এক দেশ, এক ভোট তো বুঝলাম কিন্তু আসল ছকটা কী!

'এক দেশ এক ভোট’ নিয়ে মোদি সরকার আর অ-বিজেপি দলগুলোর যুক্তি-পাল্টা যুক্তি চলছেই। ১৮ হাজার পাতার রিপোর্টও নাকি তৈরি করেছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটি। ‘এক দেশ এক ভোট’ আইন প্রণয়ন করা হলে কী কী সুবিধা হতে পারে, কী কী অসুবিধা রয়েছে, সে-সব নিয়ে আলোচনা করছেন মুর্শিদাবাদের ডোমকল গার্লস কলেজের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান প্রিয়ঙ্কর দাস

Must read

২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারেনি, প্রত্যাশামতো আসন সংখ্যাও তাঁরা পায়নি। এছাড়াও বাংলা সহ একাধিক রাজ্যে তাঁদের জয়রথ থমকে গেছে। তাই, সর্বগ্রাসী ক্ষমতা দখলের মানসিকতাযুক্ত বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলকে ভয় ও আশঙ্কা পিছু ছাড়ছে না। নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন সহ নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গোটা ব্যবস্থাতেই তাঁরা আধিপত্য বিস্তার করে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিতে চাইছে। ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ভূতুড়ে ভোটার’ খোঁজার নির্দেশ দেওয়ার পর কীভাবে প্রতিটি জেলা থেকে প্রতিদিন সারি সারি ভূতুড়ে ভোটারের সন্ধান মিলছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথে বাকি বিরোধী দলগুলো লোকসভা ও রাজ্যসভাতে এই বিষয়টিকে নিয়ে সরব হবার পরিকল্পনা করছে।
গত ডিসেম্বরে লোকসভাতে এক দেশ এক ভোট (One nation one election) বিলটি উত্থাপিত হওয়ার পর থেকেই পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ এই বিলকে কেন্দ্র করে সরগরম হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, ২০১৪ সালের পরবর্তী সময় থেকে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই এক দেশ এক ভোট নিয়ে নানা চর্চা কেন উঠে আসছে এবং অবশেষে গত ডিসেম্বরে এই বিলটি পেশ করার প্রকৃত কারণগুলো কী কী?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন যে, ভারতবর্ষের ভোটারদের মানসিকতার এক পরিবর্তন এসেছে। তাঁরা কেন্দ্র, রাজ্য ও স্থানিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ও প্রতিনিয়ত এই প্রত্যেক স্তরের খবর তাঁদের কাছে পরিবেশিত হয়। আমরা লক্ষ্য করছি যে, এই ভোটাররা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ভাবে ভোট দিচ্ছেন, জাতীয় নির্বাচনে একভাবে, রাজ্য নির্বাচনে একভাবে, স্থানীয় নির্বাচনে আরেক রকম ভাবে তাঁরা ভোট দিচ্ছেন। একাধিক সময়ে আমরা দেখেছি যে, লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলেও পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে তাঁরা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখান থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ভোটাররা এখন অনেক স্বকীয় চিন্তার অধিকারী, ভোটারদের এই স্বকীয় চিন্তাকে ভেঙে দিতে চায় বিজেপি।
যদি একসময় একাধিক নির্বাচন করা যায় তাহলে ভোটারদের কয়েক মিনিটের মধ্যে তিন থেকে চারটে ইভিএম-এর বোতাম একই সময় টিপতে হবে তাতে ভাবনাগুলো গুলিয়ে যাবে, স্বকীয় চিন্তা নষ্ট হবে এবং বিজেপি সেটাই চায়। ভোটারদের বাগে আনার এ এক দারুণ কৌশল।
ভারতীয় জনতা পার্টি খুব ভালমতোই জানে যে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে মূলত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে তাঁদের সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তাঁরা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে পারেনি কেন্দ্রে ১০ বছরের অধিক সময় ক্ষমতায় থাকার পরও। এই সাংগঠনিক দুর্বলতাকে তাঁদের পক্ষে রাতারাতি মেরামত করা সম্ভব নয়, তাই এক দেশ এক ভোট কৌশল অবলম্বন করে তাঁরা রাজ্যগুলোতে থাবা বসানোর মরিয়া প্রচেষ্টা করছে।
ভারতবর্ষের প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী কোঠারি একটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করতেন ‘কংগ্রেস ব্যবস্থা’ নামে। এই কংগ্রেস ব্যবস্থা হল ১৯৬৭ সাল অবধি বজায় থাকা সেই ব্যবস্থা যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় জায়গাতেই কংগ্রেসের ক্ষমতা বিদ্যমান। আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয়গুলো তখনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি আঞ্চলিক দলগুলোর উত্থান হয়নি উল্লেখযোগ্যভাবে । ১৯৬৭ সাল অবধি এক দেশ এক ভোট বজায় ছিল। ২০১৪ সালের পর থেকে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সমরূপ দ্বিতীয় আধিপত্যকারী পার্টি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় জায়গাতে বিজেপি আধিপত্য বিস্তার করবে এবং আঞ্চলিক দলের কণ্ঠকে রোধ করবে এবং আঞ্চলিক সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে না। ক্ষমতা দখলের মানসিকতাটাই এখানে মুখ্য।
গোটা ভারতবর্ষকে শোষণ করার অভিপ্রায়ে বিজেপি এতটাই মত্ত যে, এক দেশ এক ভোটের প্রশাসনিক সমস্যা কী কী তৈরি হতে পারে তা তাঁদের চিন্তাতেই নেই। একসাথে ভোট হলেও ভোট প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই শুরু হবে এবং সেই সময় গোটা প্রশাসনিক ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ হয়ে যাবে।
লোকসভা, বিধানসভা ও স্থানীয় পঞ্চায়েত ও পৌরসভার ভোট একসঙ্গে হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ও স্থানীয় প্রশাসকরা একই সঙ্গে অনুপস্থিত থাকবেন। সেই সময়ে আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি কেমন হবে, সেই বিষয়ে বিজেপির কোনও লক্ষ্য নেই। কোনও আলোচনা তাঁরা করেননি। আসলে গোটা বিষয়টাই ক্ষমতা দখলের, আধিপত্যের জন্যে। সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্য ও সৎ ভাবনা থেকে নয়!

আরও পড়ুন: বাংলার মাটি থেকে বিশ্ববাংলায় মু্খ্যমন্ত্রী শোনাবেন লড়াই ও উন্নয়নের কাহিনি

Latest article