আজ পশ্চিমবঙ্গ দিবস কে বলল!

উত্তরপ্রদেশ-সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের রাজভবনে আজ ২০ জুন ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওরা ঠিক করে দেবে বাংলা দিবস কবে হবে? সব চাপিয়ে দেবে বিজেপি! ওদের মস্তিষ্ক সন্ত্রাসবাদের চারণভূমি। কেন এই অভিযোগ ওদের বিরুদ্ধে? কেন আমরা ইতিমধ্যেই পয়লা বৈশাখকে ‘রাজ্য দিবস’ হিসেবে পালন করছি? সেসব জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজলেন দেবাশিস পাঠক

Must read

“প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, বিজেতা এক হস্তে তরবারি ও অন্য হস্তে কোরআন লইয়া ইসলামের ধর্মের প্রসার ঘটাইয়াছিল। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে সত্য নহে।”
—ইতিহাসবিদ জগদীশ নারায়ণ সরকার
(হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক : মধ্যযুগ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, ১৪১৪)
“ভারতবর্ষে দরিদ্রদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশী কেন? একথা বলা মূর্খতা যে, তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল। …বস্তুত জমিদার ও পুরােহিত বর্গের হস্ত হইতে নিস্কৃতি লাভের জন্যই তাহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিলেন।”
— স্বামী বিবেকানন্দ
প্রচলিত ধারণা ও বিজেপির মতো গেরুয়া পার্টি কর্তৃক প্রচারিত ইতিহাস দর্শন, এই দুইয়ের বিপ্রতীপে সত্যের অবস্থান। ঐতিহাসিক সত্যের জায়গা। এটুকু বোঝানোর জন্যই রচনার শুরুতেই উদ্ধৃতি দুটির সংস্থাপন। সত্যির জমিটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই এই উপস্থাপনা। তার দরকার পড়ল, কারণ গেরুয়া বলয় থেকে নির্ধারণের চেষ্টা চলছে, বাংলা দিবসের দিনক্ষণ। সেই কারণেই সত্যিটা সামনে আনা দরকার। বিভ্রান্তি প্রতিহত করার জন্যই এটা দরকার।
কী হয়েছিল ২০ জুন, ১৯৪৭-এ? কবে থেকে শুরু হওয়া ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত রূপ পায় সেদিন?
১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় ভোটাভুটিতে বাংলা ভাগের বিষয় স্থির হয়েছিল। একভাগ পূর্ব পাকিস্তান ও অন্য ভাগ পশ্চিমবঙ্গ (Paschimbanga Dibas)। বোঝাই যাচ্ছে, ২০ জুন, ১৯৪৭ সালে তো পশ্চিমবঙ্গের জন্মই হয়নি, কারণ সে-সময় ভারত স্বাধীন হয়নি। অথচ, সেদিন নাকি পশ্চিমবঙ্গ দিবস (Paschimbanga Dibas)!
সত্যিটা হল, অখণ্ড বাংলাকে সেদিন দায়িত্ব নিয়ে ভেঙেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। আজকের বিজেপির আদি পুরুষ। যে জনসঙ্ঘী ভাবনার উত্তরাধিকার বিজেপি, সেই চেতনার বীজতলা তৈরির ইতিহাসটা একটু মনে করিয়ে দেওয়া যাক।
আসলে বাংলা ভাগের জন্য অজুহাত খাড়া করতে বাঙালি হিন্দুদের একটা প্রভাবশালী অংশ এইরকম একটা হত্যাকাণ্ড মনে মনে দৃঢ়ভাবে চাইছিলেন আর ১৬ আগস্ট মুসলিম লিগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবসে তাদের সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত সুযােগটি এনে দিয়েছিল। ১৯৪৬-এর সেই ভয়ংকর দাঙ্গাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে অর্থাৎ তার সমস্ত দায় অপদার্থ মুসলিম লিগ সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই বাঙালি হিন্দুদের প্রভাবশালী অংশ প্রদেশ বা বাংলা ভাগের জন্য শুরু করে তুমুল আন্দোলন। অথচ ১৯০৫ সালে এই বাঙালি হিন্দুরা লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগের চক্রান্তকে রুখে দেওয়ার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে, ১৯৪৭ সালে তারাই আবার বাংলা বিভাগের দাবি তুলে বাংলা ভাগ করিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের এপ্রিলে, হুগলির তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার বার্ষিক প্রাদেশিক অধিবেশনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হিন্দুর জন্যে হিন্দুস্থান ও বাংলাভাগের দাবির পুনরাবৃত্তি করলেন। ওই অধিবেশনে হিন্দু মহাসভার সভাপতি নির্মল চট্টোপাধ্যায় (সিপিএম নেতা ও লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাবা) এক ভাষণে তিনি বলেন, “Our demand for partition today is…to prevent the disintegration of the nationalist element and to preserve Bengal’s cutture and to secure a Homeland for the Hindus of Bengal which will constitute a Nationalist State as a part of India.”
গেরুয়া পার্টি বলার চেষ্টা করে, পাকিস্তানের হিংস্র কবল থেকে সমগ্র বাংলাকে বাঁচাতে ও হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলাভাগের দাবি জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটাই যদি বাংলাভাগের কারণ হয়, তাহলে ভারতের সীমানার মধ্যেও তাে অখণ্ড বাংলা গড়তে পারতেন শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর অনুগামীরা। তবে কেন তাঁরা ভারতের মধ্যকার অখণ্ড বাংলারও বিভাজন চেয়েছিলেন?

