রাণের প্রবাহ। কারণ, জল আর জীবন অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা। জলের ধারা মানেই জীবনের ধারা।
আর, এটাই অধিদৈবত দৃষ্টিতে বিশ্বজনীন চিৎশক্তির প্রবাহ। জ্ঞান ও চৈতন্যের ধারা।
অধিভূত দৃষ্টিতে দেখলে সরস্বতী তাই নদী। ঋক্ বেদে তাই বলা হয়েছে, সরস্বতী নদী নাং শুচির্যতী গিরিভ্য আসমুদ্রাৎ [৭.৯৫.২] অর্থাৎ শুদ্ধ নদী সরস্বতীর প্রবাহ সমুদ্র পর্যন্ত গিয়েছে। ‘ব্রাহ্মণ’ (ঋক্ বেদের যে অংশে যজ্ঞবিধি বর্ণিত হয়েছে)-এ বলা হয়েছে প্লক্ষপ্রস্রবণ থেকে উৎসারিত হয়েছে সরস্বতী নদীর ধারা।
বিনশন থেকে টানা ৪৪ দিন ঘোড়া ছুটিয়ে পৌঁছনো যেত প্লক্ষপ্রস্রবণে। জানাচ্ছে তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ। প্লক্ষপ্রস্রবণ থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমদিকে বয়ে চলেছিল সরস্বতীর ধারা। বিপুল সেই জলপ্রবাহ, বেগসম্পন্নও বটে। তবে কালান্তরে তার প্রবাহ মন্দীভূত হয়। খুব সম্ভবত রাজস্থানের মরুপ্রদেশে এই ধারা অন্তঃসলিলা হয়। যেখানে সরস্বতী অন্তঃসলিলা হয়, তার প্রবাহ আর দৃষ্টিগোচর থাকে না, ‘প্রবহতি না সৌ কেনচিদ্ দৃশ্যতে’, সেই জায়গাটাই বিনশন, ‘তদ্ বিনশনম্ ইত্যুচ্যতেঃ’। এখানে ‘বিনাশ’-এর অর্থ ‘অদর্শন’। ১০ম মণ্ডলে ৬৪ সূক্ত ৯ম ঋক্ মন্ত্রে গয়প্লাত ঋষি সরস্বতীর এই নদীরূপের কাছেই প্রার্থনা মন্ত্র জ্ঞাপন করেছেন।
সরস্বতী সরযূঃ সিন্ধুরূর্মিভির্মহো মহীরবসা
যন্তু রক্ষণীঃ।
দেবীরাপো মাতরঃ সুদিয়োৎন্বো ঘৃতবৎ
পয়ো মধুমন্নো অর্চত।।
এই মন্ত্রে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, সরস্বতী, সরযূ আর সিন্ধুর মতো মহাতরঙ্গশালিনী প্রবাহশালিনী নদী রক্ষা করুন আমাদের। জলদায়িনী মাতৃসমা এই সব নদী আমাদের ঘিয়ের মতো, মধুর মতো জল দিন।
অর্থাৎ, এই সূক্তে সরস্বতী নদী, নদীই। মায়ের মতো কিন্তু নদীই। তিনি জল দেন। সেই জল ঘি-মধুর তুল্য হতে পারে, কিন্তু আসলে তা জলই। সেই নদীর বুকে ঢেউ ওঠে। সেই নদী প্রবহমানা। সেজন্যই তার কাছে রক্ষাকর্ত্রী হয়ে ওঠার প্রার্থনা জ্ঞাপন।
‘মহীরবসা যন্তু রক্ষনীঃ’।

আরও পড়ুন-সামাজিক প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দ কমিয়ে দিল কেন্দ্র

কারণ বেদের যুগেও মানুষ জানত, ভালমতোই জানত, নদী উপচে পড়লে বন্যা হয়, ভেসে যায় জীবন, ক্ষয় হয় সভ্যতার। সরস্বত্যভি নো নেষি বস্যো মাপ স্ফরীঃ পয়সা মা না আ ধক্। বৈদিক মানুষের কাতর প্রার্থনা, হে সরস্বতী! তুমি আমাদের প্রশস্ত ধনে নিয়ে যাও। তুমি আমাদের হীন কোরো না। অধিক জল দ্বারা আমাদের উৎপীড়িত করবে না।
এই যে নদীর প্রবহমানতা, এই যে গতিময়তা, এতে সংগুপ্ত আর-একটা ইঙ্গিত। সেটা সরস্বতীকে নদী ভিন্ন অন্য তাৎপর্যে মণ্ডিত করে।
ঋক বেদের ১.১৬৪.৫২ নং সূক্ত। সেখানে বলা হচ্ছে, সূর্যদেব স্বর্গীয় সুন্দর গতিবিশিষ্ট, গমনশীল, প্রকাণ্ড জলের গর্ভ-সমুৎপাদক এবং ওষধিসমূহের প্রকাশক। দিব্য সুপর্ণং বায়সং বৃহন্তমপাং গর্ভং দর্শতমোষধীনাং। তিনি বৃষ্টি দ্বারা জলাশয়কে তৃপ্ত করেন আর নদীকে পালন করেন। আমাদের রক্ষা করার জন্য তাঁকে আহ্বান করছি। অভীপতো বৃষ্টিভিস্তর্পয়ন্তং সরস্বন্তমবসে জোহবীমি।
সংস্কৃতজ্ঞ ও বেদজ্ঞ পণ্ডিতরা বলেন, এখানে ‘সরস্’ শব্দটি মতুপ্ প্রত্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘সরস্বান’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। ‘সরস’ মানে এক্ষেত্রে ত্রিলোক ব্যাপ্তকারী জঙ্গম রশ্মির অধিকারী। সেই অর্থে ‘সরস’ এখানে ‘সূর্য’। ‘সরস্বান’-এর স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ সরস্বতী। সেই অর্থে সরস্বতী সূর্যের জ্যোতি বা সূর্যরশ্মি।
পণ্ডিতবর্গ এখানে আরও একটি সাযুজ্য খুঁজে টেনে বের করে আনেন।
ঋক বেদ বলছে সরস্বতী ‘সপ্তস্বসা’। তার মানে, সরস্বতীর সাতটি বোন আছে। তার মানে, সরস্বতী নদীর সাতটা শাখা আছে। সরস্বতীর সমতুল্য সাত-সাতটা শাখানদীর কথা বলছেন ঋক-ধষিবর্গ। সিন্ধু, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, বিপাশা, ইরাবতী, শতদ্রু এবং মরুদ্বৃধা। একইভাবে তো সূর্যরশ্মিতেও মিশে থাকে সাতটি রং। বেনীআসহকলা। বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা আর লাল।
বেদের যুগ কেটে গেল। সরস্বতীর জায়গা নিল গঙ্গা। নদী হিসেবে সে-ই হয়ে উঠল ভারতবর্ষের ‘লাইফলাইন’, জীবনরেখা। কিন্তু তাও সরস্বতীর মহিমা ভারতবাসীর মনের এত গভীরে ঢুকে গেল যে জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন হিন্দুতীর্থে সরস্বতীর আবির্ভাব কল্পিত হতে লাগল। প্রয়াগের সঙ্গম, পশ্চিমবঙ্গের ত্রিবেণী, পুষ্কর, গয়া, কুরুক্ষেত্র, সর্বত্রই সরস্বতী ভারতবাসীর শ্রদ্ধা আর প্রীতির চিহ্ন হয়ে রয়ে গেল; বাস্তবে সেই নদী চর্মচক্ষে দেখা না গেলেও।

Latest article