ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫, যা ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনের ব্যাপক সংশোধন এবং ১৯২৩ সালের মুসলমান ওয়াকফ আইন বাতিলের লক্ষ্য নিয়ে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট লোকসভায় উত্থাপিত হয় এবং ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল পাশ হয়। সরকার দাবি করে যে এটি ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনবে। এই বিল ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের উপর আঘাত হানে। এটি অমুসলিম সদস্যদের ওয়াকফ বোর্ডে নিয়োগ, সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, এবং ইসলামী শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিক বিধানের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। এর অবৈধতা ও অসাংবিধানিকতার বিশ্লেষণ দেওয়া হল —
১. সাংবিধানিক লঙ্ঘন
ক. ধর্মীয় স্বাধীনতার লঙ্ঘন (অনুচ্ছেদ ২৫ ও ২৬)
সমস্যা: * ধারা ৩এ: এই ধারায় বলা হয়েছে যে ওয়াকফ তৈরির জন্য একজন ব্যক্তিকে কমপক্ষে ৫ বছর ধরে ইসলাম অনুসরণ করতে হবে। এটি ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫-এর অধীনে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। ধর্মীয় বিশ্বাসের সময়কাল নির্ধারণ করা একটি ব্যক্তিগত ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ। * ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য : বিলটি ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের বাধ্যতামূলক নিয়োগের বিধান করে (পরবর্তী ধারায় উল্লিখিত), যা মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৬) লঙ্ঘন করে। ওয়াকফ সম্পত্তি ধর্মীয় ও দাতব্য কাজের জন্য নিবেদিত এবং এর পরিচালনায় অমুসলিমদের হস্তক্ষেপ ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে যায়। * কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ : ধারা ৩বি-তে ওয়াকফ সম্পত্তির বিবরণ কেন্দ্রীয় পোর্টালে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি ওয়াকফ বোর্ডের স্বাধীনতা হ্রাস করে এবং সরকারের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের পথ খুলে দেয়। * আইনি যুক্তি : সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তাদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার স্বাধীনতা দেয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে (Ratilal Panachand Gandhi vs State of Bombay, 1954) স্পষ্ট করা হয়েছে যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সীমিত হতে হবে। এই বিল এই নীতি লঙ্ঘন করে।
খ. সমতার অধিকার লঙ্ঘন (অনুচ্ছেদ ১৪)
সমস্যা : * বিলটি শুধুমাত্র মুসলিম ওয়াকফ সম্পত্তির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, যেখানে হিন্দু ট্রাস্ট, শিখ গুরুদ্বারা বা অন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য এমন কোনও বিধান নেই। উদাহরণস্বরূপ, ধারা ৩সি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ওয়াকফ সম্পত্তি দাবি করার বিধান রাখে, কিন্তু অন্য ধর্মীয় সম্পত্তির ক্ষেত্রে এমন কোনও নিয়ম নেই। * আইনি যুক্তি : অনুচ্ছেদ ১৪ সমতার অধিকার নিশ্চিত করে এবং বৈষম্যমূলক আইনকে নিষিদ্ধ করে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে (S.R. Bommai vs Union of India, 1994) বলা হয়েছে যে রাষ্ট্রকে সকল ধর্মের প্রতি সমান আচরণ করতে হবে। এই বিল মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, যা অসাংবিধানিক।
গ. সংখ্যালঘু অধিকার উলঙ্ঘন (অনুচ্ছেদ ২৯ ও ৩০)
সমস্যা : * ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষা, দাতব্য, এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধারা ৩ই-এর মাধ্যমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলের উপজাতি অঞ্চলের জমি ওয়াকফ ঘোষণা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা মুসলিম সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার সীমিত করে। * আইনি যুক্তি : অনুচ্ছেদ ৩০ সংখ্যালঘুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার দেয়। ওয়াকফ সম্পত্তি প্রায়শই মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই বিলের বিধানগুলি সংখ্যালঘু অধিকারে হস্তক্ষেপ করে।
ঘ. ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন
সমস্যা : * বিলটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সম্পত্তির উপর অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, যা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির পরিপন্থী। উদাহরণস্বরূপ, ধারা ৩ডি-তে সুরক্ষিত স্মৃতিসৌধ বা এলাকাকে ওয়াকফ ঘোষণা বাতিল করা হয়েছে, যা শুধুমাত্র মুসলিম সম্পত্তিকে লক্ষ্য করে। * আইনি যুক্তি: সুপ্রিম কোর্ট (Kesavananda Bharati vs State of Kerala, 1973) ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই বিল একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘন করে।
২. আইনগত ত্রুটি
ক. শরিয়ত অ্যাক্ট, ১৯৩৭-এর সাথে সাংঘর্ষ
সমস্যা: * ধারা ৩এ(২)-এ বলা হয়েছে যে waqf-alal-aulad (পরিবারের জন্য ওয়াকফ) উত্তরাধিকারীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারবে না। এটি ইসলামি শরিয়তের বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, যেখানে waqf-alal-aulad বৈধ এবং সাধারণ। এই বিধান মুসলিম পার্সোনাল ল’ (শরিয়ত) অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট, ১৯৩৭-এর লঙ্ঘন করে, যা মুসলিমদের ধর্মীয় আইন অনুসরণের অধিকার দেয়। * আইনি যুক্তি: সুপ্রিম কোর্ট (Shayara Bano vs Union of India, 2017) স্পষ্ট করেছে যে ধর্মীয় আইনের সাথে সাংঘর্ষিক বিধান অসাংবিধানিক হতে পারে। এই ধারা শরিয়তের মৌলিক নীতি লঙ্ঘন করে।
