আমরা বুড়ো হই কেন

আমরা কেউ চাই না কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে বার্ধক্য আসে। বার্ধক্যের কারণ কী, এই সত্য জানতে উঁকি দিতে হবে আমাদের দেহকোষের অন্দরে।

Must read

বুড়ো হতে আমরা কেউ চাই না কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে বার্ধক্য আসে। বার্ধক্যের কারণ কী, এই সত্য জানতে উঁকি দিতে হবে আমাদের দেহকোষের অন্দরে। লিখেছেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

একটা বছর কাটিয়ে আমরা নতুন বছরে পা দিয়েছি। বাড়ছে বছরের সংখ্যা, সঙ্গে বয়স বাড়ছে। একটু একটু করে বড় হচ্ছি আমরা বা বলা ভাল বুড়ো হচ্ছি আমরা। মানুষের জীবনে বৃদ্ধি ও বিকাশের পাঁচটি দশার মধ্যে সর্বশেষ দশা হল বার্ধক্য। কিন্তু মজার কথা হল এই দশায় কেউই আমরা পৌঁছতে চাই না। এই বার্ধক্যে না যেতে চাওয়ার কারণই হল আমরা বার্ধক্যজনিত রোগকে ভয় পাই এবং শুধু তাই নয়, বার্ধক্য আমাদের কাছ থেকে আমাদের কর্মক্ষমতাও কেড়ে নেয়। এককথায় বার্ধক্য হল এমন এক দশা যেখানে শারীরিক ক্ষমতা হারাতে থাকে, বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে থাকে, ব্যক্তি পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীতে ৬০ বছর বয়সি বৃদ্ধের সংখ্যা ছিল ১২ শতাংশ, যা বেড়ে ২০৫০ সালে প্রায় ২২ শতাংশ হবে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। কিন্তু শুধুই কি কালের নিয়মে বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের ত্বক কুঁচকে যায়, দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, কর্মক্ষমতা হারায় আর বিভিন্ন রোগ দেখা যায় নাকি তার পেছনে রয়েছে কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা? এরই হদিশ পেতে আজ এই আলোচনা।

আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারে রেকর্ড , কোভিডের পজিটিভিটি হার কমে ১ শতাংশের নিচে

আমরা কেন বুড়ো হই, এই সহজ সত্যিটাকে বুঝতে গেলে সবার প্রথমে আমাদের দেহের কোষের অন্দরমহলে একবার উঁকি দিতে হবে। কারণ সব রহস্য যে ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে। আমাদের দেহের গঠনগত ও কার্যগত একক কোষের মধ্যে থাকা দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোষ অঙ্গাণু নিউক্লিয়াস ও মাইটোকনড্রিয়া বা আরও নিখুঁতভাবে বলতে গেলে এই দুই কোষ অঙ্গাণুর মধ্যে থাকা DNA বা ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডই এই কর্মকাণ্ডের মূল কান্ডারি।
DNA–র ক্ষতি ও তার মেরামতির ত্রুটি
আমরা প্রায় সকলেই এই সত্যিটার সঙ্গে পরিচিত যে আমাদের দেহের গঠন থেকে শুরু করে সমস্ত কার্যকারিতার পেছনে রয়েছে নির্দিষ্ট DNA। তাই DNA-র এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই আমাদের কোষের মধ্যেই থাকে DNA-র ত্রুটি মেরামতির যন্ত্রপাতি। কোষীয় কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে যদি DNA-র কোনও ক্ষতি হয় তাহলে কোষের মধ্যে থাকা সেসব যন্ত্রপাতি দ্রুত DNA-র সেই অংশটির মেরামতি করে দেয় এবং এই ঘটনা কোষে প্রায় অবিরাম চলতেই থাকে। কারণ DNA-র প্রতিলিপিকরণের সময় অনিচ্ছাকৃত হওয়া ক্ষতি, কোষের মধ্যে তৈরি হওয়া ROS (Reactive Oxygen Species) অর্থাৎ সুপার অক্সাইড, পারক্সাইড ইত্যাদি খুব দ্রুত DNA-র সজ্জাক্রমের পরিবর্তন ঘটায় ফলে DNA তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে আর এই অস্বাভাবিকতাকে রুখতেই DNA-র ত্রুটি মেরামতির যন্ত্রপাতি কাজ করে এর স্বাভাবিক ক্রিয়াশীলতা বজার রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু মুশকিল হল এইসব তীব্র জারকের বিরুদ্ধে কাজ করতে করতে অনেক সময় DNA-র ত্রুটি মেরামতির যন্ত্রপাতিও নিজের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন কোষে এই ত্রুটিপূর্ণ DNA-র আধিক্য বাড়তে থাকে। ফলস্বরূপ কোষও তার কার্যকারিতা হারায় ও ধীরে ধীরে কোষ বার্ধক্য দশায় প্রবেশ করে। এভাবেই DNA-র ত্রুটি মেরামতির যন্ত্রপাতির ত্রুটিজনিত কারণে এক এক করে দেহের বিভিন্ন কোষগুলি বার্ধক্যের শিকার হয়। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, সেটি হল কৃত্রিম ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, যথেচ্ছ ধূমপান ইত্যাদি দেহকোষে এই ROS পরিমাণ বৃদ্ধি করার পেছনে বহুলাংশে দায়ী। এ ছাড়া UV রশ্মি, দূষণ ইত্যাদি তো রয়েছেই।

