গঙ্গাসাগরকে জাতীয় মেলা ঘোষণা করা হচ্ছে না কেন?

হরিদ্বার-কুম্ভে (Haridwar) কেউ আপনাকে চণ্ডী পাহাড়ে মা চণ্ডী বা প্রয়াগে বিষ্ণুমন্দির, অক্ষয়বট সন্দর্শনে যেতে ঝুলোঝুলি করবে না। উজ্জয়িনীতে স্নানে গেলেও মহাকাল মন্দিরে যাওয়া, না-যাওয়া আপনার ইচ্ছা। কিন্তু গঙ্গাসাগরে ঐতিহ্যসম্মত নিয়মটাই হল, স্নান সেরে কপিলমুনির মন্দিরে পুজো দিতে যেতে হয়। তাহলে, গঙ্গাসাগর কুম্ভমেলার সমতুল হবে না কেন? প্রশ্ন তুললেন তানিয়া রায়

Must read

কুম্ভমেলা কেন্দ্রের খরচে চললেও গঙ্গাসাগরে কোনও অনুদান দেয় না। মোদি সরকার এক পয়সার বাতাসা দিয়েও সাহায্য করে না। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একটা ব্রিজ তৈরি করার কথা রাজ্য সরকার মোদি সরকারকে বহুবার বলেছে। ব্রিজের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র পিছিয়ে গিয়েছে।
এসবই শুনেছি আমরা। সবই নেতিবাচক, বাংলার জন্য হতাশার ছবি। কিন্তু গত সোমবার কৃষ্ণমেঘে বিদ্যুৎ-রেখা সঞ্চারিত হল। গঙ্গাসাগর মেলাপ্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, “কেন্দ্রীয় সরকার কুম্ভমেলায় কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু গঙ্গাসাগর মেলাতেও কোটি কোটি লোক আসে। কেন্দ্র সরকারের এক মন্ত্রী আমায় কথা দিয়েছিল ব্রিজটি করে দেবে, কিন্তু তা করেনি। গঙ্গাসাগরের জন্য কেন্দ্র যখন কোনও পয়সা দেয় না, তখন ব্রিজও করবে না। তাই ব্রিজ আমাদেরকেই করে নিতে হবে।”
এটুকু বলেই থামেননি জননেত্রী। বলেছেন, “মুড়িগঙ্গার ব্রিজটা আমরা তৈরি করে দেব। সার্ভের কাজ করা হয়েছে। টেন্ডারও ডাকা হয়েছে। রাজ্য সরকার টাকাও তৈরি রেখেছে। এখন ব্রিজটা তৈরি হতে যে ক’দিন সময় লাগবে, সেই ক’দিন অপেক্ষা করতে হবে। এর জন্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। ব্রিজ তৈরিতে সময় লাগবে ২-৩ বছর। অনেক খরচ থাকা সত্ত্বেও এই ব্রিজ তৈরি করতে হবে কারণ এটির প্রয়োজন রয়েছে।”
এই হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন। তিনি জানেন, গঙ্গাসাগর মেলার তাৎপর্য। তিনি বোঝেন মুড়িগঙ্গার ওপর সেতু নির্মাণের গুরুত্ব। তাই, তাঁর ঘোষিত প্রকল্পের সৌজন্যে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়তে চলেছে সাগরদ্বীপ। রাজ্য সরকারের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করে মুড়িগঙ্গায় সেতু তৈরি হলে সরাসরি সাগরে পৌঁছতে পারবেন তীর্থযাত্রীরা। পাশাপাশি সাগরের বাসিন্দারাও অনেক দ্রুত মূল ভূখণ্ডে পৌঁছতে পারবেন।

আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টে পিছিয়ে গেল তিন গুরুত্বপূর্ণ মামলা

পর্যটন, সংস্কৃতি বা কোনও বিশেষ জাতির ঐতিহ্যের মতো বিষয়কে তুলে ধরলে সেই মেলাকে পর্যটন, তথ্য সংস্কৃতি বা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর সরকারিভাবে মান্যতা দেয়। এটাই নিয়ম। কুম্ভমেলা যেখানে প্রতি চার বছর অন্তর হয়, সেখানে প্রতি বছর মকরসংক্রান্তিতে সাগরমেলা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী প্রতি বছর সাগরমেলায় যান। গত বছরই পুণ্যার্থীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ বছর সেই সংখ্যাটা আরও বাড়বে। এই বিচারে কুম্ভমেলার থেকেও বড় এই গঙ্গাসাগর মেলা। সারা দেশ থেকে আসা পুণ্যার্থীদের জন্য কেন্দ্রের মোদি সরকার এই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না।
কিন্তু সেকথা শুনবে কে? কে তাদের বোঝাবে, তীর্থ মানেই জলের পাশে থাকা ভূমি? কে তাদের শেখাবে, যে জায়গা দিয়ে আমি এ-পার থেকে অন্য পারে, এই তুচ্ছ, নশ্বরজীবন থেকে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য পুণ্যজীবনে পৌঁছব, সেটাই তীর্থ।
হিন্দুধর্মে বৈষ্ণব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য অজস্র সম্প্রদায় আছে, প্রত্যেকের উপাস্য এবং মন্দির ভিন্ন। কিন্তু এই ধর্মই আবার বিশ্বাস করে, দেবালয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্নান এবং দানেও সমান পুণ্য। একই তীর্থে ব্রাহ্মণ থেকে অন্ত্যজ সকলেই পুণ্যলগ্নে স্নান করে ইষ্টদেবতার আশীর্বাদ লাভ করতে পারে। তাই কুম্ভমেলায় হরিদ্বারে গঙ্গায়, প্রয়াগে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমে, উজ্জয়িনীতে শিপ্রা নদীতে, নাসিকে গোদাবরী নদীতে স্নান করতে হয়। গঙ্গা থেকে গোদাবরী— সব নদীই যে সাগরে মেশে, প্রাচীন কাল থেকে লোকে জানে। যা স্বাভাবিক, তা নিয়ে আর ধানাইপানাই কেন? সুতরাং, সেই যুক্তিতেই গঙ্গাসাগর তীর্থ। মহাতীর্থ। সেখানে স্নানটাই সব। স্নান ছাড়া দেবদেবী সবই তুচ্ছ। হরিদ্বার কুম্ভে কেউ আপনাকে চণ্ডী পাহাড়ে মা চণ্ডী বা প্রয়াগে বিষ্ণুমন্দির, অক্ষয়বট সন্দর্শনে যেতে ঝুলোঝুলি করবে না। উজ্জয়িনীতে স্নানে গেলেও মহাকাল মন্দিরে যাওয়া, না-যাওয়া আপনার ইচ্ছা। কিন্তু গঙ্গাসাগরে ঐতিহ্যসম্মত নিয়মটাই হল, স্নান সেরে কপিলমুনির মন্দিরে পুজো দিতে যেতে হয়। তাহলে, গঙ্গাসাগর কুম্ভমেলার সমতুল হবে না কেন? কোন যুক্তিতে?

