কেন হয় ইস্কেমিক স্ট্রোক?

সদ্যপ্রয়াত অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মার শেষ অবস্থায় তাঁর মস্তিষ্কের চিকিৎসায় খুব অল্প সময়ের জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন কনসালটেন্ট নিউরো সার্জন ডাঃ অমিত ঘোষ। ক্যানসার সারভাইভার ছিলেন ঐন্দ্রিলা। তারপর হঠাৎই একদিন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং মারণ ইস্কেমিক স্ট্রোক। একধাক্কায় সব শেষ। কেন হল তাঁর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ এবং স্ট্রোক? ক্যানসার ছাড়া আর কী কী কারণে হয় ইস্কেমিক স্ট্রোক? এর চিকিৎসাই বা কী, জানালেন তিনি। শুনলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

হেমাটোমা
ব্রেন হেমারেজ বা মস্তিষ্কের একধরনের রক্তক্ষরণকে বলা হয় হেমাটোমা। দুরারোগ্য অস্থিমজ্জার ক্যানসার ইউয়িং সারকোমা একধরনের মেটাস্টাসিস ক্যানসার অর্থাৎ যা প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হলে পরবর্তীকালে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। ঐন্দ্রিলার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল। প্রথম এবং দ্বিতীয়বার সুস্থ হবার পর ক্যানসার কোষ নতুন করে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে গিয়েছিল যা বোঝা যায়নি। একদিন হঠাৎ মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তাঁর শরীর নিস্তেজ হতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। স্ক্যান করে দেখা যায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। এই ব্রেন হেমারেজিক ব্লাড ক্লটকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয় হেমাটোমা। সেই মুহূর্তে সময় নষ্ট না করে সার্জারি করে ওই জমাট রক্তকে সরিয়ে ফেলে মেডিক্যাল টিম। চিকিৎসার পরিভাষায় একে বলা হয় ডিকমপ্রেসিভ ক্রেনিওটমি। অর্থাৎ কমপ্রেশনটাকে সরিয়ে দেওয়া। এটি একটি লাইফ সেভিং সার্জারি যেটা না করলে সেইদিনই হয়তো ওঁর জীবন শেষ হয়ে যেতে পারত।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-মিছিল

ব্রেন মেটাস্টেসিস
এরপর ওই হেমাটোমার আশপাশের ব্রেন টিস্যুগুলোকে বায়োপসি করা হয় এবং তার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এর থেকে যেটা বোঝা যায় ‘ইউয়িং সারকোমা’ ক্যানসার কোষ প্রথমে যেটা হাড়ে ছিল সেটাই দ্বিতীয়বার ফুসফুস এবং তৃতীয়বার মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছয়। দীর্ঘদিন সেখানে জমা হতে থাকে এবং টিউমারের আকার নেয়। তারপর হঠাৎ একদিন সেই টিউমার ফেটে যায়— যাকে বলা হয় টিউমার ব্লিড। এই গোটা বিষয়টি এক কথায় হল ব্রেন মেটাস্টেসিস বা স্থানান্তরকরণ। অর্থাৎ রক্তক্ষরণের মাধ্যমে ধরা পড়ল দুরারোগ্য ক্যানসারটি তাঁর মস্তিষ্কে স্থানান্তরিত হয়েছে। এই সার্জারিতে কিছুদিন ভাল থাকলেও আবার অবস্থা খারাপ হতে থাকে, যার কারণ ম্যাসিভ ইস্কেমিক স্ট্রোক।

আরও পড়ুন-ধস রুখতে পাহাড়ে বিশেষজ্ঞদল

ইস্কেমিক স্ট্রোক কী
মানবদেহের যে ধমনির মধ্যে রক্ত চলাচল করে সেই পথটা যখন ব্লক হয়ে যায় এবং মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছতে পারে না তখন হয় ইস্কেমিক স্ট্রোক। এটাকেই সাধারণ মানুষ স্ট্রোক বলে জানে। আমাদের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গর বেঁচে থাকবার জন্য দরকার খাদ্যের যা সরবরাহ করে রক্ত। সেই রক্ত চলাচল কোনও কারণে বন্ধ হলে নির্দিষ্ট অঙ্গগুলো খাদ্য পায় না। ইস্কেমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছতে পারে না এবং মস্তিষ্কের একটা বড় অংশ অচল হয়ে যায়।
ক্যানসারের ক্ষেত্রে ইস্কেমিক স্ট্রোক
ক্যানসারের ক্ষেত্রে এই স্ট্রোকের কারণ ক্যানসার কোষ মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনি, নালিগুলোকে ব্লক এবং ড্যামেজ করে দেয়। ঐন্দ্রিলার ক্ষেত্রে এই স্ট্রোক এতটাই ম্যাসিভ ছিল যার ফলে মস্তিষ্কের সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। সেই অবস্থায় আর কোনও চিকিৎসাই সফল হওয়া সম্ভব ছিল না। চোখে দেখা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ইস্কেমিক স্ট্রোকের ফলে তাঁর মস্তিষ্কের নার্ভসেলগুলো সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে তাঁর ব্রেন-ডেথ হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরোটাই কৃত্রিমভাবে চালিয়ে রাখা হচ্ছিল। ওষুধের মাধ্যমে ব্লাডপ্রেশার উঠিয়ে রাখারও চেষ্টা চলেছিল নিরন্তর। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এই অবস্থায় হার্ট বেশিদিন সচল থাকতে পারে না। কারণ মস্তিষ্কই আমাদের হৃদযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্ক অচল হলে একটা সময় হার্টও তার কাজ বন্ধ করে দেয়। সেই মুহূর্তে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। যেটা ঐন্দ্রিলার হয়েছিল।

