সংবিধান দিবসের আগের দিন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ ‘সমাজতন্ত্রী’ আর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি নিয়ে যাবতীয় আপত্তি খারিজ করে দিল। সংবিধানের মূল নীতি আর কাঠামোর সঙ্গে শব্দদ্বয়ের অচ্ছেদ্য সম্পর্কটাও স্পষ্ট করে দিল।
‘সংবিধান দিবস’ পালনের দিন উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সাফ জানালেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতন্ত্রী’র মতো যে শব্দগুলো সংবিধানের আদিতে ছিল না, জরুরি অবস্থার সময়ে সংবিধানে সেগুলির অন্তর্ভুক্তি ‘সংবিধানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’র শামিল। প্রায় একই সময়ে, উল্লিখিত দুটি ঘটনার সমান্তরালে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে সে-দেশের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি তুলে দেওয়ার আর্জি জানাচ্ছিলেন তাঁরা, যাঁরা বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের অস্তিত্ব বিপন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
আসলে ২৬ নভেম্বর, ১৯৪৯-এ ভারতীয় সংবিধান যখন গণপরিষদে গৃহীত হল, তখন সেটির প্রস্তাবনায় ‘সমাজতন্ত্রী’ আর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি ছিল না। সংবিধান প্রণেতারা মনে করেছিলেন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এই দুই মতাদর্শ শেষ পর্যন্ত ভারতীয় জনগণ গ্রহণ করবেন কি না, সেটা তাঁদের ওপর ও সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। কারণ, উভয় ধারণাই পশ্চিমি সংস্কৃতিতে ঠিক যেরকম, তেমনটা ভারতীয় পরম্পরায় নয়।
আরও পড়ুন-জলস্বপ্ন প্রকল্প বদলে দিচ্ছে জেলাকে
১৯৬০-এ বেরুবারি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, প্রস্তাবনা সংবিধানের অংশ নয়। সেই অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তেরো বছর পর, ১৯৭৩-এ কেশবভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানাল, প্রস্তাবনাও সংবিধানের অংশ এবং প্রস্তাবনার আলোকেই সংবিধানকে ব্যাখ্যা করতে হবে। তার সঙ্গে এটাও জানাল, সংবিধানের অন্যান্য অংশ পরিবর্তনের ক্ষমতা যেমন সংসদের আছে, প্রস্তাবনা বদলের ক্ষমতাও তারই এক্তিয়ারভুক্ত। আর, ১৯৭৬-এ ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর সুবাদে প্রস্তাবনায় সংযোজিত হল তিনটি শব্দ-‘সমাজতন্ত্রী’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সংহতি’।
সম্প্রতি এই শব্দ সংযোজনা নিয়ে ফের মামলা হয় সুপ্রিম কোর্টে। আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায় এবং অন্যান্য কয়েকজন ‘সমাজতন্ত্রী’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি বাতিলের আর্জি জানান। কারণ, ওই শব্দ দুটি যোগ করা হয়েছে জরুরি অবস্থার সময়। আর তাই, ওই সংযোজনার মাধ্যমে দেশের জনগণকে একটি সুনির্দিষ্ট আর্থ-রাজনীতিক মতাদর্শ অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। একই বিষয় নিয়ে রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ তথা বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী যে মামলা করেন তাতে আর্জি জানানো হয়, শব্দ দুটি থাক, প্রস্তাবনাতেই থাক, কিন্তু পৃথক একটি অনুচ্ছেদে থাক। মূল প্রস্তাবনার নিচে সেই অনুচ্ছেদটি সংযোজিত হোক। সুব্রহ্মণ্যম স্বামী শব্দ দুটি বাতিলের আবেদন করেননি। কারণ, জরুরি অবস্থার পর, জনতা সরকারের আমলে, ৪৮তম সংবিধান সংশোধনীতেও ‘সমাজতন্ত্রী’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’র মতো শব্দগুলোকে নিয়ে কোনও আপত্তি তোলা হয়নি, বরং সেগুলো সমর্থিত হয়েছিল।
এই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট যা বলল তা চুম্বকে এরকম—
(১) ‘সমাজতন্ত্রী’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, এই বিষয়গুলো সংবিধানের মূল কাঠামোর অচ্ছেদ্য অংশ।