আরও পড়ুন-ভাঙছে বিজেপি, দুজনকেই সাসপেন্ড , দলের নেতাকে ভার্চুয়াল আর ট্যুইট বলে কটাক্ষ রীতেশের

টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্যের সংক্ষিপ্তকরণ
যে-কোনও ক্রোমোজোমের শেষ প্রান্তে থাকা অংশটিকে টেলোমিয়ার বলা হয়। এই টেলোমিয়ার অংশটি কিন্তু রিপিটেটিভ কিছু DNA সিকোয়েন্স দ্বারাই তৈরি অর্থাৎ এই অংশে একই DNA সিকোয়েন্সের বারংবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তবে এই টেলোমিয়ার ক্রোমোজোমের শেষপ্রান্তকে যে-কোনও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। সাধারণত DNA প্রতিলিপিকরণের সময় প্রত্যেকবার প্রতিলিপিজনিত ত্রুটির কারণে একটু একটু করে এই টেলোমিয়ার অংশটি বাদ পড়তে থাকে। এভাবে টেলোমিয়ার অংশটি বাদ পড়তে থাকার ফলে ওই নির্দিষ্ট কোষটির DNA তার প্রতিলিপিকরণের ক্ষমতা হারায় ফলে ওই কোষও তার বিভাজন ক্ষমতা হারিয়ে ধীরে ধীরে অ্যাপোপটোসিস পদ্ধতির মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যায় এবং এভাবে কোষের মৃত্যু ঘটার ফলে বার্ধক্যের সূচনা হয়। সাধারণত যে-কোনও সুস্থ স্বাভাবিক কোষ তার জীবনকালে চল্লিশ থেকে ষাট বার বিভাজিত হতে পারে তারপর সে তার বিভাজন ক্ষমতা হারায়। কোষের বিভাজনের এই সীমাবদ্ধতাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে হেফ্লিক লিমিট (Hayflick limit)। ১৯৬১ সালে পেনসিলভেনিয়ার উইস্টার ইন্সটিটিউটের লিওনার্ড হেফ্লিক-এর নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। কোষের এই বার্ধক্যই কিন্তু গোটা একটি জীবকে বার্ধক্য দশার দিকে ধীরে ধীরে ঠেলে দেয়। বার্ধক্যদশায় দেখা-যাওয়া সমস্ত ধরনের অক্ষমতার পেছনে আসল কারণ কিন্তু এগুলোই।

