এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে এত আপত্তি, এত হইচই, এত বিরোধের কোনও কারণ থাকত না, যদি এটা সময় নিয়ে নিয়ম মেনে হত।
সেটা তো হয়নি। এবার এসআইআরের পুরো খেলাটাই শুরু হয়েছে বাংলার জন্য। এই এসআইআর-এর প্রধান অ্যাজেন্ডা হল, পশ্চিমবঙ্গে বিপুল সংখ্যায় তৃণমূলের ভোট কাটা। মূল টার্গেট অবশ্যই সংখ্যালঘু শ্রেণি। কারণ, তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকদের একটা বড় অংশই মুসলিম। আর সবথেকে বড়ো কথা, রাজ্যটা সীমান্তবর্তী। সেই সুযোগটাই নেওয়া হচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা, আপত্তির কথা, এই খেলায় নির্বাচন কমিশন তো আর আম্পায়ারের ভূমিকায় নেই! তারা সরাসরি মাঠে নেমে পড়েছে। আর সেটা কাজেকর্মে প্রকাশও পাচ্ছে।
আরও পড়ুন-ঘৃণাভাষণের সব ঘটনার নজরদারি সম্ভব নয়, জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট
দেখুন, কাঁথির গদ্দার কুলের পোদ্দার লোডশেডিং বিধায়ক, অশান্তি কুঞ্জের মেজো খোকা বার বার হুমকি দিচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর পুরোদস্তুর ব্যবহার হবে আসন্ন ভোটে। তাতে আপত্তির কিছু নেই, ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। কারণ, এ-রাজ্যে ভোট আগেও এভাবে হয়েছে। হয়তো এবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা আলাদা হবে। টার্গেটেড ভোটারদের জন্য নামানো হবে আধাসেনাকে। একদিকে তারা বিজেপির কোর ভোট ব্যাংককে আশ্বস্ত করবে, আর অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থক ভোটারদের চাপে রাখবে। তাতে আপত্তির তেমন কিছু ছিল না। বলাই যেত, করুক না, দেখা যাক কী হয়! কিন্তু সেটা অত হালকাভাবে এবার বলা যাচ্ছে না। কারণ, এই এসআইআর। নিঃশব্দ ঘাতকের ভূমিকায় তার পদসঞ্চার।
দেখুন, অনুপ্রবেশকারী বা ভুয়ো ভোটার যদি পশ্চিমবঙ্গে থাকে, তাহলে তাদের নাম বাদ যাওয়ায় আপত্তি করা উচিত নয়। কারণটা খুব সহজবোধ্য। তারা যোগ্য ভোটার তথা নাগরিকদের অধিকারে অনধিকার হস্তক্ষেপ করছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সরকারি প্রকল্প, পরিষেবা, মজুরি, সবেতেই ভাগ বসাচ্ছে। এই অংশটা কমে গেলে প্রকৃত নাগরিকদের তো বটেই, সরকারেরও সুবিধা, এমন ভাবাটাও অমূলক নয়। কারও মনে হতেই পারে, এবং সেই মনে হওয়াটা সঙ্গত, সেক্ষেত্রে পরিষেবা আরও ভালভাবে দেওয়া ও পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু এই এসআইআর তো সেই লক্ষ্যে কাজ করছে না। এবার যেটা করা হচ্ছে, সেটা কারচুপির বন্দোবস্ত।
আর সেজন্যই কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই, অজস্র ত্রুটিতে আমল না দিয়ে, দু- আড়াই বছরের কাজ দু-মাসে শেষ করার ফরমান জারি করা হয়েছে। অমানবিক, অপরিকল্পিত অরাজক উদ্যোগ, যা শেষ বিচারে নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা নষ্ট করছে, তার পবিত্রতা বিপন্ন করছে।
এ-জন্যই রাজ্য জুড়ে এমন বহু ইনিউমারেশন ফর্ম বিএলও অ্যাপ মারফত অনায়াসে আপলোড হয়ে যাচ্ছে যাতে শুধু পদবি দিলেও লিঙ্ক হয়ে যাচ্ছে ফর্ম। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রকৃত ভোটার কি না, তা কোনওভাবেই চিনতে পারছে না বিএলও অ্যাপ। আর তাই এসআইআরের স্বচ্ছতা নিয়ে তৈরি হচ্ছে উদ্বেগ।
ফর্ম স্ক্যান করে আপলোডের পর এখন অ্যাপে শুধুমাত্র দু’টি অপশনে কাজ করতে পারছেন বিএলওরা। প্রথম, যাঁদের ২০০২ সালের কোনও তথ্য দেওয়া নেই, তাঁদের জন্য একটি ট্যাব। আর দ্বিতীয় ট্যাবটি হল, যাঁদের ২০০২ সালের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে, তাঁদের তথ্য ‘ইনপুট’ করে ডিজিটাইজেশন সম্পূর্ণ করা। এই দ্বিতীয় অপশনে কাজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, কোনও ফর্মে উল্লেখ করা ২০০২ সালের বিধানসভা ক্ষেত্র, অংশ নম্বর এবং ক্রমিক সংখ্যা মিলে গেলেই সেই ফর্মের ক্ষেত্রে আর কোনও তথ্য প্রয়োজন হচ্ছে না। ফর্মে উল্লেখ করা সংশ্লিষ্ট ভোটারের সমস্ত তথ্য সহজেই উঠে যাচ্ছে অ্যাপে। এখানেই তৈরি হয়েছে ধন্দ। কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সঠিক তথ্য দিয়ে ফর্ম পূরণ করেছেন কি না, অ্যাপ মারফত তা যাচাইয়ের কোনও সুযোগ নেই।
আরও পড়ুন-এসআইআর ও বাংলার প্রতি বঞ্চনা, মোদি সরকারকে সংসদে তুলোধোনা করবে তৃণমূল
অর্থাৎ যদি দেখা যায়, কোনও ভোটারের নাম ২০০২ সালের তালিকায় নেই, অথচ তিনি ইনিউমারেশন ফর্ম পূরণের সময় ওই বছরের ভোটার তালিকায় থাকা কোনও ব্যক্তির বিধানসভা ক্ষেত্র, অংশ নম্বর ও ক্রমিক সংখ্যা লিখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আত্মীয় হিসাবে উল্লেখ করেছেন, তাহলেই আপলোডে সমস্যা থাকছে না। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আত্মীয় হিসেবে সঠিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন কি না, অ্যাপে তা যাচাইয়ের উপায় নেই। মানেটা হল, তিনি প্রকৃত ভোটার কি না, অ্যাপ মারফত চিহ্নিত করার কোনও ব্যবস্থাই নেই!