খ. বিচার ব্যবস্থার অধিকার হ্রাস
সমস্যা: * বিলটি ওয়াকফ ট্রাইবুনালের রায়কে চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করার বিধান বাদ দিয়েছে। এটি ওয়াকফ সম্পত্তি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দেয় যা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এছাড়া, ট্রাইবুনাল না থাকলে হাইকোর্টে সরাসরি আপিলের বিধান মানুষের জন্য অপ্রতুল। * আইনি যুক্তি : সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করে। এই বিধান সাশ্রয়ী ও দ্রুত বিচারের অধিকার লঙ্ঘন করে।
গ. সরকারি সম্পত্তি দখলের পথ প্রশস্ত
সমস্যা : * ধারা ৩সি-তে বলা হয়েছে যে সরকারি সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে দাবি করা যাবে না, এমনকী আদালতের রায় থাকলেও। এটি কালেক্টরকে ওয়াকফ সম্পত্তি তদন্ত ও বাতিল করার অসীম ক্ষমতা দেয়, যা বিচারিক প্রক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করে। * আইনি যুক্তি : সুপ্রিম কোর্ট (Indira Nehru Gandhi vs Raj Narain, 1975) স্পষ্ট করেছে যে বিচারিক পর্যালোচনা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। এই ধারা বিচারিক ক্ষমতা হরণ করে।
৩. সামাজিক প্রভাব
ক. মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি
সমস্যা : * ধারা ৪-এ আগাখানি, বোহরা, শিয়া, এবং সুন্নি ওয়াকফের পৃথক সংজ্ঞা প্রবর্তন করা হয়েছে। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিভেদ সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করে। * প্রভাব : এই বিভাজন মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যকে দুর্বল করতে পারে এবং ধর্মীয় সংহতি নষ্ট করতে পারে।
খ. গ্রামীণ ও দরিদ্র মুসলিমদের উপর প্রভাব
সমস্যা : * ধারা ৩বি-তে ওয়াকফ সম্পত্তির বিবরণ কেন্দ্রীয় পোর্টালে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় অনেক ওয়াকফ সম্পত্তি মৌখিক বা অনথিভুক্ত। এই বিধান এই সম্পত্তিগুলিকে অবৈধ ঘোষণার ঝুঁকি তৈরি করে। * প্রভাব : দরিদ্র মুসলিম সম্প্রদায়, যারা ওয়াকফ সম্পত্তির উপর নির্ভরশীল, তাদের জীবিকা ও ধর্মীয় কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়বে।
গ. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ
সমস্যা : * বিলটি কেন্দ্রীয় সরকারকে ওয়াকফ বোর্ড, মোতাওয়াল্লি, এবং সম্পত্তি তদন্তের অসীম ক্ষমতা দেয়। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ওয়াকফ সম্পত্তির অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করে। * প্রভাব: মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।
৪. অবৈধতার কারণ
* অতিরিক্ত আইন প্রণয়ন ক্ষমতা : বিলটি কেন্দ্রীয় সরকারকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়, যা সংবিধানের ফেডারেল কাঠামো লঙ্ঘন করে। ওয়াকফ সম্পত্তি রাজ্য তালিকার বিষয়, এবং কেন্দ্রের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ অনুচ্ছেদ ২৪৬ লঙ্ঘন করে। * বিচারিক পর্যালোচনার অভাব: ধারা ৩সি-এর মতো বিধানগুলি বিচারিক প্রক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করে, যা সংবিধানের ন্যায়বিচারের নীতি লঙ্ঘন করে। * ধর্মীয় বৈষম্য: বিলটি শুধুমাত্র মুসলিম সম্পত্তিকে লক্ষ্য করে, যা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পরিপন্থী।
উপসংহৃতি সন্ধি
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫ ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪, ২৫, ২৬, ২৯, এবং ৩০ লঙ্ঘন করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও ফেডারেল কাঠামোর মতো মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে যায়। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক অধিকার, এবং সম্পত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়। সামাজিকভাবে, এটি বিভেদ সৃষ্টি করে এবং দরিদ্র মুসলিমদের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলে। আইনগতভাবে, এটি শরিয়ত অ্যাক্ট এবং বিচারিক নীতির বিরোধী।
বৃহস্পতিবার অর্থাৎ গতকাল ওয়াকফ সংশোধনী আইন সংক্রান্ত মামলার শুনানি শেষ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের নির্দেশ, পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত ঘোষিত ওয়াকফ সম্পত্তিতে বদল ঘটানো যাবে না। পাশাপাশি শীর্ষ আদালতের নির্দেশ, ওয়াকফ বোর্ড বা পর্ষদেও নিয়োগ করা যাবে না পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত। কেন্দ্রও জানিয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট যে অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিয়েছে, তা তারা মানবে। মামলার পরবর্তী শুনানি ৫ মে।
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫ অসাংবিধানিক ও অবৈধ কেন?
বিষয়টা শীর্ষ আদালতে বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে আইনটির অসাংবিধানিক চরিত্র ও আইনবিরুদ্ধ অস্তিত্ব সামনে এসেছে। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় পুরো বিষয়টাকে বুঝিয়ে দিলেন ডাঃ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদার
