ইতিবৃত্তের বিধবারা

আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস হল গোটা পৃথিবীর বহু দেশের লক্ষ লক্ষ বিধবাদের ‘দারিদ্র’ এবং ‘অবিচার’ মোকাবিলা করার জন্য জাতিসংঘের অনুমোদনকৃত একটি দিবস। দিনটি প্রতি বছর ২৩ জুন উদযাপিত হয়। ভারতবর্ষে বিদ্যাসাগর বিশ্বায়নের মতোই বিধবা-বিবাহের দেশায়ন করেছিলেন। আগামিকাল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মদিন। তাঁর সাহিত্যেও উঠে এসেছে বিধবা চরিত্র। বিধবা নিয়ে কলম ধরেছেন শরৎচন্দ্র, রবি ঠাকুর সকলেই। এই লিভি-ইন, সিঙ্গল পেরেন্টিং আর ডিজিটাল নেট দুনিয়ার যুগে বিধবার সংজ্ঞা আরও বদলে গিয়েছে। বিধবারা আর আগের মতো ততটা বিধবা নন। আজ কোনও বাঙালি বিধবাকে বিনোদিনীর মতো কাশী যাত্রা করতে হয় না। লিখছেন বর্ণালী জানা

Must read

বাংলা শব্দে ‘বিধবা’র অর্থ একজন নারী যিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় ‘উইডো’ শব্দের অর্থ যেমন বিধবাকে বোঝায়, ‘উইডোয়ার’ বলতে বোঝায় পুরুষকে যিনি স্ত্রীকে হারিয়েছেন বা যাঁর স্ত্রী মৃত। বাংলায় বিধবা শব্দের দৃশ্যকল্প-অর্থ সাদা থান পরিহিতা নারী। সংসারের মধ্যে থেকেই যিনি অদৃশ্য এক অস্তিত্ব। তিনি নারী এবং মৃত স্বামীর স্ত্রী যার থাকা, না-থাকা, অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব, স্বাধীনতা-পরাধীনতা, চেতন-অচেতন সবকিছুই তাঁর মৃত স্বামীর অতীত অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত, বাহ্যত সামাজিক ভাবে তিনি একটি ছায়া মাত্র। এই ছায়ার প্রাচুর্য থাকলেও বা নিঃস্ব হলেও সামাজিক ভাবে বেঁচে ওঠার কোনও প্রেরণা নেই, ছিলও না, অন্তত বিদ্যাসাগরের সময়ের আগের কোনও বাংলার জনমানবজীবন এবং স্মৃতিতে।

আরও পড়ুন-মাই নেম ইজ গওহর জান

অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে ‘উইডো’র অর্থ ‘আ উওম্যান হু হ্যাজ লস্ট হার স্পাউস অর পার্টনার বাই ডেথ অ্যান্ড ইউজুয়ালি হ্যাজ নট রিম্যারেড’। এখানে ‘রিম্যারেড’ খুব তাৎপর্যপূর্ণ যার অর্থ পুনর্বিবাহ। মৃত স্বামীর স্ত্রীর পুনরায় বিবাহ হলে তিনি সধবা। তাহলে বিধবার বিবাহ হলেই সামাজিক ভাবে তিনি পুনর্বার সধবা হন। ‘রিম্যারেড’ উওম্যান। বিদ্যাসাগর ঠিক এই জায়গাটিতে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজটি করেছিলেন। বিধবা বিবাহ আন্দোলন শুরু করেছিলেন, প্রাণের হুমকি পেয়েও নিঃস্ব, দুঃস্থ, লাঞ্ছিতা ও অত্যাচারিত বিধবা মেয়েদের জন্য লড়াই করেছিলেন। বহুগামী, বহুনারীভোগে অভ্যস্ত কুলীন সমাজের পৌরুষে তিনি চরম আঘাত হেনেছিলেন। ভীমরুলের চাকে ঢিল মারার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সমাজের ধারক, বাহক চেতনাহীন এক শ্রেণির পুরুষ এবং আহার-নিদ্রার বেশি ভাবতে না পারা নিরীহ বাঙালি সমাজ স্বার্থের নানা কারণে খেপে উঠেছিল। বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ প্রচলন করে শুধু একটি সমাজ নয়, একটি জাতি-শ্রেণি নয়, মানবতাকে চেতনা দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-উনিশ শতকে সাহিত্যের অঙ্গনে মহিলারা

