কুণাল ঘোষ: অন্যতম শীর্ষনেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজনীতি নিয়ে ঘরোয়া আলোচনা যখন করতেন, মনে হত, মাস্টারমশাই পড়াতে বসেছেন।
ঢাকুরিয়ার বাড়িতে এমনই এক মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বুঝলি, মমতার তৃণমূল একটা ইনহেরেন্ট কোয়ালিশন। এতরকম লোক নিয়ে ও চলে যে সবক’টা কর্নার কভার হয়ে যায়।”
এই একই কথা তাঁর মুখে শুনেছিলাম তাঁর দিল্লির তালকাটরা রোডের বাড়িতে বসে। জোট সংক্রান্ত আলোচনার সময়। ভারতে জোটযুগ শুরু এবং কোন দলের মধ্যেই জোটের জিন রয়ে গিয়েছে। এখানেও প্রণববাবুর বক্তব্য ছিল, ‘‘দলের সঙ্গে দলের জোট একটা আলাদা কেমিস্ট্রি। কিন্তু মমতার দলটা নিজেই ইনহেরেন্ট কোয়ালিশন। ফলে এর একটা অ্যাডভান্টেজ থাকেই। আমিও যখন দল করতে গিয়েছিলাম এটা পারিনি।’’
আরও পড়ুন-দলেরই নেত্রীকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ, গ্রেফতারি এড়াতে পুজোয় “চুপি চুপি” হাইকোর্টে কৈলাশ
পরে যখনই মমতাদির মুখে ‘মানুষের মহাজোট’ কথাটা শুনি, অভিষেকের মুখেও শুনি প্রতিধ্বনি, তখনই প্রণববাবুর কথাটা মনে পড়ে যায়।
জহুরি জহর চেনেন।
প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে, যখন রবীন্দ্র সরোবরে সবুজ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন প্রথম ‘অগ্নিকন্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তৎকালীন কলকাতা পুরসভার ৩৭ নম্বরের পুরপিতা, বামফ্রন্ট সমর্থক নির্দল জনপ্রতিনিধি প্রবাদপ্রতিম বর্ষীয়ান ডাঃ কে পি ঘোষ। তিনি আন্দোলনে শামিল হন। বামেদের থেকে দূরত্ব বাড়ে। মনোনয়ন আর পাননি। এদিকে তাঁর ‘অগ্নিকন্যা’ বিশেষণ একটি কাগজ ব্যবহার শুরু করে। সেই বিশেষণটিই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে যায়।
বাম সমর্থিত নির্দল পুরপিতা তথা শহরের বিশিষ্ট নাগরিকের হৃদয় উজাড় করে ‘অগ্নিকন্যা’ বিশেষণের আবির্ভাবটিই ছিল ‘মানুষের মহাজোটে’ আদর্শ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনপর্ব।
এই ‘অগ্নিকন্যা’ বিশেষণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিদি, জননেত্রী হয়ে ঘরের মেয়ে বা বাংলার মা-তে এসে দাঁড়িয়েছে। দশকের পর দশক জনসমুদ্র মমতাদির পাশে। এর অন্যতম কারণ ওই মানুষের মহাজোট।
আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলটা তৈরি করেছেন, দলটা প্রতিষ্ঠা করেছেন, দলকে সাফল্য দিয়েছেন, কিন্তু দলসর্বস্ব রাজনীতি করেননি। তাঁর রাজনীতির ধরন, লড়াই এবং ইস্যু বারবার অন্য দলেরও সীমানা চুরমার করে দিয়ে ভালবাসা, সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। মমতাদির ইমেজ উঠে গিয়েছে দলের ঊর্ধ্বে।
অজস্র ঘটনার মধ্যে দু’তিনটে উদাহরণ দিই।
আরও পড়ুন-ইলিশের টু পাঁঠার ঝোল! বাড়িতে পৌঁছবে সরকারি রান্না
মুখ্যমন্ত্রী বীরভূম জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকে যাচ্ছেন। রাস্তার দু’পাশে চাষের মাঠ। দফায় দফায় কৃষকরা দাঁড়িয়ে। এক জায়গায় এক কৃষক হাত তুলে বোঝালেন একটা কাগজ দিতে চান। গাড়ি দাঁড়াল। মুখ্যমন্ত্রী চিরকুট নিলেন। হাত নেড়ে আবার যাওয়া শুরু। শুধু নীরবে পড়ে নিলেন, নিজের কাছেই রাখলেন সেটি। অনেক পরে প্রশাসনিক বৈঠকে, হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘‘ময়ূরেশ্বরের বিডিও কে?’’