আরও পড়ুন-দুর্গাপুরে বর্জ্য থেকে জৈব সার

ইস্কেমিক স্ট্রোকের নানা কারণ
ক্যানসারের কারণে ইস্কেমিক স্ট্রোক খুব রেয়ার একটি ঘটনা। কিন্তু এই স্ট্রোকের প্রধান কারণ হাই ব্লাডপ্রেশার, ব্লাডশুগার, হাই কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, অতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান, ওবেসিটি, স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি ইত্যাদি। বলা যেতে পারে সত্তর থেকে আশি শতাংশ ইস্কেমিক স্ট্রোক উপরিউক্ত কারণেই হয় যেখানে ক্যানসারের কারণে হয় মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ। এই রোগগুলি হলে বা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করলে আমাদের ধমনিগুলোয় তার প্রলেপ পড়তে শুরু করে এবং তাদের ডায়ামিটার কমতে শুরু করে, ধীরে ধীরে সরু হতে হতে একদম বন্ধ হয়ে যায় যাকে বলে সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস। এই থ্রম্বোসিস থেকেও এই স্ট্রোক হতে পারে। তবে এটা খুব ধীরগতিতে হয়। কিন্তু হঠাৎ যে স্ট্রোক হয় তাকে বলা হয় ‘এমবলিজম’। পায়ে অথবা হার্টে একটা ব্লাড ক্লট ফরমেশন হয় যাকে বলে ‘ভেজিটেশন’। এটা বিভিন্ন রোগের কারণেই হতে পারে এবং সেই জমাট রক্ত মস্তিষ্কে গিয়ে কোনও এক বা একাধিক নালিকে ব্লক করে দেয়। এই ক্ষেত্রেই রোগী অনেক সময় হাসপাতালে যাওয়ার সময়টুকুও পান না তার আগেই মৃত্যু হয়। সর্বাধিক স্ট্রোকের কারণ হল এই থ্রম্বোসিস বা এমবলিজম।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জায়গা বাছাইয়ের কাজ শুরু, গঙ্গারতির প্রাথমিক রূপরেখা পুরসভার

ইস্কেমিক স্ট্রোকের সতর্কতা
এই স্ট্রোকে দুটো রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে। যদি বংশগত কারণে হয় তাহলে সেক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না যাকে বলা হয় ননমডিফায়েবল রিস্ক ফ্যাক্টর। দ্বিতীয়ত, মডিফায়েবল রিস্ক ফ্যাক্টর যেমন হাই ব্লাডপ্রেশার, হাই ব্লাডশুগার, কোলেস্টেরল, ওবেসিটি, ধূমপান, মদ্যপান ইত্যাদি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করলে স্ট্রোক এড়ানো সম্ভব। কিন্তু ভয়ের যেটা তা হল, আমরা চট করে বুঝতে পারি না যে আমাদের প্রেশার আছে বা শুগার হয়েছে, তখন বুঝতে পারি যখন হঠাৎ স্ট্রোক হয়। কাজেই চল্লিশের পর নিয়মিত রুটিন চেক-আপ জরুরি। বংশে স্ট্রোক থাকলে কুড়ির পর থেকেই ৬ মাস অন্তর চেক-আপ করাতে হবে। এর সঙ্গে খাওয়াদাওয়া এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, মেদ কমিয়ে ফেলা। নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে হবে।

আরও পড়ুন-অবহেলায় ডাক্তারি ছাত্রের মৃত্যু, বিক্ষোভ সহপাঠীদের

গোল্ডেন আওয়ার
ইস্কেমিক স্ট্রোক হওয়ার পরবর্তী তিন ঘণ্টা হল গোল্ডেন আওয়ার। এই সময়ের মধ্যে রোগীকে নিয়ে যদি হাসপাতালে পৌঁছনো যায় তবে সে প্রাণে বেঁচে সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারে। যদি তিন ঘণ্টা পেরিয়ে যায় তবে রোগী হয়তো বেঁচে গেল কিন্তু অনেক ধরনের জটিল শারীরিক কমপ্লিকেশন নিয়ে ফেরে।
স্ট্রোক হলে বুঝবেন কীভাবে
হঠাৎ ডানদিক বা বাঁদিক দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া বা কথা বলতে না পারা। চোখে দেখতে না পাওয়া। এইরকম অনুভূতি হলে সঙ্গে সঙ্গে এক মুহূর্ত দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই করতে হবে। দেখতে হবে কী ধরনের স্ট্রোক, কতটা ব্রেন ইনভলভ হয়েছে— তারপর চিকিৎসা শুরু করা যাবে।
পরিশেষ বলা যায়, অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মার ক্যানসারটি খুব রেয়ার এবং তাঁর ইস্কেমিক স্ট্রোক হওয়াটাও খুবই রেয়ার। এর ফলেই তাঁর মস্তিষ্কের অবস্থা এতটাই ইরিভার্সেবল স্টেজে চলে গিয়েছিল যে যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব ছিল না।

Latest article