পরিষ্কার করে বললে, বিদ্যাসাগর বিশ্বায়নের মতোই বিধবা-বিবাহের দেশায়ন করেছিলেন। এখন প্রশ্ন, যে বিধবাদের আমরা প্রাচীন ভারত, মধ্যযুগীয় ভারত (অখণ্ড বাংলাদেশে) এবং তার পরবর্তী সময়ে দেখেছি সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় তাঁরা কি সেই সেদিনের মতোই আছে?
বর্তমান সমাজে কে বিধবা? তাঁদের কি সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে? জিজ্ঞাসা চিহ্ন থেকেই যাচ্ছে। রামমোহনের সময়, উইলিয়াম বেন্টিংকের সময় সতীদাহ প্রথা রোধে আন্দোলন হয় এবং সতীদাহ আইননানুগ ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময়ই যে বিধবাদের আমরা দেখেছি বিদ্যাসাগর এবং তাঁর পরবর্তী সময়ে তাদের সামাজিক অবস্থা ও মর্যাদা ও অধিকার কতটা দিতে পেরেছে এই সমাজ তা একটি গবেষণার বিষয় হতেই পারে। ১৮২৯-এ সতীদাহরোধ, ১৮৫৬-তে বিধবা বিবাহের অনুমোদন।

আরও পড়ুন-শিশু পড়ুয়াদের বিকাশে সক্রিয় পুলিশ কর্মীর পাঠশালা

বিদ্যাসাগরের এই সময়ে বিধবা বিবাহ কাণ্ড নিয়ে কী কী হয়েছিল তা অপর একটি প্রসঙ্গ যা পুনরায় আলোচিত হতে পারে। এই সময়ে যেমন বিধবা বিবাহ নিয়ে সামাজিক ভাবে সাধারণ তো বটেই, এমনকী, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও সংশয় এবং ‘দুই-পা এগিয়ে দশ পা পিছিয়ে যাওয়ার’ ঘটনাও বিরল ছিল না। বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিধবা প্রতিমা দেবীকে নিজের পুত্রবধূ করে ঘরে এনেছিলেন। এই সাহস তিনি ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথের বিধবা সাহানা দেবীর বেলায় দেখাতে পারেননি। একটি প্রতিবাদও না করে পিতা দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে সাহানা দেবীকে পিত্রালয় থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন যেখানে কন্যার পিতা চাইছেন মেয়ের পুনর্বিবাহ। এমন সাহস সেদিন ব্রাহ্ম সমাজও দেখাতে পারেনি। মনে পড়ছে চতুরঙ্গ-র দামিনী—বিধবা সেই নারী। রবীন্দ্রনাথের কলম শ্রীবিলাসের সঙ্গে দামিনীর বিবাহ দিয়েছিল। বঙ্গজীবনে বিধবাদের করুণ অবস্থার কথা আমরা সাহিত্যে বারংবার পাই। শরৎ সাহিত্যে বিধবার মূল্যায়ন ও বাংলা সাহিত্যে বিধবা—এইসব বিষয়ে গবেষণা চলতে পারে। বিধবার পুনর্বিবাহ দিয়ে বিদ্যাসাগর যে কত বড় উপকার করেছিলেন তা সর্বকালের নারীমন জানে।

আরও পড়ুন-বাংলাদেশে বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৪২, ভিটেমাটি ছাড়া ৪৫ লক্ষ মানুষ

তবুও কি বিধবাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন (খুন, ধর্ষণ) কমেছে? পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই যেখানে শত্রু ও ধর্ষক, বৈধব্যের পূর্ণ সুযোগ নিতে বহুগামী পুরুষ যখন ক্ষুধার্ত শিকারি (নিকৃষ্ট মনুষ্য)— তখন কি আমাদের মনে হবে না যে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও, নারীর মূল্যের কথা বললেও আমরা বিধবাদের পূর্ণ সামাজিক, আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারিনি? নারী সমাজের এই ভগ্নাংশ– বিধবাদের জন্য সমাজ কতটা সচেতন? এরা কতটা আলোচিত? শুধু কি বিধবাদের পেনশন দিলেই সমস্যা মিটবে? তাঁদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যায় না? সংসারের তারা কেন পৃথগান্ন? অস্বীকার করার উপায় নেই বিধবা ভাতা কিছুটা নিরাপদ নিরাপত্তা। কিন্তু সকলের ভাগ্যে তো এটা জোটে না। তাহলে বৃহত্তর অংশের কী হবে? জিজ্ঞাসা থেকেই যাচ্ছে।
দক্ষিণেশ্বরের পাঁচ টাকার পুরোহিত ক্যানসার আক্রান্ত শ্রীরামকৃষ্ণও স্ত্রীর আসন্ন বৈধব্য জীবন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। মা সারদার জন্য উইডো পেনশনের কথা ভেবেছিলেন। একসময় দক্ষিণেশ্বরের কর্তারা মায়ের মাসোহারার ছ’-সাত টাকাও বন্ধ করে দিয়েছিল। বৈধব্য জীবনে সারদা মাও তো কম কষ্ট করেননি।

