আরও একবার। রেল দুর্ঘটনা খবরের শিরোনামে। এবার কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে মালগাড়ি ধাক্কা মেরেছে। ফের কিছু মায়ের কোল খালি হল, স্ত্রীর সিঁথির সিঁদুর মুছল, বাবা সন্তানহারা হলেন, বোন হারাল দাদাকে কিংবা ভাইকে।
আরও পড়ুন-রেল দুর্ঘটনার জের, বাতিল ১৯ ট্রেন
কিন্তু কেন?
লাল সিগন্যাল দেখতে পাননি মালগাড়ির চালক। সেই কারণেই একই লাইনে এসে যায় সেটি। সাধারণত যে লাইনে এক্সপ্রেস ট্রেন চলে, সেই লাইনে মালগাড়ি চালানো হয় না। মালগাড়িকে দাঁড় করিয়ে পাস করানো হয় এক্সপ্রেস। এক্ষেত্রে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনেই ছিল মালগাড়িটি। একই লাইনেই দু’টি ট্রেন পাস করানোর পরিকল্পনা ছিল রেলের। তবে আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে শিয়ালদহের উদ্দেশে রওনা করিয়ে দিয়ে তার পর মালগাড়িকে পাস করানোর কথা। সেই কারণেই মালগাড়িকে লাল সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল।
সম্ভবত মালগাড়ির চালক ওই সিগন্যাল দেখতে পাননি। ফলে একই লাইনে এসে পড়ে মালগাড়িটি। ধাক্কা মারে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে। এক্ষেত্রে আরও একটি প্রশ্ন প্রকাশ্যে আসছে। এখন যে কোনও রেল ইঞ্জিনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকে। ইঞ্জিনের সামনে নির্দিষ্ট কোনও দূরত্বে যদি কোনও ট্রেন বা অন্য কিছু থাকে, তবে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই ওই ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়বে। একে ‘কবচ’ বলা হয়। রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারপার্সন জয়া ভার্মা সিনহা জানিয়েছেন, দিল্লি-গুয়াহাটি লাইনে কবচ সিস্টেম ছিল না। দুর্ঘটনার জন্য মালগাড়ির চালককেই দায়ী করেছে রেল।
আরও পড়ুন-আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুত স্বাস্থ্য দফতর
রেলের তরফে আদিখ্যেতা করে জানানো হয়েছে, চলতি বছরে ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথে কবচ লাগানো হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত দেড় হাজার কিলোমিটার রেলপথে কবচ আছে। যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ-দিল্লি রুটে কবচ লাগানোর ব্যবস্থা হবে বলে জানা গিয়েছে। নতুন কিছু নয়। প্রতিবার রেল দুর্ঘটনার পর এসব কথাই বলে থাকে মোদি প্রশাসন।
আসলে কবচ হল ACD অর্থাৎ অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস, যার মাধ্যমে এক লাইনে দু’টি ট্রেনের সংঘর্ষ এড়ানো যায়। রেডিও কমিউনিকেশন, মাইক্রোপ্রসেসর এবং গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা GPS প্রযুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে ‘কবচ’। তিনটি অংশে বিভক্ত এই যন্ত্রটির প্রধান অংশ অন্য অংশটিকে জানান দেয় সেই লাইনে অন্য কোনও ট্রেন সেই মুহূর্তে আছে কিনা৷ দু’টি ট্রেন একই লাইনে চলে এলে এবং তাদের মধ্যে দূরত্ব কমে এলে ইঞ্জিনে বসানো যন্ত্রের মাধ্যমে সিগন্যাল দিতে থাকে ‘কবচ’। যা চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তিনি।
এর আগে করমণ্ডল রেল দুর্ঘটনার সময়ও এই কবচ-সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন তুলেছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার পরদিন ঘটনাস্থলে গিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও প্রাক্তন রেলমন্ত্রী বলেন, ‘কবজ’ প্রযুক্তি থাকলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। এবারেও যে সেকথা সত্যি, সেটা স্বীকার করে নিয়েছে রেল প্রশাসন।
