দোহা, ১৭ ডিসেম্বর : বুয়েনোস আইরেস শহরের প্রাণকেন্দ্রে ২৩৫ ফুট উচ্চতার বিশাল মনুমেন্ট ওবেলিস্কো। লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠতেই ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের নিচের একটি ছবি ভাইরাল হয়। যেদিকে চোখ যায় শুধুই কালো মাথার ভিড়। সবার পরনে মেসির ছবি দেওয়া নীল-সাদা জার্সি আর হাতে আর্জেন্টিনার পতাকা। পাগলের মতো নাচছেন, দৌড়চ্ছেন, গান করছেন। তাঁদের অনেকেই নতুন প্রজন্ম যাঁরা হয়তো দিয়েগো মারাদোনার ‘হ্যান্ড অফ গড’ বা শতাব্দীর সেরা গোল দেখেননি, কিন্তু মেসির বাঁ-পায়ের জাদুতে আচ্ছন্ন। ৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে মেসিরা বিশ্বকাপ জিতলে শুধু বুয়েনোস আইরেস বা আর্জেন্টিনা নয়, গোটা পৃথিবীর ছোট-বড় অনেক শহর, গ্রামই আর্জেন্টিনা কলোনি হয়ে উঠবে। ঠিক যেমন বিশ্বকাপের শহর দোহা এখনই নীল-সাদা কলোনির রূপ নিয়েছে। শুধু একটা জাতিই নয়, বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মেসি ও আর্জেন্টিনাপ্রেমীদের সব আশা-ভরসা এখন রোজারিওর ছেলেটির ক্ষুদ্র কাঁধে।
আরও পড়ুন-ক্ষত
আশ্চর্যের ব্যাপার, দেশে অর্থনীতির বেহাল অবস্থার মধ্যেও মেসির দেশের অর্থনীতিবিদরা চাইছেন এবার যেন আর্জেন্টিনা কাপ জিতেই দেশে ফেরে। ইতিহাস বলছে, বিশ্বকাপ জয়ের প্রভাব চ্যাম্পিয়ন দেশের অর্থনীতিতেও পড়ে। ১৯৯০ সালের পর থেকে বিজয়ী দেশের জিডিপি গড়ে আগের বছরের তুলনায় ১.৬ শতাংশ হারে বেড়েছে। তবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রথম ১২ মাসে বেড়ে পরে তা কমেও যায়। মুদ্রাস্ফীতির লাগামছাড়া বৃদ্ধি, দেশে কাজ-চাকরির অভাব সত্ত্বেও আর্জেন্টিনার মানুষ বিশ্বকাপে মজে অভাব ভুলেছেন। আর্থিক সংকট নিয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলনও বিশ্বকাপের সময় বন্ধ রয়েছে। শুধু একটাই আকুতি, মেসির হাতে কাপ উঠুক।
আরও পড়ুন-মেসির হাতেই কাপ দেখতে চায় কাতার
এলএম টেনের কাপ-স্বপ্নপূরণের রাস্তায় বাধা একটাই, সেটা হল ফ্রান্স। মেসি নিজে স্বপ্নের ফর্মে, আর্জেন্টিনা দল হিসেবেও দুর্দান্ত খেলছে। তবে দিদিয়ের দেশঁর দল এতটাই দাপট নিয়ে খেলছে, হাবভাব ও শরীরী ভাষায় এমন নীরব মস্তানি তাদের যেন কাউকে ওরা রেয়াত করতে চায় না। ওরা নিজেদের মতো খেলবে, গোল করবে আর জিতে বেরিয়ে যাবে। কবিতার দেশ হলেও ফুটবলে ছন্দই যেন শেষ কথা নয়, ট্যাকটিক্যাল ফুটবল খেলে জয়টাই আসল— এটাও যেন টানা দু’বার কাপ জয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ধুরন্ধর কোচ দেশঁ বুঝিয়ে চলেছেন। লুসেল স্টেডিয়ামে স্বপ্ন ছোঁয়ার ফাইনালে মেসির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিয়ান এমবাপে। কাপ জিততে হলে মেসির ক্লাব সতীর্থকেও দমিয়ে রাখতে হবে নাহুয়েল মলিনা, নিকোলাস ওটামেন্ডি, মার্কোস আকুনাদের। মেসির মতো এমবাপেকেও ‘চক্রব্যূহ’ তৈরি করে আটকে রাখা যাচ্ছে না। সামান্য একটু জায়গা পেলেই উইথ দ্য বল বা অফ দ্য বল মুভমেন্টে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। সেমিফাইনালে মরক্কোর বিরুদ্ধেও সেটা করে দেখিয়েছেন কেএম টেন।
আরও পড়ুন-মহাসমারোহে অমৃত মহোৎসব, সংখ্যালঘু অধিকাররক্ষা আজও সেই তিমিরে
চার বছর আগে রাশিয়ায় এমবাপে-জিরুদের কাছে হেরে চোখের জলে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায়ের যন্ত্রণা এখনও ভোলেননি মেসি। একটা বিশ্বকাপ জিততে কতটা মরিয়া তিনি, তা কাতারে এবারের প্রতিযোগিতায় দেখিয়ে চলেছেন জাদুকর। এমবাপে ও ফরাসি-কাঁটা উপড়ে কাপ-স্পর্শের মহার্ঘ্য অনুভূতি পেতে হলে আর একবার মেসিকে জ্বলে উঠতে হবে। মারাদোনা-পুত্র দিয়েগো জুনিয়র বলেই দিলেন, ‘‘বাবা আছেন। উপর থেকে দেখছেন। মেসিরা ঠিক পারবে। বাবাও গর্বিত হবেন। আমিও আর একটা তারা বুকে আঁকব।’’