আরও পড়ুন-প্রদীপ ভট্টাচার্য ঠিক বলেছেন, মন্তব্য নেত্রীর

এটা ঠিক, হিন্দু শাস্ত্রে, হিন্দু আচারে চারটি কুম্ভ-শহর সমান মর্যাদা পায়নি। নাসিক এবং উজ্জয়িনীর কুম্ভকে বলা হয়, সিংহস্থ। সূর্য কুম্ভ রাশিতে ঢুকলে নয়, সিংহ রাশিতে ঢুকলে ওই স্নান। মুখ্যত বর্ষাকালে হয় বলে সাধুরা এই দুই মেলাকে অনেক সময় ‘পচা কুম্ভ’ও বলেন। কেন্দ্রের অর্থসাহায্যও সব মেলায় নয় সমান। প্রয়াগ-কুম্ভে অর্থসাহায্যের পরিমাণ সিংহস্থ মেলার চেয়ে অনেক বেশি। কারণটা সহজ। হরিদ্বার, উজ্জয়িনী, নাসিক তিন জায়গাতেই শহর আছে। লোকের ভিড় সামাল দিতে মেলা সেই শহরের পরিকাঠামো ব্যবহার করতে পারে। প্রয়াগে সেসব কিছু নেই। নদীর ধারের ধু-ধু বালুচরে গড়ে তুলতে হয় বিদ্যুৎসজ্জিত তাঁবুনগরী। সেখানে থানা, হাসপাতাল, দমকল থেকে পয়ঃপ্রণালী, পানীয় জল— সবই মজুত। মেলা শেষে নগরীর মৃত্যু, ফের বালুচর। কুম্ভে শাহি স্নান বলে কয়েকটি তিথি থাকে। সেসব দিনে প্রশাসন তটস্থ, আখড়াগুলির শাহি স্নান যে! মহানির্বাণী, জুনা, নিরঞ্জনীর মতো শৈব এবং রামানন্দী, নির্মোহীর মতো বৈষ্ণব আখড়া আসবে স্নানে। এই শৈব-বৈষ্ণব আখড়াগুলির মধ্যে একদা প্রায় অহি-নকুল সম্পর্ক ছিল। এখনও কুম্ভে এই শৈব আর বৈষ্ণব আখড়াগুলির মধ্যে বেশ ব্যবধান রাখা হয়।

আরও পড়ুন-গেরুয়া মধ্যপ্রদেশে সরকারি হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারকে ধর্ষণ, চুপ কেন বিজেপি?

গঙ্গাসাগরে এরকম ভেদভাবনা নেই। কে আগে স্নান করবে, তা নিয়ে আখড়া পরিষদের সভায় যেরকম ধুন্ধুমার বাধে, তেমনটা সাগরমেলায় নেই। হরিদ্বার-কুম্ভে মকরসংক্রান্তিতে শাহি স্নান থাকে। আর গঙ্গাসাগরে মকরসংক্রান্তির স্নানটিই সব। তাহলে গঙ্গাসাগর কুম্ভের চেয়ে ন্যূন হবে কোন যুক্তিতে?
সাগরে কপিলমুনির মোহন্তরা বৈষ্ণবরামানন্দী আখড়ার। এই রামানন্দী আখড়ার সদর দফতর অযোধ্যায়। তাই, গঙ্গাসাগরে তীর্থযাত্রীদের দেওয়া প্রণামী, দানের সবটুকুই তাঁরা এতদিন অযোধ্যার সদর দফতরে পাঠিয়ে দিতেন। এবার মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে তাঁরা সেটা আর করবেন না বলে জানিয়েছেন। মুড়িগঙ্গার অতলে তলিয়ে যাওয়া লোহাচরা, ক্রমশ সলিলসমাধিতে চলে যাওয়া ঘোড়ামারা বা খোদ সাগরদ্বীপের অনেক উপকার হবে তাতে। সন্দেহ নেই।

Latest article