আরও পড়ুন-প্রয়াত বর্ষীয়ান সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাজন পরিকল্পনা ঘােষণা করলে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা একত্রে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে আরও জোরদার করলেন। তাঁরা উসকানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে, কাগজে বিবৃতি দিয়ে বােঝাতে লাগলেন যে, হিন্দুরা বিপন্ন, বাংলা ভাগ ছাড়া উপায় নেই। বাংলা পাকিস্তানে গেলে তাে বটেই, স্বাধীন সার্বভৌম হলেও এমনকী ভারতে থাকলেও হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাকে বিভক্ত করে হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করতে হবে। সেইমতো তারা বাংলার হিন্দুদের প্রভাবিত করতে লাগলেন। জাতীয় কংগ্রেসের নেতারাও প্রভাবিত হতে লাগলেন। শ্যামাপ্রসাদ সর্দার প্যাটেলকে এক চিঠিতে লিখলেন, “আমি আশা করি শেষ মুহূর্তে মুসলিম লিগের ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। মি. জিন্না যদি অবস্থার চাপে তা করতে বাধ্যও হয়, অনুগ্রহ করে বাংলাকে বিভক্ত করার ব্যাপারটা ব্যর্থ হতে দেবেন না। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় যেরকম ভাবা হয়েছে সেরকম একটা শিথিল কেন্দ্রীয় সরকার স্থাপিত হলে বাংলায় আমাদের কোনওরকম নিরাপত্তা থাকবে না। পাকিস্তান হােক বা না হােক, আমরা বাংলার বর্তমান সীমানার মধ্যে দুটি প্রদেশ গঠন করার দাবি করছি।”
উল্লেখ্য, ভারতভাগ অনিবার্য না হলেও যে বাংলাভাগের দাবি অনিবার্যভাবে উত্থাপিত হত শ্যামাপ্রসাদের উপরােক্ত বক্তব্য থেকে তা-ই প্রমাণিত হয়।
এর পূর্বে হােসেন শহিদ সােহরাওয়ার্দি বলেন যে, বাংলাকে বিভক্ত করার প্রস্তাব বাঙালির আত্মহত্যারই শামিল হবে এবং দিল্লির সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন,
‘I am visualising an independent, undivided, sovereign Bengal in divided India.’
এবং শরৎ বসু এপ্রিল মাসে গঠন করলেন ‘অল বেঙ্গল অ্যান্টি-পাকিস্তান অ্যান্ড অ্যান্টিপার্টিশন’ কমিটি। হােসেন শহিদ সােহরাওয়ার্দি, শরৎ বসু, আবুল হাসিমের অখণ্ড বাংলার স্বপ্নকে কীভাবে শ্যামাপ্রসাদ, আকরাম খান প্রমুখ নেতারা ভেঙে দিয়েছিলেন তার মূল্যবান ইতিহাস অমলেন্দু দে লিপিবদ্ধ করেছেন স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা, প্রয়াস ও পরিণতি নামক গ্রন্থে। জয়া চ্যাটার্জিও এ প্রসঙ্গে মাড়ােয়ারি বণিক সম্প্রদায়ের প্ররােচনার কথা ব্যাখ্যা করেছেন। আর শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন এইসব বণিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলা অখণ্ড থাকলে কলকাতার ওপর অবাঙালি ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র আধিপত্য আর থাকবে না। এই ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য শ্যামাপ্রসাদরা যেভাবে বাংলা ভাগ করে ছাড়লেন তা সত্যিই অবাকের। বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার বিশেষ প্রয়ােজনীয়তা ইংরেজ বা দিল্লিওয়ালা অনুভব করতে পারেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ অবিভক্ত বাংলার যে সর্বনাশ করে গেলেন, তাতে দূরদর্শিতার অভাব ছিল। সেকথা অনুধাবন করে ১৯৫২ সালে নদিয়ার চাকদহে এক জনসভায় তিনি নিজেই বলেছিলেন, “বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম তাহলে বাংলা ভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে। যােগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।” এর পরেও কি ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসেবে গণ্য হতে পারে?
একুশ শতকে এসে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কি নিজের পরিচয় নিয়ে অনিশ্চয়তার সম্মুখীন? সে উত্তর না দিয়ে একটা কথা পরিষ্কার করে বলা যেতে পারে, ভারতীয় বাঙালির একটা স্বতন্ত্র মহিমা আছে। বাংলাদেশের বাঙালির বেলায় রাষ্ট্রীয় ধর্ম হল ইসলাম, কিন্তু ভারতের যে বাঙালি তার ক্ষেত্রে ধর্ম হল ব্যক্তিগত বিষয়, মুসলিমই হােক কি হিন্দুই হােক, তার রাষ্ট্রীয় ধর্ম হল ধর্মনিরপেক্ষতা। এই কথাটা বিজেপি ভুলে যেতে পারে, আমাদের মনে রাখতেই হবে।
আর এজন্যই বিভেদ পন্থা জাত ২০ জুন নয়, সব ধর্মের বাঙালির কাছে শুভ দিন ১ বৈশাখই পশ্চিমবঙ্গ দিবস (Paschimbanga Dibas)।

Previous article

Latest article