আরও পড়ুন-দুর্ঘটনায় মৃত্যু রেলকর্মীর, শোকস্তব্ধ বেলেঘাটা
লোকসভায় মোদি সরকারের রেলমন্ত্রী নিজেই জানিয়েছেন, দুর্ঘটনা বৃদ্ধির হার অন্তত তিনগুণ। যাত্রী-সুরক্ষা ও নিরাপত্তার দিকটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে, এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বারবার। কিন্তু কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি, তার প্রমাণ, কবচের অনুপস্থিতি। রেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বলছে, ২৮-২৯ শতাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী রেল। ব্যতিক্রম নয় এবারের দুর্ঘটনাও।
প্রতি বছর রেল বাজেটে পরিকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তার জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ হয়৷ সেইমতো কাজও কিছুটা এগোয়৷ সম্প্রতি বিভিন্ন টার্মিনাল স্টেশনগুলিতে ওয়াইফাই, চলন্ত সিঁড়ি, বয়স্ক ও বিশেষভাবে সক্ষম যাত্রীদের জন্য আলাদা করে বসার জায়গায় ব্যবস্থা হয়েছে৷ রক্ষীবিহীন লেবেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা হয়েছে৷ ট্রেনগুলিরও উন্নতি হয়েছে৷ নতুন কোচ এসেছে৷ এগুলো সবই নিরাপত্তার স্বার্থে হয়েছে বলে দাবি করেছেন মোদি সরকারের রেলমন্ত্রীরা৷
নিরাপত্তা কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে সংশয় ছিল বরাবরই৷ আর সোমবারের দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিল, ট্রেন, স্টেশন ইত্যাদির উন্নতি সত্ত্বেও দুর্ঘটনা কমেনি, রেলের নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীনতার সৌজন্যে। আর এখানেই দেশের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ মাধ্যম রেল পরিষেবা নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে জনগণের৷ মোদির তৃতীয় ইনিংসেও রেলের এইসব অসুখ সারিয়ে তুলতে পারবেন না তিনি, সে-ইঙ্গিত দিয়ে গেল এই দুর্ঘটনা।
ওড়িশার বালাসোরের কাছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা গত বছরের এই সময়েই গোটা দেশের রেল ব্যবস্থার নিরাপত্তার উপরেই প্রশ্ন তুলেছিল। তখনও রেলমন্ত্রী ছিলেন অশ্বিনী বৈষ্ণব। এত বড় রেল দুর্ঘটনা আগে কখনও হয়নি। বালাসোর দুর্ঘটনাকে সরিয়ে রেখে যদি দেখা হয়, সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ২০২১-’২২ সালে দেশে রেল দুর্ঘটনা হয়েছে ৩৫টি। এর ফলে মৃত্যু হয়েছিল ১৭ জনের। আহতের সংখ্যা ছিল ৬৪ জন। ২০২২-’২৩ সালেও রেলমন্ত্রী ছিলেন অশ্বিনী কুমারই। ওই বছরে রেল দুর্ঘটনা হয়েছিল ৪৮টি। মৃতের সংখ্যা ৮ ও আহতের সংখ্যা রয়েছে ৪৭ জন। ২০২৩ সালের ২ জুন একটি মালবাহী রেল, ১২৮৪১ করমণ্ডল এক্সপ্রেস ও ১২৮৬৪ বেঙ্গালুরু-হাওড়া এসএফ এক্সপ্রেস এই তিনটি ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় কমপক্ষে ২৮৯ জন নিহত এবং ৯০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন যা এটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক রেল দুর্ঘটনার মধ্যে অন্যতম দুর্ঘটনায় পরিণত করেছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার দুর্ঘটনা। এসব সত্ত্বেও অশ্বিনী বৈষ্ণব রেল মন্ত্রী থাক বেন কোন যুক্তিতে?