আরও পড়ুন-সাংবিধানিক কাঠামো ও গণতন্ত্র রক্ষাই আমার অগ্রাধিকার: যশোবন্ত

মনে করে দেখুন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের কথা। একাদশ পরিচ্ছেদে সূর্যমুখী কমলমণিকে লিখছে, ‘আরেকটা হাসির কথা ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছে, তিনি আবার একখানা বিধবা বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন, যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তাহলে মূর্খ কে’? ১৮৫৫ সালে বিধবা-বিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগরের দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল।
অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, বিধবা শব্দের একটি সংজ্ঞা পাওয়া গিয়েছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে এই পৃথিবীতে যখনই গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, জাতিতে জাতিতে, রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়েছে তখনই হাজার-হাজার, লক্ষ লক্ষ মেয়ে বিধবা হয়েছে। রামায়ণ, মহাভারতে দেখুন, এই ভারতের যত কুরুক্ষেত্র যত বিধবার জন্ম। পানিপথ থেকে বক্সার, বা দাক্ষিণাত্য থেকে পলাশি— চিত্র একই। প্রথম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম, কিউবা, সাউথ আফ্রিকা, ইরাক-ইরান, কুয়েত, স্পেন, আফগানিস্থান, বাংলাদেশ, ভারত-চিন যুদ্ধ যা সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণাম সেই একই। তথ্য বলছে এই বিশ্বে বর্তমানে বিধবার সংখ্যা ৩৫ কোটি। ভারতে এই সংখ্যা ৪ কোটি ৬০ লক্ষ, যার মধ্যে যুদ্ধ-বিধবা ২৭,০০০।

আরও পড়ুন-ভূমিকম্পের পর প্রবল বন্যা শুরু, ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধারকাজ

গল্প উপন্যাসের পাতায় বিধবাদের করুণ কাহিনি পড়ে আমরা দু’ ফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারি। কিন্তু তার বেশি কিছু করতে পারি না। কেননা, রাষ্ট্রক্ষমতা সাধারণ মানুষের হাতে নেই। আমাদের দেশে বিধবা ভাতা চালু থাকলেও সামগ্রিকভাবে বিধবাদের উন্নয়নের জন্য কোনও সার্বিক পরিকল্পনা নেই। শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলে না। নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের বাইরে তো বিধবারা নন, তাঁদেরও বয়সের তারতম্যে সুযোগ দিতে হবে। বিধবাদের আর্থিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের জন্য চাই কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। সমাজের মূলস্রোতে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হলে তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। একাদশী, পূর্ণিমা, মেনে চলা, মাছমাংস মসুর ডাল বর্জন, সাদা থানকাপড়, চুল-ছাঁটা, এমনকী, তাঁদের যৌন-অক্ষম করার জন্য শারীরিক নির্যাতন আর কতদিন? এই লিভি-ইন, সিঙ্গল পেরেন্টিং আর ডিজিটাল নেট দুনিয়ার যুগে বিধবার সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে। বিধবারা আর আগের মতো ততটা বিধবা নন। তাঁরা নিজের ন্যায্য অধিকার লাভের জন্য সচেষ্ট, লড়াই করছেন। বিদ্যাসাগর একদিন যে মন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন সেই মন্ত্রবলে, আজ তাঁরা নিজেরাই পুনর্বিবাহ করছেন, কিংবা স্বাধীন ব্যক্তিসত্তায় বাঁচছেন, এমনকী, পুরুষের সহজাত ও স্বাভাবিক যৌন-নির্যাতনের থেকেও তাঁরা নিজেদের রক্ষা করতে শিখেছেন। তাই আজ কোনও বাঙালি বিধবাকে বিনোদিনীর মতো কাশী যাত্রা করতে হয় না।

Latest article