সাধকদিগের হিতার্থে ব্রহ্মের রূপ কল্পিত হইয়া এ সকল প্রতিমার প্রতিষ্ঠা হইয়াছে— সকলেই একথা বলেন। কিন্তু এই পুরাতন শ্লোকের মর্ম যে কী, ইহা অতি অল্প থেকেই তলাইয়া দেখেন। প্রথমতঃ ব্রহ্মের রূপ কল্পিত হয়— ‘সাধকানাং হিতার্থায়’—সাধকদিগের হিতের নিমিত্ত। কিন্তু ‘সাধক’ কাহারা? মানুষমাত্রেই ত সাধক নয়। সাধক হইবার আগে, ‘সাধ্য’ নির্ণয় আবশ্যক। তার সাধ্যে নির্ণয় হয় নাই, তাহাকে সাধক বলা যায় কি? সাধনাবাঞ্ছন ধৰ্ম্ম জীবনের প্রথমাবস্থা নহে, দ্বিতীয় অবস্থা। ধর্ম্মের প্রথম অবস্থাকে সাধুরা প্রবর্ত্তাবস্থা বলিয়াছেন। এই প্রবর্ত্ত-অবস্থা অতিক্রম করিলে, পরে সাধকের অবস্থা লাভ হয়। এই প্রবর্ত্তাবস্থাতেই সাধ্য নির্ণয় হইয়া থাকে। সুতরাং ব্রহ্মতত্ত্ব নিরূপিত হইবার পূর্ব্বে সাধনারম্ভ হয় না, হইতেই পারে না। সাধন আরম্ভ না হইলে কেহ সাধক হয় না, হইতেই পারে না। অতএব সাধকের অবস্থা ধর্মের নিম্নতর অবস্থা নহে। সাধক নিম্ন অধিকারী নহেন। তাঁর চাইতে নিম্ন-অধিকারী প্রবর্ত্তাবস্থায় যে আছে, সে। আর যে প্রবর্ত্তাবস্থা পর্য্যন্ত লাভ করে নাই অর্থাৎ যার কোনও ধৰ্ম্ম জিজ্ঞাসা পর্যন্ত উদয় হয় নাই, সে নিম্ন অধিকারীও নহে; একান্ত অধিকারী। এ সংসারে জিজ্ঞাসুর সংখ্যা অতি কম, হাজারে একজনও মিলে কি না সন্দেহ। সাধন ধর্মে সাধারণ লোকের কোনই অধিকার জন্মে না। তারা নিম্ন অধিকারী নহে, অনধিকারী।
‘সাধকদিগের’ হিতার্থে ব্রহ্মের রূপ কল্পিত হয়, এ যদি সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায়, তাহা হইলে এই রূপ-কল্পনা সাধারণ লোকের জন্য নয়। ইহা মানিতেই হইবে। তারপর এ কল্পনা করে বা করিবে বা করিতে পারে কে? ব্রহ্মের এসকল রূপ কাহার দ্বারা কল্পিত হয়, এ প্রশ্নটা কেউ তোলে না। এই প্রশ্নটা তুলিলেই এ সকল প্রতিমা পূজার মূল মর্ম্মটা খুলিয়া যায়। কারণ ব্রহ্মের স্বরূপ যে জানে, যে সে স্বরূপের সাক্ষাৎকার লাভ করিয়াছে, সেই কেবল ব্রহ্মের রূপ কল্পনা করিতে পারে, অন্যে পারে কি? রূপ বলিলেই যে স্বরূপ আসে। বস্তুর স্বরূপের জ্ঞান যার নাই, সে কি কখন তার রূপ আঁকিতে পারে? অতএব ব্রহ্মের রূপ কল্পনা করিতে গেলে, তাঁর স্বরূপের প্রত্যক্ষ লাভ প্রয়োজন। যিনি রূপ কল্পনা করিয়াছেন বা করেন, তিনি ব্রহ্ম কি, তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। যে সাধকের হিতার্থে এই রূপের কল্পনা হইল বা হইয়াছে, যে সাধক সেই ব্রহ্ম স্বরূপতঃ কি ইহা শুনিয়াছেন কিন্তু দেখেন নাই। এই যোগাযোগ হইলে পরে তবে ‘সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা।’ সম্ভব এবং সার্থক হয়।
সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা— বলিয়া যাঁরা প্রথমে প্রতিমার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, তাঁরা নিজেরা কেবল সাধক নহেন, কিন্তু সিদ্ধ মহাপুরুষ ছিলেন। তাঁরা অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে যে তত্ত্বের প্রত্যক্ষ ও রসের উপলব্ধি করিয়াছেন, তাহাকেই বাহিরে ফুটাইতে যাইয়া এই সকল প্রতিমার প্রকাশ করিয়াছিলেন। কেবল ভিতরে, কেবল সমাধিতে সে বস্তুকে দেখিয়া তাঁদের তৃপ্তি হয় নাই। সমাধিতে দেহীর নিত্য অবস্থা নহে। সমাধি ভাঙ্গিলেই ইষ্টদেবতার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। এই বিচ্ছেদের কালে তাঁহাকে ইন্দ্রিয় সমক্ষে জাগাইয়া রাখিবার জন্যই এইসব রূপ কল্পনা হইতে লাগিল। যাঁরা রূপকল্পনা করিলেন, তাঁরা প্রথমে নিজের সাধনের জন্যই ইহা করেন, অপরের জন্য নহে। এই কল্পিত রূপ তাঁহাদের সম্ভোগের বস্তু হয়। ভক্ত আপনার ইষ্টদেবতা-কে কেবল প্রাণের ভিতরে দেখিয়াই পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করিতে পারেন না। আপনার সাধনের ধনকে কেবল ধ্যান ও সমাধিতে পাইয়াই তাঁর সাধ মিটে না। সকল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তিনি তাঁহাকে ভোগ করিবার জন্য ব্যাকুল হন। সেই প্রিয় চেষ্টার একান্ত নিবৃত্তি করিয়া প্রথমে তিনি আপনার ইষ্টদেবতার সাক্ষাৎকার লাভ করিয়াছেন, যারে অন্তরে অন্তরে তাঁর সঙ্গে নিগূঢ় আলাপ-পরিচয় হইলে বাহিরেও, সেই সকল ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই তাঁহাকে ধরিতে ছুঁইতে না পারিলে তাঁর আনন্দ ও তৃপ্তি যেন পরিপূর্ণ হয় না। সকল প্রেমের সম্বন্ধতেই এটি হইয়া থাকে। প্রণয়ীযুগল প্রথমে নিভৃতে, দুজনার একাকিত্বের মধ্যে একান্ত অব্যবহিতভাবে পরস্পরকে পাইতে চাহে। তখন বাহিরের সম্বন্ধসকল প্রেম সম্ভোগের অন্তরায় বলিয়া মনে হয়। তখন আর কাহারও দৃষ্টি তাহাদের সহ্য হয় না। কিন্তু ক্রমে এমন সময় আইসে যখন বিশ্বের মাঝে বিশ্বের জন সঙ্ঘের সঙ্গে একাত্ম হইয়া তারা নিজেদের প্রিয়তমকে দেখিতে চাহে। নিভৃতে প্রিয়তমকে নিজের হাতে সাজাইয়া একেলা সেরূপ দেখিয়া তাদের আর তৃপ্তি হয় না, জগৎকেও দেখাইতে ইচ্ছা হয়। সকল প্রেমিকের মধ্যেই এক সময়ে না এক সময় প্রেমের এই বর্হিমুখীনতা প্রকাশ পাইয়া থাকে। অন্তরের সম্ভোগকে বাহিরে প্রকাশ করিবার ব্যাকুলতা সাধারণ প্রেম ধৰ্ম্ম। এই ব্যাকুলতা কবিদিগের মধ্যে সর্ব্বদাই দেখিতে পাই। এই ব্যাকুলতা সাধকেরও হয়। আর প্রেমিক, সাধক, কবি ইঁহারা সকলে যে একই জাতীয় জীব। কবি প্রাণের ভিতরে যে রূপের বা রসের সাক্ষাৎকার লাভ করেন, তাহাকে বাহিরে ফুটাইবার জন্য অস্থির হইয়া পড়েন। এ অস্থিরতা, এ বেদনা প্রসূতির প্রসব বেদনার মতন। এ ব্যাকুলতা, এ বেদনা সৃষ্টির অলঙ্ঘ বিধান। এ বেদনা প্রেমিকে জানেন। এ বেদনা কবি জানেন। এ বেদনা সাধকেও ভোগ করিয়া থাকেন। এই বেদনার মধ্য দিয়াই অন্তরের রসমূর্ত্তি শব্দে ও বর্ণে, ছন্দে ও সঙ্গীতে বাহিরে ফুটিয়া উঠে। ইহারই ভিতর দিয়া সাধকের ধ্যান-মূর্ত্তি প্রতিমার রূপে আবির্ভূত হন, বাঙ্গালীর প্রতিমা পূজার মর্ম বুঝিতে হইলে প্রেমধর্ম্মের এই সাধারণ প্রকৃতিটি পর্য্যবেক্ষণ করিতে হইবে।
আরও পড়ুন- ৪১৯ বছর এক রূপেই পূজিতা গদাইপুরের পেটকাটি দুর্গা
