অপেক্ষা তো অনেক হল, কিন্তু পাল্টা মারেই কি মিটবে সব!

যদি তুমি শান্তি চাও, যুদ্ধের দামামা বাজাও। এই তত্ত্ব কি আমাদের সর্বস্ব হয়ে দাঁড়াবে? মুখে হুঙ্কার নয়, এবার করে দেখানোর চ্যালেঞ্জ। দেশবাসী ফুঁসছে ২৬ জন তরতাজা পর্যটক হত্যার বদলার দাবিতে। একটাই অপেক্ষা, ‘জঙ্গি’ পাকিস্তানের কোমর ভাঙবে কবে? লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

সীমান্তপারের সন্ত্রাস এদেশে নতুন নয়। স্বাধীনতার পর ষাটের দশক থেকে শুরু করে একাত্তরের যুদ্ধ, বাজপেয়ী জমানার কার্গিল লড়াই, উরির সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, পুলওয়ামার হামলার পাল্টা বালাকোট— একের পর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সাক্ষী আমরা।
এর বাইরে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে ২৬/১১’র সেই হাড়হিম করা আক্রমণ এবং ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের স্মৃতি এখনও টাটকা।
প্রতিবারই বলা হয়, সন্ত্রাসীদের নিকেশ করেই ছাড়ব। সীমান্তপারের মদত এবার বন্ধ হবে। অতি-আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার প্রদর্শন করে সম্ভ্রম আদায়ের চেষ্টা চলতে থাকে। দিন যায়, ফিকে হয় স্মৃতি। ফিরে আসে পাকিস্তানি জঙ্গি হামলা। এ ঘৃণার যেমন বিনাশ নেই, তেমনি যুদ্ধ হুঙ্কারেরও!
কী হত যদি বেহালার বিতান আমেরিকা থেকে ফিরে পরিবার নিয়ে কাশ্মীর বেড়াতে না যেতেন? সখেরবাজারের সমীর আর শর্বরীও সেদিন দুপুরে অভিশপ্ত বৈসরণ ভ্যালিতে যদি পা না রাখতেন গুহবাড়ির ছবিটাও মুহূর্তে অন্ধকারে বদলে যেত না। পাহাড়ের কোলে ক্লান্ত অপরাহ্ণে সেদিন পুনের ব্যবসায়ী সন্তোষ জাগদালেকে উগ্রপন্থীদের হুকুম, ‘বাইরে আয়’।
অতঃপর তাঁবুর বাইরে টেনে বের করেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ২৬টা লাশের সঙ্গেই স্বপ্ন শেষের বেদনায় মুহ্যমান ২৬ জন সঙ্গী!
৫ অগাস্ট, ২০১৯ সেনায় মুড়ে জনজীবন স্তব্ধ করে বিরোধীদের জেলে পুরে, মাসের পর মাস নজরবন্দি করে রেখে কাশ্মীরকে ভারতীয়দের ভ্রমণযোগ্য করে তোলার অঙ্গীকার করেছিল মোদি সরকার। এক দশক আগের নোট বাতিলের পরও যেমন কালো টাকা দেশ থেকে শেষ হয়নি।
বছরে দু’কোটি চাকরির খোয়াব বিপণনের পরও যেমন বেকার সংখ্যা ঊর্ধ্বগামী, গালভরা জিএসটি কর কাঠামোকে সরল করার পরিবর্তে যেমন গোটা ব্যবস্থাকে আরও জটিল করেছে, তেমনি ৩৭০ ধারা বিলোপের পর লম্বা চওড়া আশ্বাস যাই দেওয়া হোক উপত্যকা আছে সেই জঙ্গি তিমিরেই।
আসলে হিংসা আর বিদ্বেষ শেষ হওয়ার নয়!
এবারের ঘটনা নিঃসন্দেহে কাশ্মীরের আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত হওয়ার পর সবচেয়ে বড় হামলা, যা অভিঘাতে ছাড়িয়ে গিয়েছে পুলওয়ামা কাণ্ডকেও।
দেশবাসীর দাবি, উরি, বালাকোটের চেয়েও বড় প্রত্যাঘাত চাই। যাতে শত্রুরা সারা জীবন তা মনে রাখে।
প্রধানমন্ত্রীও বিহারের মধুবনিতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘এমন মারব, ওরা ভাবতেও পারবে না’। দেশবাসীও তাই চায়। রাফাল, সুখোই, যুদ্ধ ট্যাঙ্ক মহড়া দিতে শুরু করেছে। কিন্তু পাল্টা আঘাত কবে, এই লেখা প্রেসে যাওয়া পর্যন্ত তা স্পষ্ট নয়। হুঙ্কারের মধ্যেই কি মিলিয়ে যাবে এই নারকীয় গণহত্যা? ট্রাম্প-পুতিনের ক্ষোভ, ইজরায়েলের সমর্থন সব বৃথা যাবে!
একসপ্তাহ একমাস একবছর একদশক … পেরিয়ে যাবে। আমরাও ২২ এপ্রিলের ঘটনা ভুলে আবার ব্যস্ত জীবনে কখন হারিয়ে যাব। খবরেরও মুখ বদল হবে। কিন্তু যে দিগন্তব্যাপী ঘৃণা আর বিদ্বেষ বুকে নিয়ে এদেশে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান তার পরিণতি কী?
বিদ্বেষ, অস্ত্রের ঝনঝনানি আরও বড় ঘৃণার জন্ম দেয়, এটা ভুলে গেলে চলবে না। টানা তিন বছর যুদ্ধের পরও শক্তিধর রাশিয়া সোচ্চারে বলতে পারছে না ইউক্রেন পরাজিত। আসলে আধুনিক যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে, মানুষ মরবে, অর্থনীতি ধসে যাবে। কিন্তু জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি শুধু কঠিন নয়, কার্যত দূরঅস্ত! জাতের নামে বজ্জাতির শেষ নেই। এসব শুনতে যত ভাল, লিখতে যত তৃপ্তি, বাস্তব কিন্তু ততটা নয়।
সমাজের ডিএনএ’তে যদি ঘৃণা বাস করে তাহলে সুগন্ধী শতফুল, কবিতার দৃপ্ত উচ্চারণও পোকায় খেয়ে যায়!
বিদ্বেষ কমাতে না পারলে, এই পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন হবে না। ইতিহাস সাক্ষী, ঘৃণা দিয়ে ঘৃণাকে দমন করতে গেলে তা আরও বড় সঙ্কটেরই জন্ম দেয়। সন্ত্রাস খতম হয় না, বাড়তেই থাকে।
কথাগুলো আমরা যেন ভুলে না যাই।

আরও পড়ুন: বিজেপির মুখোশ খুলে গিয়েছে : জয়প্রকাশ

Latest article