বিডিও দাঁড়ালেন।
-‘‘আপনার ওখানে এই নামে সারের দোকান আছে?’’
-‘‘হ্যাঁ ম্যাডাম”
-‘‘ওখান থেকে সার ব্ল্যাক হচ্ছে জানেন না?’’
তারপর যা যা হওয়ার, তাই তাই হল।
পরের ঘটনা দার্জিলিং চা-বাগান।
নেত্রীর গাড়ি উঠছে।
পাশে চা-বাগানে মহিলারা চা তুলছেন।
মমতাদি নেমে গেলেন। মহিলারা মুগ্ধ।
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘‘চা পাতা তোলা শিখিয়ে দাও।’’
খেলাচ্ছলে চা পাতা তোলা হল। তার ফাঁকেই নেত্রীর প্রশ্ন, ‘‘তোমাদের বাড়ি কোথায়? কে কে আছে? তোমাদের রোজগার কেমন? এখানে খাবার পাও? কী কী রোগ হয়? হাসপাতালে ওষুধ আছে? কাছে স্কুল আছে?’’
ওষুধের সমস্যার কথা শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডিএমকে বললেন এখনই ব্যবস্থা নিন।
যদি অনেক আগের কথাও ধরতে হয়, নয়ের দশকের শুরুর কথা ভাবুন। সহকর্মীর স্কুটারে নেত্রী ঢুকে গিয়েছেন জঙ্গলমহলের গ্রামে। তীব্র খাদ্যসঙ্কট। নিজের ‘উপলব্ধি’ বইটিতে লিখেছিলেন সরকার ব্যবস্থা নিক। মানুষ বিদ্রোহ করলে অরাজকতা তৈরি হবে। বামফ্রন্ট সরকার কথা শোনেনি। ওসব জায়গা হয়ে গিয়েছিল মাওবাদীদের আঁতুড়ঘর। পরে খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান দিয়েই এলাকার মুখে হাসি ফোটান নেত্রী।
বিরোধী নেত্রী হিসেবে যা যা সংকট দেখেছেন, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনিই মুশকিল আসান। ফলে বিরুদ্ধমতের মানুষও সঙ্গে চলে এসেছে।
ধরা যাক সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামের জমি বাঁচানোর আন্দোলন।
এটা কি শুধু তৃণমূল সমর্থকদের লড়াই? না। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি, বামফ্রন্ট-সহ সব দলের বেড়া ভেঙে সর্বস্তরের কৃষক ও মানুষ নেত্রীর পাশে। বামেদের ট্র্যাডিশনাল ভোটব্যাঙ্ক চুরমার। এটাই মানুষের মহাজোট। এর উদাহরণ আছে মমতাদির যাত্রাপথের প্রতিটি বাঁকে।
টালির ঘরের ছোট্ট আস্তানা থেকে এক সাধারণ ঘরের মেয়ে যে জীবনবাজি রাখা অসামান্য লড়াইতে দেশের দু’বার রেলমন্ত্রী, তিনবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আরও বড় দায়িত্বের জন্য দেশের মানুষের আশাভরসার কেন্দ্রে, সেই রূপকথার মতো লড়াইটা হৃদয়স্পর্শ করেছে সর্বস্তরের মানুষের। তাই বাংলার বিধানসভা ভোটের ফলের দিকে তাকিয়ে থাকা অন্য রাজ্যগুলি থেকে বন্যার মতো আসে অভিনন্দনবার্তা, মমতাদিকে বিজেপি কুৎসিত চক্রান্তে বিদ্ধ করলে ফাঁসি ওঠে মানুষ। জবাব যায় ভোটে।
এটাই মানুষের মহাজোট।
তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে দেখুন।
সিপিএমের অপশাসনের অবসান ঘটানোর শপথ নিয়ে যখন তৃণমূলের লড়াই, তখন ভোট দিল কারা? তৃণমূল, কংগ্রেস, এসইউসি, বিক্ষুব্ধ সিপিএম, বিক্ষুব্ধ বামফ্রন্ট, বামফ্রন্ট বহির্ভূত বাম, অন্য কিছু দল, বিদ্বজ্জন, নাগরিকসমাজ, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক, পুলিশ, আমলা, ছাত্রযুব, প্রবীণ-সহ সমাজের সবাই, জাতি-ধর্ম-পেশা নির্বিশেষে।
মমতাদি যখন বাংলার জন্য কাজের সুযোগ করে নিয়ে দুই দফায় রেলমন্ত্রী হয়ে একের পর জেলাকে ভরিয়ে দিচ্ছেন রেলে, উচ্ছ্বসিত দলের বেড়া ভাঙা মানুষ।
আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যখন পরের পর স্কিমে পাশে দাঁড়াচ্ছেন পরিবারের সবার, মানুষ আশীর্বাদ করছেন।
আমাকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক আঞ্চলিক স্তরের সরকারি কর্মচারী সিপিএম নেতা বলেছিলেন, ‘‘ব্রিগেডে তো যাই। কিন্তু কিছু হবে না। পাড়ায় জলের সমস্যা ছিল। এখন তিনটি টিউবওয়েল বসে গিয়েছে। বাড়ি অবধি পাকা রাস্তা। মেয়ে কন্যাশ্রী পায়, সাইকেলও পেয়েছে। সুবিধেও হয়েছে অনেক। আরও কিছু কিছু সরকার দিয়েছে। বাড়ির মহিলারা বলে দিয়েছে সব ভোট দিদিকে। বুঝুন। পার্টিটা করার স্পেসটাই তো চলে গেল।’’
এবার আসুন আরেকটি দিকে।
তৃণমূল দল এবং প্রার্থীতালিকা নজর করেছেন?
প্রথম থেকেই মমতাদির সঙ্গে একদিকে যেমন দলের নেতারা, অন্যদিকে বিভিন্ন জগতের বিশিষ্ট মানুষেরা। কৃষ্ণা বসু, ডাঃ রঞ্জিত পাঁজা, বিক্রম সরকারের মতো শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, আমলাদের কথা ভাবুন। এখনও সমান নীতি। অর্থাৎ চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, গায়ক, অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, আমলা, ক্যুইজমাস্টার, নাট্যকার, সাংবাদিক, শিল্পকর্তা, কৃষিবিশেষজ্ঞ, খেলোয়াড়-সহ সমাজের বিভিন্ন শাখার প্রতিনিধিত্ব দলে, জনপ্রতিনিধিত্বে, মন্ত্রিসভায়। তার বাইরেও যে সামাজিক বৃত্ত, সেখানেও নেত্রীর একই মানসিকতা। দলের সংগঠকরা আছেন, থাকবেন। কিন্তু সমাজের সার্বিক প্রতিফলন থাকবে দলে। মহিলাদের অংশগ্রহণ অন্য সব দলের থেকে বেশি। জাতি-ধর্ম-বর্ণে সবার প্রতিনিধিত্ব। বিভিন্ন শাখায় উন্নয়নের পর্ষদ। তবেই তো সকলের অংশগ্রহণের নিশ্চিত প্রতিফলন।
মমতাদি মানুষকে বোঝেন। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও মানুষের মন বোঝার রসায়নটি সময়োপযোগী রসায়নে করায়ত্ত করে ফেলেছে।
ফলে, তৃণমূল কংগ্রেস ‘মানুষের মহাজোট’ শব্দটিকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ব্যবহার করে।
অন্য দলের সঙ্গে জোট বা ফ্রন্ট বা আসন সমঝোতা, এটা তো নির্বাচনী অঙ্ক। শীর্ষনেতৃত্ব যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নেন এবং নেবেন।
কিন্তু যে দলের নিজস্ব শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যেই রয়েছে ‘মানুষের মহাজোট’, তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভিত যে অন্যদের থেকে ঢের বেশি, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।
দলের সর্বভারতীয় সভানেত্রী এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তাই এখনও বিশেষ জোর দিয়ে চলেছেন সর্বস্তরে নিবিড় জনসংযোগ আরও বাড়ানোর জন্য। মানুষের পাশে থাকতে হবে। মানুষকে পরিষেবা দিতে হবে। যাঁরা সমর্থন করেন, তাঁদের আরও কাছে রাখতে হবে। যাঁরা এখনও আমাদের থেকে কোনও কারণে দূরে, তাঁদের মন জয় করে তাঁদের সমর্থনও আগামী দিন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষেই আনতে হবে।
‘মানুষের মহাজোটের’ এই বিরলতম পতাকা নিয়েই তৃণমূল কংগ্রেস
এগিয়ে চলবে।