(২) সংবিধান একটি ‘জীবন্ত দলিল’। তাই সময়ান্তরে এর সংশোধনের প্রয়োজন। আর সেই সংশোধনের ক্ষমতা কেবল সংসদের আছে।
(৩) প্রস্তাবনা যেহেতু সংবিধানের অংশ সেহেতু, প্রস্তাবনা অংশেরও সংশোধনের ক্ষমতা কেবল সংসদের আছে।
আরও পড়ুন-২৪ রোগী কল্যাণ সমিতির নয়া সদস্যদের নাম ঘোষণা
(৪) ভারতীয় প্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূমিকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে প্রথম দিকে কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সমাজতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলার ইঙ্গিতই দেয়। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থার জাতীয়করণ, করের উঁচু হার ইত্যাদি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর লক্ষণ ছিল। তা বলে মিশ্র অর্থনীতির পথ ছেড়ে ভারত কখনও অর্থনীতির কেন্দ্রীকরণের পথে হাঁটেনি। রাষ্ট্রীয় সংস্থার পাশাপাশি ব্যক্তিগত মালিকনাধীন সংস্থাও এখানে বর্ধিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১৯৯১-তে বাঁক বদল হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক মডেল সরিয়ে বাজার অর্থনীতির পালে বাতাস জোগানো হয়েছে। তার সুবাদে বিগত তিন দশকে দারিদ্র্যমুক্তি ঘটেছে বহু মানুষের। তবু, তবুও, আয় বৈষ্ণম্য ঘোচানোর লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক ঘরানার বহু ব্যবস্থা এদেশে স্বীকৃত হয়েছে। মনরেগার মতো কাজ জোগানোর প্রকল্প এসেছে। খাদ্যশস্যে ভর্তুকি-ব্যবস্থা চালু রাখতে হয়েছে। মহিলা ও কৃষকদের নগদ সুবিধার সরাসরি হস্তান্তর মান্যতা পেয়েছে। এসব তো আর ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বৈশ্য-স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয় নয়। এসবই হল গরিবি হ্রাসের প্রণোদনায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পদক্ষেপ। পাশাপাশি, একই সময়ে, এদেশেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বেসরকারি সংস্থাগুলো।
(৫) ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মানে এদেশে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে একেবারে অচ্ছুত করে রাখা নয়। এদেশে প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ ধর্মাচরণে স্বাধীনতা যেমন মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্র যেমন কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসের পৃষ্ঠপোষক নয়, তেমনই রাষ্ট্র ধর্মাচরণের সঙ্গে সংযুক্ত অর্থনৈতিক, আর্থিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ দিকগুলো নিয়ন্ত্রণের অধিকার ভোগ করে। রাষ্ট্র যেমন কোনও বিশেষ ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী নয়, তেমনই কোনও ধর্মবিশ্বাসীর বিশ্বাসে আঘাত হানারও পক্ষপাতী নয়। সাম্যের অধিকারই ভারতকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ করে তুলেছে।
এক কথায়, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণাই এদেশে অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘সমাজতন্ত্র’ আর ধর্মীয় ক্ষেত্রে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’য় সার জল অক্সিজেন জুগিয়েছে।
আর এই পরম্পরার আবহে ভারতে সংখ্যালঘু নিগ্রহ ও নিধন এবং পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নিধনের ঘটনাবলি বুঝিয়ে দিয়ে গেল, সাংবিধানিক প্রতিবিধান থাকুক না থাকুক, শীর্ষ আদালতের রায়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হোক বা না-হোক, দেশে জ্ঞানোদ্দীপ্ত স্বৈরাচারী ব্যবস্থা থাকুক বা উদারনৈতিক গণতন্ত্র, আম-জনতার শুভবুদ্ধির বলয়ই ‘সমাজতন্ত্রী’ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হয়ে ওঠার, হয়ে থাকার শেষ আশ্রয়। সেটার জন্যই আমাদের সমাজতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে থাকার অঙ্গীকার করতেই হবে।