প্রেমিক, কবি, সাধক সকলেই আপনাপন প্রাণের এই রস বস্তুকে বাহিরে প্রতিষ্ঠা করিতে চান বটে, কিন্তু পারেন না। এ যে বাহিরের বস্তু নয়। এই রূপ যে অতীন্দ্রিয়। এই লাবণ্য যে ভাবের বর্ণের নহে। এই সৌন্দর্য্য যে রসের, গঠন পরিপাট্যের নহে। এ বস্তু অনঙ্গ, ভাবাঙ্গেতেই কেবল ফুটিয়া উঠে। সে ভাবাঙ্গের পরিপূর্ণ আলোকচিত্র বা ফটোগ্রাফ তুলিতে পারে। এমন যন্ত্র দুনিয়ার নাই। মা আপনার মর্ম্ম পটে সন্তানের যে রূপ দেখেন, বাহিরের চিত্রপটে তাহাকে পরিপূর্ণ রূপে ফুটাইয়া তোলেন, এ শক্তি বিধাতা তাঁহাকে দেন নাই। প্রেমিক প্রেমিকা প্রাণ-পটে প্রেম পাত্রীর বা প্রেম পাত্রের যে রূপ প্রত্যক্ষ করেন, কোনও চিত্র-পটে তাহাকে নিঃশেষে অঙ্কিত করিতে পারেন না। কবি আপনার প্রাণের ভিতরে যাহা দেখেন, এমন শব্দ ও ছন্দ আজিও জগতে আবিষ্কৃত হয় নাই, যাহার দ্বারা সে বস্তুর পরিহার্য মুর্ত্তি ফুটাইতে পারা যায়। এইজন্য রসমূর্ত্তি মাত্রেই একটা অতৃপ্তি জাগাইয়া রাখে। এ রাজ্যে ব্যর্থ চেষ্টাই সার্থক, নিস্ফল প্রয়াসই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক সফলতা লাভ করে।
সংসারের রসের সম্বন্ধ সকল বিশিষ্ট-আধারকে ধরিয়া ফুটে; কিন্তু এ সকল আধারকে ছাপাইয়া উঠে। সাগর-দৃশ্যে যেমন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গগুলি দিগন্ত প্রসারিত হইয়া ক্রমে অনন্ত আকাশের গায়ে মিলিয়া মিশিয়া যায়, মানুষের রসের সম্বন্ধ সকলও সেইরূপ বিশিষ্ট্যকে ধরিয়া গড়িয়া উঠে কিন্তু গড়িতে গড়িতেই ক্রমে নির্বিশেষে যাইয়া মিশিয়া পড়ে। মাতার স্নেহ ক্ষুদ্র শিশুকে ধরিয়াই প্রথমে ফুটে কিন্তু ক্রমে বাৎসল্যের অলখনিরঞ্জন বিশ্বরূপেতে যাইয়া মিশিয়া যায়। তখন সকল সন্তান, বিশ্বসন্তান তাঁর বাৎসল্যের মূর্তি হইয়া উঠে। কিন্তু এত মূর্ত্ত নহে। বিশিষ্ট সন্তানই মূর্ত্ত, সাকার বিশ্ব সন্তান একই সঙ্গে মূর্ত্ত ও অমূর্ত, সাকার ও নিরাকার। প্রথমে যে আধারকে আশ্রয় করিয়া সন্তানের মাতৃভক্তি জাগিয়া উঠে ও বাড়িতে থাকে, তাহা বিশিষ্ট বস্তু, সন্দেহ নাই। এ যে আমার মা। প্রথমে কারও সঙ্গে ভাগাভাগি সহ্য হয় না, আর কেউ তাকে মা বলিয়া ডাকিলে প্রাণ জ্বলিয়া উঠে। কিন্তু ক্রমে যখন আপনার ভক্তি বলে প্রাণের মধ্যে মাকে পরিপূর্ণ ভাবে পায়, তখন তার এই বিশিষ্ট জননীর মধ্যে যে বিশ্বজননীকে পাইবার জন্য ব্যাকুল হয়। এক কণ্ঠে মা বলিয়া তার প্রাণ জুড়ায় না। জগৎ জোড়া সে মা নাম শুনিতে চায়। তখন দুনিয়ার লোককে প্রত্যেক বিশিষ্ট সন্তান, মাতা, সখা ও প্রণয়িণীর মধ্যে এই বস্তু আছে। এই বস্তুকে প্রত্যেক বিশিষ্ট সন্তানাদি প্রকাশ করে কিন্তু কেহই নিঃশেষ করিতে পারে না। এই অমূর্ত্ত রস বিগ্রহই সন্তানাদির ছাঁচ, তাহাদের বিকাশ গতির নিয়ন্ত্রা। ইহাই বাৎসল্যাদি রসের সার্থকতা লাভের এক ও অনন্য নিদান। সখা-বাৎসল্যাদির রসমূর্তিসকল এই অমূর্ত রস বিগ্রহকেই ফুটাইতে চেষ্টা করে।
— ছবিটি বেলেঘাটা শুঁড়া স্পোর্টিং ক্লাবের মাতৃমূর্তি