আরও পড়ুন-প্রতিবন্ধী শিল্পীর পাশে পরিত্রাতা বিডিও

মাইটোকনড্রিয়ায় থাকা DNA-র ত্রুটি
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে নিউক্লিয়াস ছাড়াও আমাদের মাইটোকনড্রিয়ার মধ্যেও থাকে DNA। সাধারণত ৩৭টির মতো জিন সমন্বিত এই অঙ্গাণুটি আমাদের কোষের শক্তিঘর হিসেবেই পরিচিতি পেয়ে এসেছে। আমাদের ক্ষেত্রে যদিও এই DNA কোনও প্রকার বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী নয়, কেবল কিছু শামুক শ্রেণির প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই DNA তাদের খোলকের প্যাঁচের দিক নির্ণয়ের জন্য কাজ করে থাকে। কিন্তু সমস্যা হল আমাদের ক্ষেত্রে এর কোনও উপকারিতা না থাকলেও এর যে-কোনও ত্রুটি আমাদের সমগ্র কোষের কার্যকারিতাকে ব্যর্থ করতে যথেষ্ট।
আগেই বলেছি যে এই মাইটোকনড্রিয়া আমাদের কোষের শক্তিঘর হিসেবে কাজ করে আর এই কার্য সম্পাদনের জন্য যে প্রক্রিয়াটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন বা ETC যার মাধ্যমেই আমাদের তথাকথিত শক্তিমুদ্রা ATP বা অ্যাডিনোসিন ট্রাই ফসফেট উৎপন্ন হয় ও কোষের বিভিন্নপ্রকারের ক্রিয়া সম্পাদন করে। এই ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেনের মধ্যে দিয়ে তীব্র জারক ইলেকট্রন যাতায়াত করার সময় ভুলবশত যদি তারা সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয় তা হলেই সেখানে মুক্ত মূলক তৈরি হয় যা তাদের তীব্র জারক ক্রিয়ার দ্বারা অঙ্গাণুটির ক্ষতি করে আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে তার DNA-র। যেহেতু ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেনের মাধ্যমে ATP তৈরি হওয়ার সময় উপজাত হিসেবে অক্সিজেনও তৈরি হয় তাই এই মুক্ত মূলকগুলি সাধারণত সুপার অক্সাইড, পারক্সাইড ইত্যাদি হয়ে থাকে আর এগুলিই হল ROS (Reactive Oxygen Species) যা শুধু মাইটোকনড্রিয়ার নয়, সমগ্র কোষের তথা নিউক্লিয়াসে থাকা DNA-রও ক্ষতিসাধন করে। মাইটোকনড্রিয়াকে শক্তিঘর-এর পাশাপাশি ROS উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও দেখা হয়ে থাকে। সাধারণত একটি কোষে ১০০টিরও বেশি মাইটোকনড্রিয়া থাকে। তাই এখানে সৃষ্ট ROS সমগ্র কোষের ক্ষতিসাধনে সমর্থ। এই ROS –এর ফলে মাইটোকনড্রিয়ার DNA-র সজ্জাক্রমের পরিবর্তন ঘটে সেখানে মিউটেশন দেখা যায়, ফলে ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেন-এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন সংশ্লেষণে সে ব্যর্থ হয়, ফলস্বরূপ ATP উৎপাদন ব্যাহত হয় আর তার পাশাপাশি সমগ্র কোষের ক্রিয়াও শক্তির অভাবে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই-ই নয়, বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগ যেমন, অ্যালজাইমার, পারকিনসন প্রভৃতি রোগের কারণও এই মুক্ত মূলক। ১৯৫৬ সালে হারম্যান, বার্ধক্যের অন্যতম কারণ হিসেবে মুক্ত মূলকের এই তত্ত্বটি সবার সামনে তুলে ধরেন।

আরও পড়ুন-প্রতিবন্ধী শিল্পীর পাশে পরিত্রাতা বিডিও

জোয়ান থাকার উপায়
আচ্ছা আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি যে কিছু মানুষ অল্প বয়সেই প্রায় বার্ধক্যদশা যাপন করে আর কিছু মানুষ ৮০ বছর বয়সেও একদম সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত জীবন কাটায়। এর পেছনে কারণ জানতে গেলে সবার আগে আঙুল উঠবে আমাদের জীবনযাত্রার মানের দিকে। নিয়মিত শরীরচর্চার অভাব, প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, অসময়ে ঘুম, খাওয়া ও সর্বোপরি অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন আমাদের অল্প বয়সেই কর্মক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ। একবার ভাবুন তো বিখ্যাত বডিবিল্ডার মনোহর আইচের কথা, যিনি ছোটবেলায় একবার কালাজ্বরে আক্রান্ত হন ফলস্বরূপ তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। পরে কঠিন পরিশ্রম ও নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে তিনি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ জীবনযাপন করেন, তাঁর দেহসৌষ্ঠবও ছিল দেখার মতো। এমনকী তিনি ১০৪ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ মৃত্যুর আগে পর্যন্তও কোনও রোগে ভুগেছিলেন বলেও জানা যায় না। তাই জোয়ান থাকতে গেলে কোনও বাহ্যিক ক্রিম, বোটক্স ইত্যাদির দরকার পড়ে না। শুধু প্রয়োজন পড়ে সঠিক জীবনযাত্রার মানের, যার দ্বারা আমরা ১০০ বছর না হোক অন্তত ৬০ বা ৮০ পর্যন্ত সুস্থ স্বাভাবিক রোগমুক্ত জীবন কাটাতে পারি বা তথাকথিত জোয়ান থাকতে পারি।

Latest article