এজন্য ম্যাপিংই দায়ী (বর্তমান তালিকার সঙ্গে ২০০২ সালের ভোটার তালিকার তথ্য যাচাই)। কারণ কোনও ভোটারের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় থাকলে তাঁর ম্যাপিং সম্পন্ন করে অ্যাপে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাই ম্যাপিংয়ে থেকে যাওয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যে কেউ আত্মীয় দেখিয়ে দিয়ে ফর্ম পূরণ করলে, অ্যাপ সেটাই গ্রহণ করছে। এক্ষেত্রে অ্যাপ শুধু ম্যাপিং অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ভোটারের বিধানসভা ক্ষেত্র, অংশ নম্বর ও ক্রমিক সংখ্যা চিহ্নিত করছে এবং ইনিউমারেশন ফর্ম লিঙ্ক করতে সাহায্য করছে।
এভাবে তৈরি হওয়া ভোটার তালিকার সঙ্গে ইনিউমারেশন ফর্মে উল্লিখিত নামধাম নিখুঁতভাবে মিলবে না। বিপুল সংখ্যক ভোটার এর শিকার হতে পারেন। এরকম ভোটারদের দু’মাসে নিজেকে স্বচ্ছ ভোটার প্রমাণ করতে হবে। মাস দুয়েকের মধ্যে তাঁরা ‘সঠিক জায়গায়’ যোগাযোগ করবেন, নথি গুছাবেন, হিয়ারিংয়ে যাবেন, ডকুমেন্ট দেবেন এবং অপেক্ষা করবেন চূড়ান্ত তালিকার জন্য! সম্ভব?
যে-বৃদ্ধা একাকী কোনওমতে জীবনটা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, বা যে চাষির ফসল কাটতে গিয়ে ক্যালেন্ডার দেখার ফুরসত নেই, তাঁরা কি খোঁজখবর করে এবং নথি গুছিয়ে নির্বাচনী আধিকারিকের দফতরে যাওয়ার মতো মানসিকতা রাখেন? এই সংখ্যাটা কিন্তু নেহাত কম নয়। আর যাঁরা নথি দাখিল করবেন, তাঁদেরও সবার ঠিক ওই সময়ের মধ্যে সবকিছু ‘প্রমাণ’ হবে কি না, সেটাও সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়। অনেককেই বলা হবে, আপনি ৬ নম্বর ফর্ম ফিল আপ করুন। অর্থাৎ, নতুন ভোটার হিসেবে আবেদন করুন। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে যদি ভোট ঘোষণা হয়ে যায়, এসআইআরের চূড়ান্ত তালিকা বেরনোর পর দু’মাসও বাকি থাকবে না। অথচ, ভোটের ১০ দিন আগে পর্যন্ত ভোটার তালিকায় নাম তোলার সুযোগ পাবেন তাঁরা। অর্থাৎ, খসড়া তালিকা প্রকাশ থেকে মনোনয়ন শেষ হওয়া পর্যন্ত মেরেকেটে তিন মাস। কত মানুষের পক্ষে ওই সুযোগ নেওয়া সম্ভব হবে? যদি ভোটার তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, মৃত, স্থানান্তরিত এবং ‘ভুয়ো’ মিলিয়ে ৬০ লক্ষ নাম রাজ্য থেকে বাদ গিয়েছে, তাহলেও তার কেন্দ্রওয়াড়ি গড় ছাপিয়ে যাবে ২০ হাজার। টার্গেট করে ভোটার বাদ দেওয়া হলে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরাই বাদ পড়বেন, সে আশঙ্কা প্রবল। আর, আপত্তিটা সেখানেই। ওইটাই নাকি এসআইআরের খেলা।
আরও পড়ুন-নাবালিকাকে যৌন নির্যাতন প্রধান শিক্ষকের, স্কুল ক্যাম্পাসেই আত্মহত্যা করল নবম শ্রেণির পড়ুয়া
এসআইআর-আতঙ্কে আর কত হাজার ভোটার বা বিএলও মরলে তবে এ-খেলায় বিজেপি জিততে পারবে? আর কত মানুষ আতঙ্কে ভিটে ছাড়লে বিজেপি শান্ত হবে? উত্তরটা জানতে চাই। সেই সঙ্গে, স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, খসড়া তালিকা প্রকাশের পরে অবস্থা ভয়াবহ হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মাঠে নেমে মানুষকে সাহায্য করবে। মূলত নথি পেতে যাতে সাধারণ মানুষের কোনও সমস্যা না হয়, সেটাই নিশ্চিত করবে মা-মাটি-মানুষের সরকার।
বাংলা কিন্তু বিহার নয়।

